বিল্ডিং কোডের কার্যকর প্রয়োগ

কোডের হালনাগাদকরণ

নির্মাণশিল্পে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মিত বিল্ডিং কোড সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিগত ২০ বছরে কোডটির কোনো বিষয় হালনাগাদ করা হয়নি বা করা যায়নি! অবশেষে সম্প্রতি এটির হালনাগাদের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০১০ সালে বুয়েটের ব্যুরো অব রিচার্স অ্যান্ড টেস্টিংয়ের (বিআরটিসি) তত্ত্বাবধানে কাজটি শুরু হলেও বুয়েটের শিক্ষকদের সময়াভাবে কাজটি সম্পাদনে অনেক সময় লেগে যায়। সংশোধিত কোডে আগের মতো ১০টি চ্যাপ্টার রয়েছে, তবে প্রায় ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের নির্মাণক্ষেত্রে নব আবিষ্কৃত সূত্রাবলি, প্রযোজ্য বিধি-বিধান, টেকসই নির্মাণসামগ্রী ও অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন পর্যায়ে সন্নিবেশিত করে এটিকে একটি আধুনিক ও উন্নতমানের কোডে পরিণত করা হয়েছে। কোডটির যথাযথ কার্যকরণে এবার Code Enforcement Authority হিসেবে একটি Building Regulatory Authority সংক্ষেপে ‘বিআরএ’ (BRA) প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। ‘বিআরএ’ প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ে যেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে (যেমন ঢাকায় ‘রাজউক’, চট্টগ্রামে ‘চউক’, খুলনায় ‘খুউক’, রাজশাহীতে ‘রাউক’) সেখানে এসব সংস্থার অধীনে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে (জেলা, পৌর কর্তৃপক্ষ, উপজেলা) পর্যায়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর বা স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীদের বিল্ডিং অফিশিয়াল (Building Official) হিসেবে নিয়োজিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

বিগত ২১-২৩ মার্চ, ২০১৩ তারিখে বুয়েটে বিএনবিসি হালনাগাদকরণের ওপর চ‚ড়ান্ত কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কোডে সংযোজিত বিভিন্ন ধরনের নতুন প্রস্তাবনার ওপর হয় নানামুখী আলোচনা। ওঠে বহুতল ভবনের সংজ্ঞা ও উচ্চতার প্রসঙ্গ। স্থপতি-প্রকৌশলীরা এখন আর ২০ মিটার বা ছয়তলা-ঊর্ধ্ব ভবনকে বহুতল ভবন বলতে রাজি নন! কিন্তু ফায়ার ব্রিগেডের কাছে ছয়তলা ভবনের ওপরে অগ্নিনির্বাপণের যন্ত্রপাতি নেই, কাজেই বহুতল ভবনের সংজ্ঞা আগের ধারণায় থাকা ভালো। তা ছাড়া কোডটির কার্যকরণে অনেকে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প সাংগঠনিক কাঠামোর কথাও বলেন। তবে সবাই একমত যে ইজঅ বা যেকোনো একটা উপযুক্ত সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকে বিএনবিসির যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং সবাই নিয়মিত কোডের হালনাগাদকরণের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। 

একটি পরিকল্পত নগর নকশাচিত্র

আইন ও সংশ্লিষ্টদের দায়বদ্ধতা

‘নির্মাণ’ আর ‘প্রকৌশল’ শব্দ দুটি পরস্পরের পরিপূরক। সভ্যতার শুরু থেকে প্রকৌশলীরা  নির্মাণশিল্পের পেছনের কারিগর। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, দেশের অপরাপর নগর ও পৌর এলাকায় ইমারত নির্মাণ নিয়ন্ত্রণে ইমারত নির্মাণ আইন জারি করা হয়। আইনটির উদ্দেশ্য ছিল পরিকল্পিত উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এ রকম এলোপাতাড়ি ইমারত নির্মাণ প্রতিরোধ ও অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও বিধি-বিধান অনুসারে ইমারতের নকশা অনুমোদনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। কিন্তু আইনটিতে কোনো কিছুর নির্মাণের জন্য অনুমোদন গ্রহণোত্তর তা স্থপতি-প্রকৌশলী বা কারিগরি জনবলের তত্ত্বাবধানে করতে হবে এ রকম কিছুর সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। ফলে দেশে ইমারত নির্মাণ আইন বলবৎ থাকা সত্তে¡ও রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র এখনো আগের মতো ইমারত নির্মিত হচ্ছে। অবশ্য ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড প্রণয়নের পর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অপরাপর বিভাগীয় শহরগুলোতে যেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে, সেখানে এখন সচেতন নগরবাসী স্থপতি-প্রকৌশলীদের কম-বেশি সহায়তা নিচ্ছেন। কিন্তু বিভিন্ন উন্নয়ন বা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষসমূহের দুর্বলতা (যেমন- জনবলের স্বল্পতা, কারিগরি দক্ষতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপ ইত্যাদি), আবার অনেক ক্ষেত্রে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা (মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্ব-স্ব নিয়ম/বিধিতে নকশা অনুমোদন, ড্যাপ অনুসরণ না করা ইত্যাদি) এবং সমন্বয়হীনতার কারণে আইন ও বিধি-বিধানের যথাযথ কার্যকরণ, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে স্থপতিরা বিধি-বিধান অনুসরণ করে নকশা প্রণয়ন করে অনুমোদন গ্রহণ করলেও নির্মাণকালে মালিকের চাপে বা যোগসাজশে (!) বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ইমারত নির্মাণ সহায়তায় বাধ্য হন আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকৌশলীরা মালিক বা ডেভেলপারদের কাছে একরকম ‘জিম্মি’ বলা যায়! 

