জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। যেখানে দেশি-বিদেশি পণ্যের হরেক রকম পসরা সাজিয়ে বসেন আয়োজকরা। আর এ সব পণ্যকে মেলার স্টল, মিনি প্যাভিলিয়ন কিংবা প্যাভিলিয়নে সুন্দর ও নান্দনিকভাবে সাজিয়ে চমৎকার ডিসপ্লে করতে ব্যস্ত থাকেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা। বাণিজ্যমেলায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশও অংশ নেয়। রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের মানুষের মিলনমেলার এ উৎসবকে প্রতিবছর তাই সাজানো হয় নব আঙ্গিকে।
সকাল থেকে রাত অবধি মেলার মাঠে থাকে হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা। বাণিজ্যমেলার মাঠ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্টল, মিনি প্যাভিলিয়ন ও প্যাভিলিয়ন পূর্ণ থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়ে। মেলার সৌন্দর্র্য উপভোগ করার পাশাপাশি চলে কেনাকাটার ধুম। নজর কাড়ে নান্দনিক ডিজাইনে উপস্থাপন করা সব পণ্য। মেলায় ঢোকার মুখে প্রথমেই যা দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের নজর কাড়ে তা হলো মেলায় প্রবেশের প্রধান গেট। অভিনব ও বৈচিত্র্যময় ডিজাইনে নির্মিত প্রবেশ পথ ও প্রধান ফটক শুধু সৌন্দর্যবর্ধনই নয় বরং মেলার মাঠে দর্শনার্থীরা যাতে সুশৃঙ্খলভাবে প্রবেশ করতে পারে সে বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ডিজাইন করা হয়। সাথে যুক্ত করা হয় নিরাপত্তার সুব্যবস্থা। আর এ সবকিছুর মূলেই রয়েছেন মেলার আয়োজক ও এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা। শৈল্পিক ডেকোরেশন শ্রীবৃদ্ধির পাশাপাশি মেলার চারপাশের পরিবেশকে করে তোলে দারুণ মনোমুগ্ধকর। এ ছাড়াও মেলার প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়ন শুধু পণ্যের পসরা সাজানোর জন্যই নয় বরং এটি প্রতিষ্ঠানের সঠিক প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি ব্র্যান্ডিংয়ের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাণিজ্যমেলার বৈশিষ্ট্য
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) যৌথ আয়োজনে প্রতিবছর এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, তুরস্ক, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশও এতে অংশ নেয়। এখানে সাধারণত ৪০০-৫০০টি প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন ও স্টল থাকে। বাণিজ্য কেন্দ্রিক এ মেলার বড় চমক ইলেক্ট্রনিক পণ্য, কৃষি, মেশিনারি যন্ত্রপাতি, কসমেটিক্স, ফার্নিচার, গৃহস্থালি জিনিসপত্র, স্যানিটারি সামগ্রীর মতো দরকারি সব পণ্য। মেলায় রয়েছে কোম্পানিভেদে বিশেষ ছাড়।
সীমানা ও উচ্চতা
মেলার প্রতিটি মিনি প্যাভিলিয়ন, প্যাভিলিয়ন ও স্টলের জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা এবং উচ্চতা নির্ধারণ করা আছে। সাধারণত স্টলগুলো ১৫ ফুট বাই ২০ ফুট, মিনি প্যাভিলিয়ন ২৫ ফুট বাই ২৫ ফুট, প্যাভিলিয়ন ৫০ ফুট বাই ৫০ ফুট হয়ে থাকে। আর উচ্চতার দিক থেকে স্টল ৮”-১২”, মিনি প্যাভিলিয়ন ১২”-২০” ও প্যাভিলিয়ন ২০”-৫০” পর্যন্ত নির্ধারিত। মেলা মাঠের সামঞ্জস্য রক্ষার্থে সাধারণত এই নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে দিকটি চোখে পড়ে সেটি হলো মেলার সুউচ্চ টাওয়ার।
নির্মাণশৈলী
