পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রড, সিমেন্ট, কংক্রিট দিয়ে তৈরি বিম-কলামের ফ্রেমই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এক শ বছর আগেও কিন্তু ভবন তৈরির অবকাঠামোর গঠনপ্রণালি এমন ছিল না। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে ভবন তৈরি করা হতো চুন-সুরকি ও পাথরের সমন্বয়ে। তখনকার দিনে বর্তমানের মতো রেইনফোর্সমেন্ট রডের প্রচলন ছিল না। কংক্রিট ভবনে মূলত বিম-কলামই সব ধরনের বল বহন করে। রেইনফোর্সমেন্টের সমন্বয়ে তৈরি এসব বিম কলাম যতটা মজবুত আমাদের ভবনও ঠিক ততটাই ভালো। কংক্রিটের ফ্রেম ভবনে ইটের যে দেয়াল ব্যবহার করা হয় তা মূলত ননস্ট্রাকচারাল মেম্বার। এ ধরনের দেয়াল সাধারণত বাইরের পরিবেশ থেকে দালানকোঠার অভ্যন্তরকে রক্ষা করে মাত্র, এ ছাড়া দালানকোঠায় অভ্যন্তরের জায়গা ভাগও করে। যদিও ভূমিকম্পের সময়ে এই ইটের তৈরি ইনফিল ওয়াল (Infill Wall) যথেষ্ট ভূমিকা রাখে, তবে ভবন ডিজাইন করার সময় সাধারণত এই ইটের দেয়ালের বৈশিষ্ট্য হিসাব না করেই ডিজাইন করা হয়।
আমাদের দেশে ভবন ডিজাইন করার সময় অত্যন্ত প্রচলিত বিষয় হচ্ছে ইটের তৈরি দেয়ালে শুধুম ভার হিসাব করে ডিজাইন করা হয়। ভূমিকম্প বলের মতো আনুভূমিক বলের ক্ষেত্রে এই ওয়ালগুলো বাস্তবে যে ধরনের ব্যবহার করে তা ডিজাইনে উপেক্ষা করা হয় প্রায়ই। যার ফলে দেখা যায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় এ ধরনের কাঠামো চাহিদা অনুযায়ী আচরণ করে না। ভবন তৈরির প্রকৌশল বিদ্যায় ইটের তৈরি ইনফিল ওয়াল মডেল করার জন্য বিম-কলামের কংক্রিটের বৈশিষ্ট্য হিসাব করার মতো অতটা সহজ নয়।

সাধারণত বহুল প্রচলিত কমার্শিয়াল সফটওয়্যারগুলো দিয়ে ভবন ডিজাইন করা হয়, সেগুলো দিয়ে মেশোনারি ইনফিল ওয়াল (Masonry Infill Wall)-এর প্রকৃত আচরণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এ কারণে ভবন এর মধ্যে ইটের কেমন আচরণ করে সেটা যাচাই করা দরকার। ইটের তৈরি ইনফিল ওয়ালের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে দেয়ালের মধ্যে যে সিমেন্ট মর্টার ব্যবহার করা হয়, তা সব জায়গায় সমানভাবে থাকে না। তা ছাড়া কারুকাজের ভিন্নতার কারণে আচরণও হয় ভিন্ন। অতীতে ভূমিকম্পের সময় মেশোনারি ইনফিল ওয়ালের বৈশিষ্ট্য কেমন হয়, এ ধরনের গবেষণা অনেক হয়েছে। এক মেশোনারি ইনফিল ওয়াল ল্যাবরেটরিতে ও মডেল করে যাচাই করে দেখা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আনুভূমিক বলের মাত্রা কম থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফ্রেমের মধ্যে মেশোনারি ওয়াল সমন্বিতভাবে আচরণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে মেশোনারি ওয়াল থাকার কারণে ফ্রেমের বিল্ডিংয়ে প্রাথমিকভাবে দৃঢ়তা অনেক বেশি থাকে। পরে আনুভূমিক বল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দৃঢ়তা কমতে থাকে।