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে একটা নিরাপদ ভবন বা ভালো কিছু করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার। তন্মধ্যে মালিকের সদিচ্ছা সর্বাগ্রে। একজন মালিক বা ডেভেলপার চাইলেই নিরাপদ ইমারত নির্মাণ করা সম্ভব। বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে ইমারত নির্মাণের আগে বিবেচ্য ভূমির ব্যবহার অনুযায়ী নকশা প্রণয়ন করতে হয়। যেকোনো ইমারতের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব স্থপতির ওপর। এ জন্য জমির মালিক বা ডেভেলপারকে নিবন্ধিত স্থপতির সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, লোভী মালিক বা ডেভেলপারদের সঙ্গে স্থপতিদের একধরনের আঁতাত হয়! যে কারণে দেখা যায়, স্থপতিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেকোনো ইমারত নির্মাণের জন্য দুটি নকশা করেন। তন্মধ্যে প্রথমটি অনুমোদন লাভের জন্য আর দ্বিতীয়টি প্রকৃত নির্মাণের জন্য। এসব ক্ষেত্রে প্রকৌশলীরা প্রচলিত নিয়মে অসহায়! কারণ স্থপতিরা যে নকশা দেন, প্রকৌশলীরা সে অনুযায়ী কারিগরি ডিজাইন করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখন স্থপতিরা ভিন্ন কথা বলেন, আর দোষ হয় প্রকৌশলীদের। অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি করে ইমারত নির্মাণে স্থপতিরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও বরাবর তাঁরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই একজন স্থপতি যদি আন্তরিকভাবে চান, তাহলে এ ধরনের অনৈতিক কাজ অর্থাৎ বিধি-বিধানবহির্ভূতভাবে ইমারত নির্মাণ রোধ করা অবশ্যই সম্ভব। প্রণীত বা অনুমোদিত নকশা মোতাবেক ইমারত নির্মিত না হলে তা তাঁরা সংশ্লিষ্ট স্থপতি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু স্থপতিরা এই দায়িত্ব পালন করেন না। ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা এবং বিল্ডিং কোডে এ ব্যাপারে স্থপতিকে যেকোনো ইমারতের নকশা প্রণয়ন ও অনুমোদন-প্রক্রিয়ায় বিশেষ দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। বিধিমালায় ইমারতের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব (Lead Technical Person) স্থপতিদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, প্লাম্বিং ও ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং ফায়ার সেফটি বিশেষজ্ঞ তাতে (নকশায়) সই করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাঁরা ডিজাইন করেন নির্মাণকালে তাঁদের সম্পৃক্ততা থাকে না। এতে বোঝা যায়, মালিক কিংবা ডেভেলপারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বা যোগসাজশে (?) স্থপতিরাই প্রথমে নকশায় পরিবর্তন আনেন। তাই পেশাজীবীরা বিশেষ করে নকশা প্রণয়নকারী স্থপতিরা যদি বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড অনুসরণে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সহজে কোনো ‘দুনম্বরি’ ইমারত নির্মাণ সম্ভব নয়। 