মেলার প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন ও স্টল নির্মাণ করার সময় যে বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটি হলো ফ্রেমিং তথা কাঠামোকে। মেলা যেহেতু এক মাসের জন্য তাই সাধারণত ফ্রেমিং এবং মূল কাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যয়ের দিকটাকে মাথায় রেখে কাজ করা হয়। সে ক্ষেত্রে কীভাবে, কত কম খরচে মজবুত কাঠামো তৈরি করা যায় এটি নিয়ে ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা করেন নানা জল্পনা-পরিকল্পনা। এ সব কাঠামো তৈরি করার সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লক্ষ রাখা হয় তা হলো নির্মাণ উপকরণের বর্জ্য যতটা কমানো যায়। কেননা পরবর্তীতে এ সব নির্মাণ সামগ্রীর অধিকাংশই আর কাজে লাগে না। মেলার কিছু কিছু প্যাভিলিয়ন দোতলা বা ডুপলেক্স ডিজাইনের হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে মেজেনাইন ফ্লোর ডিজাইনকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে যেহেতু সারাদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণা থাকে সেহেতু স্ট্রাকচার মজবুত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। নইলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকতে পারে। স্টল ও প্যাভিলিয়ন ডিজাইন করার সময় যথাযথ সার্কুলেশন স্পেস রাখা দরকার, তা না হলে পণ্যের ডিসপ্লের জায়গায় মানুষের সমাগমে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। অনেকে খরচ বাঁচাতে মিস্ত্রি ডেকে যেনতেনভাবে ডিজাইনের কাজটা সেরে ফেলেন। সে ক্ষেত্রে নানা ধরনের ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা একজন অভিজ্ঞ ইন্টেরিয়র ডিজাইনার অনেক খুঁটিনাটি বিষয়কে মাথায় রেখে কাজ করেন, যা একজন অনভিজ্ঞ লোকের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।

কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণ
বাণিজ্যমেলার মাঠে সর্বত্রই এখন আধুনিকতার ছোঁয়া। উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে নিত্যনতুন নির্মাণ সামগ্রী। এমন সব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে প্যাভিলিয়ন ও স্টলগুলো। দিন বদলের সাথে সাথে সব কিছুতে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। তাই প্রযুক্তির এ দৌড়ে পিছিয়ে নেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররাও। লোহা, রড, বাঁশ, বেত, কাঠ, বোর্ড, স্টিল, ইট, পাটখড়ি, গ্লাস, চট, মাটি, টাইলস, প্লাস্টিক, পারটেক্স, প্লাইউডসহ নানা ধরনের নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। রঙের ক্ষেত্রে এনামেল পেইন্ট, প্লাস্টিক পেইন্ট, ডুকো, বার্নিশ সবকিছুকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবে এমন সব কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালসের ব্যবহার অনেকটা প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন এবং বাজেটের উপর নির্ভর করে। বাজেট কম হলেও এর স্থায়িত্ব, গুণগতমান বা সৌন্দর্যে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের। এর পাশাপাশি নানা ধরনের প্রিন্ট এবং অত্যাধুনিক ডিজিটাল প্রিন্টিং মেলার প্যাভিলিয়ন ও স্টলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে কয়েক গুণ।
ডিজাইনের নান্দনিকতায়
