নিত্যদিনকার জীবনযাপনের প্রয়োজনে চাহিদা অনুযায়ী পরিবেশ ও পরিসর সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই স্থাপত্য শিল্পের যাত্রা। মানুষের জীবনযাপনের বহুমাত্রিক প্রয়োজনীয়তার সাথে সাথে যোগ হয়েছে নানামুখী জটিলতা। বাসস্থান সৃষ্টির সীমিত গন্ডি পেরিয়ে স্থাপত্য শিল্প এখন মানুষের বহুমুখী ব্যবহারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অনুষঙ্গগুলোর উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। বাংলাদেশের স্থাপত্য নকশাও একই রকম মননশীল চাহিদা ও সংস্কৃতি থেকে বিকাশমান। এ ভূখন্ডে স্থাপত্যের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বগুড়ার মহাস্থানগড়ে। এর পর পাহাড়পুর, ময়নামতি, পানামনগরের হাত ধরে বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্প আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে। তৈরি হয়েছে স্থাপত্য বিষয়ক নানা প্রতিষ্ঠান। স্থাপত্য নকশা থেকে শুরু করে বিকাশমান স্থাপত্য শিল্পে সহায়তা, পরামর্শ দেওয়াই এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ। এ রকম একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপত্য অধিদফতর।
স্থাপত্য অধিদফতর নিয়ে কিছু কথা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপত্য অধিদফতর। স্থাপত্য অধিদফতর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নকশা প্রণয়ন ও স্থাপত্য শিল্পে সেবা প্রদানকারী দেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান শুধু স্থাপত্য নকশা, জরিপ নকশা, মাস্টার প্ল্যান, লে-আউট প্ল্যান ইত্যাদি প্রণয়নের কাজই করে না বরং সরকারি দফতর ও আবাসন খাতে স্পেস নির্ধারণ থেকে শুরু করে মানববসতি, ভূমি ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত নীতিমালা তৈরিতে সরকারকে পরামর্শ প্রদান এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি চাহিদা নিরূপণে সহযোগিতাও করে থাকে।

প্র্রতিষ্ঠানটির জনবল
স্থাপত্য অধিদফতর বর্তমানে প্রধান স্থপতিসহ মোট ২৭৭ জন জনবল নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জনবলে রয়েছে একজন অতিরিক্ত প্রধান স্থপতি, ছয়জন উপ-প্রধান স্থপতি, ১৬ জন সহকারী প্রধান স্থপতি, ৪৮ জন সহকারী স্থপতি এবং স্থাপত্য বিষয়ক অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ বিরাট সংখ্যক জনবল সঠিক, বৃহৎ ও বাস্তবমুখী প্রকল্পে সরকারের সহযোগিতায় কাজ করে চলেছে।
স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ অনুযায়ী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত সকল প্রকল্পের ‘অথরাইজড অফিসার’। দেশে ইমারত নির্মাণে প্রযোজ্য সকল আইন, বিধিমালা ও নীতিমালা ইত্যাদি যথাযথভাবে অনুসরণ করে প্রকল্পেও স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করে।
স্থাপত্য অধিদফতরের ইতিহাস
ব্রিটিশ সরকারের সময় থেকেই গণপূর্ত বিভাগের অধীনে ছিল স্থাপত্য অধিদফতর। স্থপতিদের স্থাপত্যগত কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করেই এ বিভাগের সূচনা হয়। প্রদেশের স্থাপত্যগত সব ধরনের কাজে সহযোগিতা করতেই এ অধিদফতর কাজ করত। এর পর অবশ্য প্রাদেশিক সরকারের সময় এটি সিভিআই অফিসের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৯৫০ সালে এ অধিদফতরের পাশাপাশি বিল্ডিং ডিরেক্টরেট এবং হাউজিং ও সেটেলমেন্ট ডিরেক্টরেট নামে আরো দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপত্য নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্যাচ এদের সাথে যোগ দেয়। আর ১৯৮২ সালে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে স্থাপত্য অধিদফতর একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে।