অনুমোদনহীন ধসেপড়া একটি ভবনের চিত্র

পেশাজীবীরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সহজে এভাবে কোনো ভবনধস হওয়ার কথা নয়। IEB ও IAB এর তালিকাভুক্তকালে পেশাজীবীরা স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের Code of Conduct  অনুসরণে অঙ্গীকারবদ্ধ হন, কিন্তু কিছু লোভী পেশাজীবীর অনৈতিকতায় তা দেশের সমগ্র পেশাজীবীকে সমালোচনার মুখে ফেলে। এটা সত্যি, এ ধরনের অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত পেশাজীবীদের কারণে ‘স্পেকট্রাম’, ‘ফিনিক্স’ ও ‘রানা প্লাজা’র ধস হয়েছে! এই প্রেক্ষাপটে  IEB ও IAB কর্তৃক প্রকৌশলীদের দেওয়া P.Engg এবং স্থপতিদের Practicing Certificate প্রদানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। কারণ, Non-Practicing কিছু প্রকৌশলী P.Engg গ্রহণ করে তাঁরা ইমারতের সব ধরনের কারিগরি ডিজাইনে স্বাক্ষর করতে পারেন। P.Engg গ্রহণ করেই একজন প্রকৌশলী যে ইমারত ডিজাইন ও নির্মাণ তদারকির জন্য উপযুক্ত হয়ে যান তা সঠিক নয়। একইভাবে কিছু স্থপতি নিজেরা ডিজাইন না করে ‘সহি বিক্রি’ করেন এবং এমনকি তাঁদের কেউ কেউ এখনো অসংখ্য নকশায় স্বাক্ষর করে প্রতিনিয়ত অনৈতিক কাজ করছেন। বিভিন্ন সময়ে রাজউক থেকে অনৈতিক কাজে জড়িত এমন স্থপতি-প্রকৌশলীদের সতর্ক করা সত্তে¡ও তাঁদের কেউ কেউ এখনো এ ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। 

ভবনধসে পতন লাটভিয়া সরকারের

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কত ইমারত ধসে পড়েছে, কতজন মারা গেছে, শেষ পর্যন্ত এ জন্য কারও শাস্তি হয়েছে কি না তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে, তখন কয়েক দিন মিডিয়ার ও সংশ্লিষ্ট লোকজন তৎপর হন কিছুদিন পর সবকিছু চাপা পড়ে যায়। রানা প্লাজাধসের ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সবার বড় ধরনের শাস্তি হবে, যাতে ভবিষ্যতে সবাই সতর্ক হবে এবং দেশে ভবনধস রোধে আইনগত ভিত্তি জোরদার হবে। না, এসবের কিছুই হয়নি। বরং ভবনটি ধসের পর যাদের বিভিন্ন অভিযোগে আটক করা হয়েছে, তাদের সবাই একে একে জেল থেকে বেরিয়ে আসছে বলে খবরে প্রকাশ! কারণ, এতদ্বিষয়ে রুজুকৃত মামলাটি নাকি খুবই দুর্বল এবং প্রয়োজনীয় সাক্ষী-সাবুদও পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে এসব কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই, যারা বিষয়গুলো দেখভাল ও মনিটর করবে। জাতীয় বিল্ডিং কোডের আওতায় নিয়োজিত Building Official কর্তৃক মামলা দাখিল করলে তা নিশ্চয় আইনের দৃষ্টিতে যথোপযুক্ত হতো। তাই দায়সারাভাবে Authorised Officer কর্তৃক দায়ের করা মামলাটি আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক! এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশও উপেক্ষিত! সরকার আসে যায়, এ নিয়ে কারও মাথাব্যথাও নেই। দেশের ‘Blamegame’-এর রাজনীতিতে রানা প্লাজাধসের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মতো দায়িত্বশীল একজন বলে বসেন, হরতাল পালনকালে বিরোধী দলের সমর্থকদের ‘নাড়াচাড়ায়’ রানা প্লাজা ধসে পড়েছে!  

একটি আধুনিক পরিকল্পত নগর নকশাচিত্র

এই অবস্থায় কদিন আগে খবরে প্রকাশ, লাটভিয়ায় একটি বাণিজ্যিক ভবনধসে ৫৪ জনের মৃত্যুতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগসহ সরকারের পতন ঘটেছে। লাটভিয়া, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার অঙ্গভুক্ত একটি দেশ, যেখানে আছে সুশাসন, সরকারের দায়বদ্ধতা। কিন্তু আমাদের দেশে এর সবকিছুর অনুপস্থিতিতে ইমারত ধসে পড়লে তা মালিক বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে চাপা পড়ে যায়। কোনো ইমারতধস বা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তার তদন্তের আগে মালিকের বক্তব্য হয়- ‘নরম মাটি’র কারণে (ধসের ক্ষেত্রে), আর অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে ‘শটসার্কিট’-এর কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। তা ছাড়া ‘নাশকতা’র দোহাই তো রয়েছেই। অনেকের মতে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই কথার কারণে (বিরোধী দলের সমর্থকদের নাড়াচাড়ায়) রানা প্লাজা সের মামলাটিতে সহজে কাউকে দায়ী করা যায় কি না সন্দেহ! এভাবে ‘তাজরীন’’ গার্মেন্টস ভবন পুড়ে অনেক শ্রমিক মারা গেলেও মালিকের কিছুই হয়নি। ‘স্পেকট্রাম’ ও ‘ফিনিক্স’ধসেও কারও কিছুই হয়নি। 