স্টল ও প্যাভিলিয়ন ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পণ্যের সাথে মিল রেখে অনেক সময় ডিজাইন করা হয়। যেমন প্রতিষ্ঠানটি যদি কোনো জুসের হয় তাহলে স্টল বা প্যাভিলিয়ন একটি জুসের বোতলের আদলে তৈরি করা যেতে পারে। তেমনি জুতার কোম্পানির ক্ষেত্রে জুতার শেপে, টায়ারের কোম্পানির ক্ষেত্রে টায়ারের শেপে, গ্লাস কোম্পানি হলে গ্লাস হাউস বানানো যেতে পারে। মেলার মাঠের এ সব স্টল ও প্যাভিলিয়ন ডিজাইন করার সময় মূলত কম্পোজিশনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিউব, সিলিঘ্নের, সার্কেল, হাফ সার্কেল, ডোম, শিপ, প্লেন, বাস্কেট, ট্যাঙ্ক বিভিন্ন শেপে তৈরি করা যেতে পারে অংশগ্রহণকারীদের পছন্দমতো প্যাভিলিয়ন। স্টলের ক্ষেত্রে প্রবেশমুখটা খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ একটি স্টলের সাথে পাশাপাশি আরো অনেক স্টল থাকে বলে অনেক ক্ষেত্রে এর চারপাশ নিয়ে কাজ করাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না, যেটা প্যাভিলিয়নের ক্ষেত্রে সম্ভব। কোনো ফেব্রিক্সের ডিসপ্লে এবং সঠিক লাইটিংই একটি প্রোডাক্ট বা পণ্যকে পুরোপুরি উপস্থাপন করতে পারে। আলো-আঁধারির সুন্দর বিন্যাস পুরো পরিবেশকে করে তোলে রহস্যময়। নানা ধরনের লাইটের ব্যবহারের পাশাপাশি ফলস সিলিং ও হিডেন লাইটের ব্যবহার অনেক বেশি কার্যকর। কোন্ জায়গায় কোন্ ধরনের এবং কোন্ রঙের লাইট ব্যবহার করতে হবে সেজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার।
মেলায় সবুজের ছোঁয়া
সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে মানুষের চিন্তাভাবনা। সেজন্য মেলার মাঠের স্টল ও প্যাভিলিয়ন ডিজাইনের পাশাপাশি সাজসজ্জায় ইন্ডোর প্লান্টসের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির ফুলগাছ। যেহেতু মৌসুমটা শীতের তাই মাঠের সৌন্দর্যবর্ধনে ঘাস এবং নানা ধরনের ফুল গাছের দেখা মেলে মেলা প্রাঙ্গণে। অনেকে আবার নিজেদের স্টল এবং প্যাভিলিয়নের সৌন্দর্য বাড়াতে এবং প্রবেশমুখ ও চারপাশে ঘাসের সাথে গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা গাছ লাগিয়ে সবুজের আবহ আনার চেষ্টা করেন। এতে মেলা চত্ব¡র দেখতে যেমন সুন্দর লাগে তেমনি মন থাকে অনেক বেশি প্রফুল্ল ও সতেজ।
ঝরনা কৃত্রিমতায়
মেলার মাঠের নান্দনিক আরেকটি দিক কৃত্রিম ঝরনা। প্রতিবছরই মেলার মাঠে একটি-দুটি কৃত্রিম ঝরনা চোখে পড়ে। নানা রঙের পানির সাথে লাইটিংয়ের আলোয় রাতে মেলার মাঠ রূপান্তরিত হয় রূপকথার কল্পলোকে। মেলায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় জমে ওঠে সেই কৃত্রিম ঝরনা আর মায়াবী আলোকে ঘিরে। এ যেন শহরে বসে গ্রামীণ প্রকৃতির অপার আনন্দ উপভোগের অপূর্ব সুযোগ।

আলো-ছায়ার গল্প
আঁধার দূূর করতে আলোর জুড়ি নেই আর তাই আলোর স্নিগ্ধতাকে ফুটিয়ে তুলতে মেলার মাঠে দেখা যায় বিচিত্র ধরনের আলোর খেলা। মেলার মাঠ জুড়ে থাকে নানা ধরনের আলোর ঝলকানি। সুদৃশ্য এসব আলোর ব্যবহারে রাতে মেলার মাঠ পরিণত হয় আলো-আঁধারির মায়াবী রাজ্যে। ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। আলো চারপাশকে উজ্জ্বল করার পাশাপাশি প্রদর্শিত পণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুকেই উপস্থাপন করে চমৎকারভাবে।
ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে নিজ পণ্যের শৈল্পিক উপস্থাপনা ও কর্পোরেট ব্র্যান্ডিংয়ের সুবাদে ক্রেতাদের সামনে নান্দনিকভাবে তুলে ধরাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল উদ্দেশ্য।
- ফারজানা গাজী
সিইও অ্যান্ড চীফ ডিজাইনার
ফারজানা’স ব্লিস্
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