শৈল্পিক বাবল প্যালেস

বাবল প্যালেস, স্থাপনাটি যেন জীবন্ত এক শিল্পকর্ম। একই সঙ্গে সবুজ প্রকৃতি ও জলধারা যেন মিলেমিশে একাকার। নান্দনিকতায় অনন্য হওয়ায় স্থাপনাটি অসংখ্য নামীদামি মডেলের ফ্যাশন ফটোগ্রাফির ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রায়ই ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল পার্টি এবং অন্যান্য গ্র্যান্ড ইভেন্টের জন্য ব্যবহৃত হয় বাবল প্যালেস। ভিন্ন ধাঁচের নান্দনিক ও পরিবেশবান্ধব এই স্থাপত্যটির আদ্যোপান্ত এবারের লেখনীতে।  

স্থাপনাটি দেখতে হুবহু বাবল আকৃতির, যেন ডাউস কতগুলো বুদবুদ। বাবল প্যালেস বা প্যালেস বুলেস অথবা পিয়েরে কার্ডিন হাউস। যে নামেই ডাকুন না কেন, এ ধরনের স্থাপনা বিশ্বে বিরল তা বলাই বাহুল্য। ফ্রান্সের অন্যতম আইকনিক এই স্থাপনাটির প্রকৃত নাম পিয়েরে কার্ডিন হাউস। কিন্তু গোলাকার বাবলের মতো দেখায় এটি বাবল প্যালেস নামেই সুপরিচিত। বাবল প্যালেস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালখ্যাত কান শহরের কাছেই থিয়েউল-সুর-মের নামক স্থানে নির্মিত এক সুবিশাল স্থাপনা। এটি ভূমধ্যসাগরের তীরে একটি পাথুরে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। এই স্থাপনাটি সত্তরের দশকের ভবিষ্যৎবাদী স্থাপত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। স্থাপত্যের অনন্য নিদের্শনস্বরূপ ভবনটি ১৯৯৯ এবং ২০১৬ সালে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।


স্থাপনাটি দেখতে হুবহু বাবল আকৃতির, যেন ডাউস কতগুলো বুদবুদ। ছবি: মাইবেস্টপ্লেস

হাঙ্গেরিয়ান স্থপতি আন্টি লোভাগ এই ভবনটির নকশা করেছিলেন। বাবল প্যালেস বিশ^ব্যাপী পরিচিত এনে দিয়েছে আন্টি লোভাগকে। ১৯৭৫ সালে স্থাপনাটির নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৮৯ সালে। এটি শহরের প্রান্তে অবস্থিত হলেও যেন প্রকৃতির মধ্যে মধ্যমণি হয়ে উঠেছে। ১২০০ বর্গমিটারের অবকাশ বাড়িটির সামনের অংশে বিশাল প্যানোরামিক লাউঞ্জ সঙ্গে সবুজ পরিসর। গাছপালার ওপর দিয়ে ও ফাঁক গলে চোখে ধরা দেয় ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি। অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য প্যানোরামিক লাউঞ্জের প্রান্তে রয়েছে ৫০০ আসনের উন্মুক্ত অ্যাম্ফিথিয়েটার। স্থাপনাটি ঘিরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সুইমিং পুল এবং জলপ্রপাত। এই প্রপাতগুলো যেন প্রবাহিত হচ্ছে বাড়িটির অন্দরের বিভিন্ন পরিসর থেকে। ১০টি বেডরুমের সঙ্গে আরও কিছু দরকারি কক্ষ, যেগুলো নান্দনিক সাজ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রতিটি ঘরেই প্রবাহিত হয় প্রাকৃতিক বাতাস। দিনের আলোও পৌঁছে যায় প্রতিটি কক্ষে। রাতের মায়াবী জোছনা উপভোগের জন্য এ রকম স্নিগ্ধ পরিবেশ অন্তত শহরে মেলে না তা এক দেখাতেই বলা যায়। অমাবশ্যার রাতে যখন সমগ্র স্থাপনাজুড়ে আলো ঠিকরে বের হয় তখন তা দেখতে যেন মনে হয় এক বর্ণিল বাতিঘর। তা ছাড়া ব্যতিক্রমী স্থাপনাটির মনোরম ভিন্ন রং সহজেই যে কারও নজর কাড়বে।    

স্থাপনাটির এক্সটেরিয়র ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কারণ এর প্রতিটি কক্ষ ফ্রাঙ্কোইস চৌভিন, প্যাট্রিস ব্রেটো এবং জেরার্ড ক্লোরেক-এর মতো বিখ্যাত সমসাময়িক শিল্পীদের ডিজাইনকৃত। ইন্টেরিয়র উপকরণগুলোও ডিজাইন করা হয়েছে গোলাকার আকৃতিতে। এমনকি জানালা এবং লাইট ফিচারও একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে সাজানো। জানালাগুলো দেখলে মনে হবে স্থাপনার সঙ্গে চমৎকার এক মেলবন্ধন। সাধারণত স্থাপনায় গোলাকার জানালার ব্যবহার খুব কমই হয়ে থাকে। স্থপতি এই ভবনটির ক্ষেত্রে জানালা ও সানশেডের মধ্যে করেছেন চমৎকার সমন্বয়।