 পরিশেষে

১৯৯৩ সালে বিএনবিসি প্রণীত হওয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তরুণ বয়সে তখন খুব উৎসুক হয়ে কাজ করেছি। বিএনবিসির দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টারের (Construction Practice and Safety) এডিটরিয়েল কমিটিতে সদস্যসচিব ছিলাম। ভাগ্যচক্রে এটির হালনাগাদ করার সময় আবারও এর সঙ্গে আমি জড়িত। কিন্তু শুরুতে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের সিংহ ভাগই আজ নেই। এই প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতে কখন এটির হালনাগাদ হয়, কে জানে! কারণ, প্রথমবার হালনাগাদ করতে সময় লেগেছে ২০ বছর। প্রসঙ্গক্রমে, ২০০৬ সালে অনেকটা আমার একক প্রচেষ্টায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ধীরাজ কুমার নাথকে বুঝিয়ে ‘বিএনবিসি-২০১৩’-কে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করি। কোডটি গেজেটে প্রকাশিত হবে কি না, তা নিয়েও কিছু মানুষের মধ্যে দ্ব›দ্ব ছিল! যাক, গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার পর কীভাবে দেশের সর্বত্র এটির বাস্তবায়ন করা যায় ২০০৬-০৭-এর জাতীয় কর্মশালায় তার ধারণা দিই। কিন্তু বিগত সাত বছরে এর কোনো কিছুই কার্যকর হয়নি। উপেক্ষিত রয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ও।

ধারণা করেছিলাম, কোডটির আইনগত ভিত্তি থাকলে এটি যথাযথভাবে কার্যকর হবে, অবৈধ নির্মাণ রোধ হয়ে সবাই কোড অনুসরণে নিরাপদ বিল্ডিং বানাবে। এবারের কর্মশালায়ও অনেকে এসব বিভিন্ন বিষয়সহ বিল্ডিং কোডটির আদৌ কার্যকরণ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলেন? অনেকের প্রশ্ন ছিল, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিএনবিসি কার্যকর হবে কি না! ইজঅ প্রতিষ্ঠা করা হবে কি না? কারণ, আমাদের দেশে তো ভালো-খারাপ সবকিছু নিয়ে ‘রাজনীতি’ হয়। আর খুব কম ক্ষেত্রেই রাজনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মতৈক্য হয়! তথাপি আশাবাদী, বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ ও স্ব-স্বার্থ বিধায় নিশ্চয় দল-মতনির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ জান-মালের রক্ষার্থে আইন ও কোড মেনে নিজ নিজ ইমারত ও স্থাপনা নির্মাণে বিবেকবান হবেন। ‘রানা প্লাজা’ধস ও অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশের নির্মাণশিল্প এবং রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস উভয়কে নিয়ে দারুণ সমালোচনা চলছে। ‘জিএসপি’-সুবিধা স্থগিত আছে। 

একটি আধুনিক শহরের মডেল

ইমারত নির্মাণ আইনটিরও জরুরি সংশোধন প্রয়োজন। ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে আইনটি প্রণীত, যার অনেক বিধি সময়োপযোগীর দাবি রাখে। সচরাচর যেকোনো আইন প্রণীত হলে তা কার্যকরের জন্য আলাদাভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইমারত নির্মাণ আইনের বাস্তবায়নের জন্য আজ অবধি তা হয়নি। ফলে সমগ্র দেশের জন্য আইনটি প্রণীত হলেও অদ্যাবধি এটির কার্যক্রম শুধু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কয়েকটি সংস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঢাকার মহাপরিকল্পিনাভুক্ত এলাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের স্ব-স্ব আইনে নকশার অনুমোদিত হচ্ছে। রাজউকের বিধি-বিধানের সঙ্গে এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ইমারত নির্মাণ বিধিমালার মধ্যে মিল নেই। ফলে যে যার মতো নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণ করছে, যা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। আর নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবী ও ডেভেলপারদের অবশ্যই আইনের আওতায় দায়বদ্ধ হতে হবে। এ জন্য ‘বিআরএ’ প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তবে বিআরএ প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত জেলা, পৌর এলাকা, উপজেলা ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বিল্ডিং অফিশিয়াল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় নিয়োজিত সব অথোরাইজ অফিসারকে বিল্ডিং অফিশিয়াল হিসেবে নিয়োজিত করা যায় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবশ্যই ইমারত নির্মাণ আইন ও বিএবিসি অনুসরণে তাদের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বাধ্য থাকতে হবে। মোটকথা, দেশজুড়ে নিরাপদ ইমারত নির্মাণ তথা টেকসই নির্মাণশিল্পের স্বার্থে সরকারকে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে, অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে।

মো. এমদাদুল ইসলাম

প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৬ তম সংখ্যা, ফেবু্রুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top