অধিদফতরের কাজের পরিধি
স্থাপত্য অধিদফতর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে স্থাপত্য বিষয়ে সেবাপ্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। উক্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তাদের অধীনস্থ দফতরের প্রকল্পসমূহের স্থাপত্য ও পরিকল্পনাগত নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব স্থাপত্য অধিদফতর পালন করে। এ বিষয়ে স্থাপত্য অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান স্থপতি শাহাদাত হোসেন জানান, ‘স্থাপত্য অধিদফতর মূলত সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থাপত্য নকশা থেকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি কাজ করে থাকে।’ তবে স্থাপত্য অধিদফতর সরাসরি জনগণের জন্য কোনো সুবিধা প্রদান করে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বিভাগ, কর্তৃপক্ষ, ব্যুরো ইত্যাদির মহাপরিকল্পনা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো, প্র্রকল্প প্রণয়ন, অফিস-আদালত, হাসপাতাল, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিলনায়তন, শিল্পকলা কেন্দ্র, স্মৃতিসৌধ, আবাসন, চিত্তবিনোদন সুবিধা, পার্ক, ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণ, সার্কিট হাউজ ইত্যাদির নকশা প্রণয়নের মাধ্যমে স্থাপত্য সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে।
কাজের ক্ষেত্রসমূহ
- প্রাথমিক স্থাপত্য পরিষেবাদি (বেসিক আর্কিটেকচারাল সার্ভিস), যার মধ্যে রয়েছে প্রকল্পস্থান নির্বাচন (সাইট সিলেকশন) এবং নির্মাণ প্রকল্পসমূহের পরিকল্পনা ও নকশার পূর্বে প্রকল্পস্থানগুলোর পূর্ববর্তী সরেজমিন প্রদর্শন ও আপাত জরিপ কাজ করা।
- প্রত্যাশী কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুসারে প্রকল্পের বিস্তারিত ভৌত চাহিদা নিরূপণ ও প্রয়োজনে সম্ভাব্য জমি নিরূপণে সহায়তা করা।
- প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা, প্রাথমিক স্থাপত্য নকশা, বিশদ স্থাপত্য নকশা, নিসর্গ পরিকল্পনা নকশা, প্রকৌশল সহায়ক নকশা, ভবন নির্মাণের কাঠামোর রূপরেখা ও নির্মাণ উপকরণের (চূড়ান্ত আবরক) স্পেশিফিকেশন করা।
- অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণস্থানের প্রয়োজনীয় তদারকি ও সমন্বয় সাধন করা।
- সরকারি দফতর ও আবাসনসমূহের জন্য স্পেস স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ সংক্রান্ত সমীক্ষা ও প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন ও বিভিন্ন প্রকল্পের ভূমি চাহিদা নিরূপণ।
- বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি সংস্থাকে তাদের নির্মাণ প্রকল্পের ভূমি চাহিদা নিরূপণসহ এগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা ও ডিজাইন সহায়তা দেওয়া।
- মানব বসতি ও ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনা সংক্রান্ত নীতিমালা সম্বন্ধে সরকারকে অবহিতকরণ।

স্থাপত্য অধিদফতরের কিছু প্রকল্প
- জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
- ভাসানী নভোথিয়েটার
- পাসপোর্ট ও অভিবাসন অফিস, আগারগাঁও, ঢাকা
- সমাজসেবা ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
- ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবন
- স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকারের বাসভবন
- সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ভবন
- প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ভবন
- সার্ক মেট্রোলজিকাল কেন্দ্র
- সমবায় ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
- পরিকল্পনা কমিশন ভবন কমপ্লেক্স
- বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভবন
- কর ভবন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
- শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল
- ঢাকা শিশু হাসপাতাল
- কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল
- বাংলাদেশ জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
- জাতীয় স্মৃতিসৌধ
- মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
- স্পার্সো ভবন, সাভার ও আগারগাঁও, ঢাকা
- বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমি
- হজ ক্যাম্প, আশকোনা, ঢাকা
- কেন্দ্রীয় পরিবহন পুল, ঢাকা
- ত্রাণ ভবন, মহাখালী, ঢাকা
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
- জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল প্রধান ভবন
- ৫০০, ৬০০, ৭০০, ৮০০, ১০০০, ১২০০, ১৫০০ ও ১৮০০ বর্গফুটের সরকারি ফ্ল্যাট
- বাংলাদেশ সচিবালয়
- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এনেক্স ভবন
- গণভবন
- ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন
- কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার মাস্টার প্ল্যান
- ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন
- অফিসার্স ক্লাব মেমোরিয়াল হল
- মিনিস্টার বাংলো
- বিচারপতির বাসভবন
- রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল
- সারা বাংলাদেশের জেলা কারাগার ও কেন্দ্রীয় কারাগার
- জেলা ও থানা ফায়ার সার্ভিস অফিস
- টেলিভিশন রিলে স্টেশন, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া
- সারা বাংলাদেশের জেলা ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিস
- এস. এম. সুলতান স্মৃতি কমপ্লেক্স, নড়াইল
- লালন একাডেমি, কুষ্টিয়া
- রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি মিলনায়তন, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
- বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে সৌধ ও কমপ্লেক্স, সমগ্র বাংলাদেশ
- চট্টগ্রাম কোর্ট ভবন
- জেলা জজ আদালত ভবন
- বেনাপোল স্থলবন্দর
- মুজিবনগর কমপ্লেক্স, মুজিবনগর, মেহেরপুর
- খোলাপাথর প্রকল্প, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
- শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বগুড়া
- জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, দিনাজপুর
- মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ফরিদপুর, কুমিল্লা
- ১০ শয্যার হাসপাতাল, সেন্ট মার্টিন
- ১০০ শয্যার আনসার ও ভিডিপি হাসপাতাল, শফিপুর, গাজীপুর
- ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজ, গজারিয়া, মুন্সীগঞ্জ
- সারা বাংলাদেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
- সারা বাংলাদেশের ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট
- মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম।

যোগাযোগের ঠিকানা
স্থাপত্য অধিদফতর
স্থাপত্য ভবন, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি, সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০।
৯৫৫৪৮৮-৯১, ৯৫৬৯০৯৮ (প্রধান প্রকৌশলী), ৯৫৫৫২৫৩
ইমেইল : [email protected] [email protected] [email protected],
ওয়েবসাইট : www.architecture.gov.bd
জিয়াউর রহমান চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২