হাঙ্গেরিয়ান স্থপতি আন্টি লোভাগ এই ভবনটির নকশা করেছিলেন। ছবি: গেটিইমেজ

প্রকৃতপক্ষে বাবল প্যালেস একজন ফরাসি শিল্পপতির জন্য তৈরি করা হয় কিন্তু পরে, পিয়েরে কার্ডিন নামে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এটিকে তাঁর অবকাশ বাড়ি হিসেবে কিনেছিলেন। ইতালীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি ডিজাইনার কার্ডিন শুধু ফ্যাশনজগতের একজন ডিজাইনার হিসেবেই কিংবদন্তি ছিলেন না, তাঁর রুচি ও নান্দনিকতার জন্যও সুপরিচিত। তবে কার্ডিন কখনোই এখানে বাস করেননি কিন্তু ঘোষণা করেছেন ‘এই প্রাসাদটি আমার স্বর্গের স্বর্গে পরিণত হয়েছে। এর সেলুলার ফর্মগুলো দীর্ঘকাল ধরে আমার সৃষ্টির চিত্রের বাহ্যিক প্রকাশকে প্রতিফলিত করেছে। এটি এমন একটি জাদুঘর, যেখানে আমি সমসাময়িক ডিজাইনারদের কাজ প্রদর্শন করি।’

অর্থনৈতিক কারণে হোক বা প্রযুক্তিগত সমাধানের অভাবের জন্য, মানুষ নিজেদের  বাসায় বন্দী করে অবাধ বিচরণ ও প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধাকে সীমাবদ্ধ করেছে। এ জন্য লোভাগ স্থাপত্য নির্মাণে সরলরেখাকে পছন্দ করতেন না। কারণ তাঁর মতে, ‘আয়তকার স্থাপনা প্রকৃতির বিরুদ্ধে আগ্রাসন; মানুষ্য নির্মাণ আরও নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। স্থাপনা হবে খেলার মতো স্বতঃস্ফূর্ত, আনন্দদায়ক ও বিস্ময়ে পূর্ণ।’ লোভাগের যুক্তি হলো, আমাদের বাহু এবং পায়ের গতি মহাকাশজুড়ে সার্কেল অনুসরণ করে; দৃষ্টির একটি বৃত্তাকার ক্ষেত্রের অনুরূপ। কনভিভাইলিটি একটি বৃত্তাকার ঘটনা। বৃত্তটি মানুষের জীবন যেভাবে পরিচালিত হয় তা গঠন করে। তিনি তাঁর কর্মজীবনে এই ধারণাটি অন্বেষণ ও প্রোটোটাইপ বা পরীক্ষামূলক কাঠামো তৈরি করেছেন, যা মানবদেহ তার তত্ত¡গুলোকে প্রতিফলিত করে। 

বাবল প্যালেসে পিয়েরে কার্ডিন ২০০৮ সালে তাঁর একটি সংগ্রহ প্রদর্শন করেছিলেন। এ ছাড়া এখানে বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শো ও শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ফরাসি স্থপতি ওডিল ডেক প্রায় পাঁচ বছর ধরে বাবল প্যালেস সংস্কার করেন। এরপর ২০১৭ সালে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যে বিক্রির জন্য দাম হাঁকানো হয় কিন্তু কোনো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পিয়েরে কার্ডিনের মৃত্যুর পর ভবনটিকে আর্ট এক্সপোর একটি পাবলিক ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিদিনের ভেন্যু ভাড়া ৩৩ হাজার ২০০ ডলার।

২০১৭ সালে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যে বিক্রির জন্য দাম হাঁকানো হয় কিন্তু কোনো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছবি: মাইবেস্টপ্লেস

সম্প্রতি ক্রিস্টি’স ইন্টারন্যাশনাল রিয়েল এস্টেট এই স্থাপনাটি বিক্রির জন্য তালিকাভুক্ত করেছে। যদিও বাড়ির বিক্রয়মূল্য উল্লেখ করা হয়নি ওয়েবসাইটে। তবে কারও অনুরোধের ভিত্তিতে সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে বাড়ির বিক্রয়মূল্য পাঠানো হয়। তবে ফ্রান্সের শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধাদের দাবি, স্থাপনাটি ব্যক্তিমালিকানার বদলে সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করুক প্রদর্শনী, পার্টি এবং কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অতিরিক্ত ভেন্যু হিসেবে ব্যবহারের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top