আমাদের এ অঞ্চলের ইট কিংবা পাথরের তৈরি দালানকোঠার প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। মূলত মোগল সাম্রাজের সময়কাল থেকেই জমিদার রাজা বাদশা উচ্চবর্গীয় মানুষেরাই কেবল দালানকোঠা তৈরি করার মতো বিত্তশালী ছিল। মোগল আমল কিংবা পরে ইংরেজ শাসনকালী তৈরি হয়েছিল আমাদের দেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ। আর এ ধরনের স্থাপনা তৈরিতে তখনকার দিনে ভবন তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো চুন-সুরকি এবং বড় সাইজের পোড়ানো মাটির ইট। আর ছাদের কংক্রিটের সঙ্গে থাকত লম্বালম্বিভাবে সারিতে বিছানো পুরোনো রেললাইনের পাত। জানালা দরজার ওপরে থাকত আর্চ টাইপের ইটের বিন্যাস। তখনকার দিনে রেইনফোর্সমেন্ট না থাকায় এ ধরনের কারুকাজে ভবন তৈরি করা হতো। আর্চ টাইপের বিন্যাসের কারণ ছিল কম্প্রেসন ক্রিয়ার সমন¦য়ে ওপরের অংশের ভার বহন করার, বর্তমানে যেটি সাধারণ ইটের তৈরি মেশোনারি ক্রিয়ার সমন¦য়ে ভবনে লিন্টেল (Lintel) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলন হয় ইট ও সিমেন্টের গাঁথুনিতে বর্তমান যুগের মেশোনারি ভবন, যেখানে লিন্টেল এবং কংক্রিটের ছাদের মধ্যে ছাড়া আর কোথাও রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হয় না। এ ধরনের ভবন যদিও ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও এ ধরনের ভবন আমাদের দেশ এবং বিশ্বে বহুল প্রচলনের কারণ ভবন তৈরির খরচ তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট কম।
পরে সময়ের বিবর্তনে প্রচলন হয় বিম-কলামের রেইনফোর্সমেন্ট কংক্রিট, যা বহুতল ভবন তৈরির জন্য দারুণ উপযোগী। আর বিম-কলামের ভবনের মধ্যে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত হয় ইটের তৈরি ইনফিল ওয়াল। আর এই ইনফিল ওয়ালসমূহ উচ্চমাত্রায় দৃঢ় ও শক্তিশালী হয় এবং বিম-কলামের প্যানেলে আনুভূমিক বল প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ ধরনের ইনফিল ওয়াল উপাদানের বৈশিষ্ট্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যথেষ্ট ভিন্ন ভিন্ন হয়। এর কারণ একেক অঞ্চলের কাঁচামাল বা মাটির মধ্যকার প্রকৃতি এক নয়। আমাদের দেশের বাড়িগুলো পোড়ানো মাটির ইটের তৈরি, এগুলোর দৃঢ়তা ভিন্ন এবং প্রকৃতি ভঙ্গুর হয়। এ ধরনের ইটের সমন্বয়ে তৈরি করা ইনফিল ওয়ালের চরিত্র সঠিকভাবে নিরূপণ করার জন্য অতীতে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। কোথাও মেক্রো মডেল ব্যবহার করা হয়েছে।

পূর্বে যেসব মডেলিং ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে ইনফিল প্যানেল বরাবর Diagonal Strut মডেল সর্বাধিক ব্যবহৃত। এর কারণ সহজভাবে Diagonal Strut মডেল সহজে তৈরি করা যায় এবং তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য। Diagonal Strut মডেল হিসেবে আবার অনেক ধরনের Strut মডেল প্রচলিত আছে। বিল্ডিং ডিজাইন সহজভাবে করার জন্য Equivalent বা সমতুল্য Strut মডেল বলতে মূলত ইনফিল ওয়ালের উপাদানসমূহ ব্যবহার করে দেয়ালের কোনাকুনি বরাবর Strutহিসাব করা হয়। আমরা মেশোনারি ইনফিলের ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক্যাল Finite element মডেল ব্যবহার করি সেটা শুধু Liner আচরণের জন্য ভালো। Elastic limit-এর মধ্যে ব্যবহৃত মডেলসমূহ Non-liner আচরণকে প্রকাশ করতে পারে না। এ কারণে Strut মডেলের মাধ্যমে Non-liner আচরণ যুক্ত করা হয়।
যদিও মেশোনারি ইনফিল সাধারণত ননস্ট্রাকচারাল মেম্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং দৃঢ়ভাবে প্রধান বিম-কলাম ফ্রেমের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যার ফলে আনুভূমিক ভূমিকম্পের বলের ক্ষেত্রে মেশোনারি ইনফিল ওয়াল বিম-কলামের সঙ্গে যুক্তভাবে কম্পমান স্ট্রাকচারাল সিস্টেম হিসেবে কাজ করে। এর ফলে, বিম-কলামের সঙ্গে ইটের দেয়ালে সংযুক্তি অংশে মেশোনারি ওয়ালের প্রভাব সম্পূর্ণ স্ট্রাকচারের ওপরে পড়ে। এই ইটের দেয়াল থাকার কারণে বিল্ডিংয়ের ভূমিকম্পের সময়কালীন আচরণ সম্পূর্ণভাবে বদলে যায় এবং ডিজাইন করার সময় অবশ্যই এই ইটের দেয়ালের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হিসাব করা প্রয়োজন। একান্তে ডিজাইন এর সময় দুই ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়।
