ফরাসি স্থাপত্যের অমর কবি স্থপতি জঁ রিনডি

জঁ রিনডির জন্ম ফ্রান্সের আইভরি স্যুর সিন শহরে, ১৯২৫ সালের ৮ জুন। ফ্রান্সে, বিশেষত প্যারিসের নিকটবর্তী আইভরি স্যুর সিন শহরে তিনি আধুনিক সব আবাসনের ডিজাইন করেছিলেন। তাঁর ‘আরবান হাউজিং’ পরিকল্পনা এতটাই সূক্ষ্ন যে তিনি এখানকার বাসিন্দারের আক্ষরিক অর্থেই শহরের বাইরে না এনেও শহুরে ও আধুনিক জীবনযাপনের স্বাদ দিতেন। বসবাসের জায়গাকে কেবল ‘ব্যক্তিগত বাসাবাড়ি’ না বানিয়ে বরং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো আবাসস্থল হিসেবে দেখাতেই পছন্দ করতেন বেশি। ক্লায়েন্টকে স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দ বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিতেন আর ক্লায়েন্টরাও তাঁকে তাঁর মতো করে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৈরি হতো বলার মতো সব স্থাপনা, যা তাঁর ক্লায়েন্টরা আজীবন মনে রাখতেন। শুধু ফ্রান্সে নয়, বরং যাঁর বিস্তৃতি ছিল দুনিয়াজুড়েই।

দীর্ঘকাল ধরে এসব স্থাপত্যকর্ম তাঁর নির্মাণের সহকারী ছিলেন স্থপতি রেনে গেইলহাউসটেট। সমসাময়িক বিখ্যাত দুই স্থপতির কাজের প্রভাব ছিল যাঁর ওপর প্রবল। যাঁর একজন স্থপতি অগাস্ট পেরেট আর অন্যজন মারসেল লডস, যাঁরা ছিলেন ভবন ডিজাইনে তখনকার জনপ্রিয় কংক্রিট বিশেষজ্ঞ। জঁ রিনডি তাঁর তিন সহকর্মীকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘এটেলিয়ার মন্ট্রোগ’ নামের স্থাপত্য ফার্ম, যার কাজই ছিল জ্যামিতিকভাবে নির্ভুল সব স্থাপনার ডিজাইন করা। বেশ কিছু স্থপতি কাজ শুরু করেন এখানে। এর মাঝে পিয়েরে রিবোউলেট, জেরার্ড থার্নার এবং জিন লুই ভেরেট নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। স্থপতি রেনে গেইলহাউসটেটের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ শুরুর পরই শুরু করেন কমিউনিস্টশাসিত শহর আইভরি স্যুর সিনের পুনঃসংস্কারের কাজ। তবে কাজের শুরুতে জিন হ্যাচেটের ভেতরকার বাণিজ্যিক অংশের কিছু দোকান ভেঙে ফেলার মতো কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো কখনোই তাঁর কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি।

আইভরি স্যুর সিন প্রকল্পের একাংশ ও আইভরি স্যুর সিন প্রকল্প

১৯৫৮ সালে স্থপতি হিসেবে কাজের লাইসেন্স পেয়ে গড়ে তোলেন ‘এটেলিয়র ডি মন্ট্রোগ’। স্থাপত্যের যে শাখা নিয়ে তিনি কাজ করতে লাগলেন তা খুবই সিম্পল ফর্ম ক্রিয়েট করত এবং সাদাসিধে প্লাস্টিক ইফেক্ট দিত। এ কারণে এই স্থাপত্যকলার নাম হয়েছিল ‘ব্রুটালিস্ট’ বা পাশবিক স্থাপত্যকলা। তাতে কিন্তু তিনি দমে যাননি। একে একে গড়ে তুলেছেন বিশ্বখ্যাত সব স্থাপত্যকীর্তি। আলাদা হয়ে কাজ করা শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। হঠাৎ করেই চুক্তিভঙ্গের অজুহাতে নতুন শহর ভাল ডি রিউলের প্ল্যানিং কাজ থেমে যায়। রিনডি পুরো শহরটাকে পাহাড়ের ওপর স্থাপন করার চিন্তা শুরু করেন। যেখানে বাইরের দিকের ফর্মগুলো দিয়ে ঢেকে রাখবে পুরো পাহাড়টিকে। এ জন্য তিনি নিজের এজেন্সি শুরু করেন আইভরি সুর সিনে। ১৯৭১-১৯৭৫ সাল এবং ১৯৭৬-১৯৮০ সাল অবধি তিনি সেন্টার অব আইভরির সংস্কারকাজ করেন। দুই ধাপে হওয়া কাজটিতে তিনি সঙ্গে নেন স্থপতি রেনে গেইলহোস্টেটকে। এর মাঝে জিয়ান্নি হ্যাচেটি শপিং সেন্টারের কাজ করে বিশ্বজুড়ে লাভ করেন জনপ্রিয়তা, পান দারুণ সব স্বীকৃতি।

ফ্রান্সের সংস্কৃতিমন্ত্রী কর্তৃক সম্মানজনক ‘গ্র্যান্ড প্রিক্স ন্যাশনাল ডি আর্কিটেচার’-এর খেতাব পান সামগ্রিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। তাঁর কাজের মাঝে সামাজিক হাউজিং এবং শহর ডিজাইন ছিল মুখ্য। তিনি কখনোই স্থাপত্যকলাকে পদ্ধতিগতভাবে অনুসরণ করেননি। তাঁর প্রতিটা কাজের মাঝেই ছিল অনেক পার্থক্য। এমনকি তাঁর পাশাপাশি দুটো কাজকে কখনোই মেলানো সম্ভব হতো না। তিনি প্রতিটি স্থাপত্যকলাকে নিজেদের ধরন ও বিন্যাস অনুযায়ী সাজাতে পছন্দ করতেন।

স্থপতির হাতে আঁকা প্ল্যানিং ডিটেইল ও আইভরি স্যুর সিনের প্ল্যান

আইভরি স্যুর সিন শহরের ডিজাইনটি দেখলেই বোঝা যাবে স্থপতি জঁ রিনডির স্থাপত্যজ্ঞান। একটা জ্যামিতিক ফর্মের ভেতর কী সুন্দর করে তিনি প্রবেশ করিয়েছেন বিভিন্ন ফাংশন। বিশেষ করে চোখে পড়বে তাঁর বারান্দার ব্যবহার। প্রতিটি শয়নকক্ষের সঙ্গে একটি করে সুবিশাল বারান্দার টেরেস যুক্ত করে তাতে সবুজের চাষ সে আমলের একটি নিñিদ্র চিন্তা ছিল, যা এর আগে কখনোই কেউ করেননি তেমন করে। জ্যামিতিক নকশাকে আর্কিটেকচারে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি যেভাবে বিভিন্ন ঘরের সন্নিবেশন করেছেন, তা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। এখন অনেক স্থপতিই আছেন, যাঁরা বাড়ির বাইরের ডিজাইনের সঙ্গে ভেতরের ডিজাইনের সন্নিবেশ ঘটাতে হিমশিম খান। বিশেষ করে বর্তমানে অনেক বিখ্যাত স্থপতিরই বিখ্যাত সব কাজের ভেতরকার ইন্টেরিয়র চিন্তাভাবনার মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। জঁ রিনডি আজ থেকে ৪০ বছর আগে দেখিয়েছেন কীভাবে একটি বর্গাকার বা চতুর্ভুজাকার ফর্মের ভেতর না থেকেও একটি বাড়ির ভেতরকার ডিজাইন করা যায়। প্রতিটি অংশকে চিন্তা করে গড়ে তোলা যায় একটি নিবিড় স্থাপনা। শয়নকক্ষের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা বা মূল সার্কুলেশন পথে তিনি বিছিয়েছেন বৃত্তাকার সিঁড়ি, যাতে ডুপ্লেক্সগুলো হয়ে উঠেছে সত্যিকারের দৃষ্টিনন্দন। আজ প্রায় ৪০ বছর পরেও ঘরের ভেতর একটি সিঁড়ি ব্যবহার করে অনেক স্থপতিই দুটো ইউনিটকে ডুপ্লেক্স বলে চালিয়ে দেন। কিন্তু পরিবেশ ও স্থানের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে জঁ রিনডি এই কাজটা করে দেখিয়েছেন সুচারুভাবে; তাও আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে। স্থাপত্যের কবির মতো তুলি ছুঁইয়েছেন স্থাপনার চার দেয়ালের মাঝে। সার্কুলেশন থেকে শুরু করে ফাংশনের সন্নিবেশ, যা খুব সাধারণ এক ফর্মকেও করে তুলেছে অসাধারণ। মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত স্থপতি জঁ রিনডি নিজেকে স্থাপত্যকলার জন্য উৎসর্গ করেছেন। যার ফলসরূপ আমরা পেয়েছি কিছু অমর স্থাপত্যকলা, যা পৃথিবীর বুকে চির অম্লান করে রাখবে তাঁর নামকে।

সবুজে ঘেরা আইভরি স্যুর সিন

জঁ রিনডির গুরুত্বপূর্ণ সব কাজের মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য

  • ১৯৭০ সাল: école des Plants, Cergy-Pontoise
  • ১৯৭০-১৯৭২ সাল: অপারেশন ‘Danielle Casanova’ ভালডিমার্নিতে যা রেনে জেইলহোস্টেটের সঙ্গে একত্রে ডিজাইন করেছেন।
  • ১৯৭০-১৯৭৫ সাল: আইভরি স্যুর সিনে ‘Jeanne Hachette’ যাতে ছিল ৪০টি বাড়ি, দোকান, অফিস এবং সিনেমা হল।
  • ১৯৭৪ সাল: old Givors-এর রিনোভেশন কাজ। এতে ছিল ২৭০টি বাড়ি, দোকান, লাইব্রেরি, চার্চ ও থিয়েটার। সঙ্গে ছিল পুলিশ স্টেশনও।
  • ১৯৭৮-১৯৮৩: আইভরি স্যুর সিনের ‘cité du parc’, যাতে ছিল ১৪৭টি বাড়ি।
  • ১৯৭৯-১৯৮২: Einstein school in Ivry-sur-Seine

তাঁর কাজ ও স্থাপত্যকর্ম দিয়ে ফরাসি স্থাপত্যকলা তথা বিশ্ব স্থাপত্যে রেখেছিলেন কবিত্বের ছাপ। সেই ছাপ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে এ বিশ্ব। ১৯৮১ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন স্থাপত্যের মহান এ কারিগর। মরেও তিনি অমর হয়ে আছেন তাঁরই কাজের মাঝে।

স্থপতি রাজীব চৌধুরী

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top