১. মেশোনারি ইনফিল সম্পূর্ণভাবে ননস্ট্রাকাচারাল পার্ট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ ক্ষেত্রে মূল বিম-কলাম ফ্রেমের সঙ্গে সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে এবং ভূমিকম্পজনিত বলের সময় এর প্রভাব থাকবে না।
২. মেশোনারি ইনফিল ভবনের স্ট্রাকচারাল প্রতিরোধের অংশ হিসেবে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে মেশোনারি ইনফিল ওয়ালের প্রভাবে যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয় তা বিল্ডিং ডিজাইন করার সময় হিসাব করতে হবে। এ ছাড়া বিম কলামের সঙ্গে দেয়ালের সংযোগস্থলের বিশদ বর্ণনা থাকতে হবে।
আবার বিম-কলামের সঙ্গে মেশোনারি ইনফিলের ফ্রেমের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের Failure Mechanism বিবেচনা করা হয়।
১. ইটের দেয়াল ও বিম-কলামে মধ্যে ফাটল ধরার আগে কিঞ্চিৎ পরিমাণে Deformation হয় এবং Deformation হওয়া পর্যন্ত বিম-কলাম ও মেশোনারি প্যানেল সংযুক্তভাবে একই ধরনের আচরণ করে।
২. ইনফিল ওয়াল বিম-কলামের সঙ্গে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ওই প্যানের Diagonal braced frame এবং ইনফিল ওয়ালের সম্বনিত অংশ হিসেবে কাজ করে।
সাধারণত ভূমিকম্পরোধ ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য দ্বিতীয় Failure কৌশলটা বিবেচনা করা হয়, যেখানে এখন পর্যন্ত Equivalent Diagonal Strut মডেল ব্যবহৃত হয়। এই Diagonal Strut-কে Compression মেম্বার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা প্রধান ফ্রেমের সঙ্গে Pin Support হিসেবে যুক্ত থাকে।

এই Diagonal Strut-এর পজিশন এবং মাত্রা Failure Mechanic-এর ওপর নির্ভর করে। এই Diagonal Strut উপাদানের বৈশিষ্ট্য Masonry-এর চরিত্রের মতো করে দেওয়া হয়। পরে Diagonal Strut প্যানেলের চরিত্র যাচাই করে বিল্ডিং ডিজাইন করা হয়।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত অনেক ধরনের Diagonal Strut ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও একটা, দুইটা কিংবা তিনটা Strut একই সঙ্গে রেখে একই প্যানেলে হিসাব করা হয়েছে। হবে প্রকৌশলীদের মধ্যে এ ধরনের মডেলের বাস্তবিক আচরণের সঙ্গে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ১৯৯৭ সালে আর্জেন্টাইন প্রকৌশলী Crisafulli কর্তৃক প্রবর্তিত Strut মডেল অন্যতম গ্রহণযোগ্য মডেল। পরে SeisnoStruct সফটওয়্যারের মডেল হিসেবে ২০০৫ সালে প্রকৌশলী Blandon-এর Non-linear Infill Panel প্রকাশ করে। এই প্যানেলটি ছয়টি Finite Element Strut (চিত্রের মতো), যার মধ্যে দুইটি করে সমান্তরাল Strut দেয়ালের কোনাকুনি বরাবর থাকে এবং তৃতীয়টি ওপর থেকে নিচ বরাবর Shear Load বহন করে। এই তিনটি করে Strut দুই দিকে থাকে এবং শুধু কমপ্রেশনের সময় এটি কার্যকর থাকে। কোনাকুনিভাবে Diagonal Strut মডেল Axial বল বহন করে এবং Masonry Hysteresis মডেল ব্যবহার হয়। অপর দিকে Shear Strut ব্যবহার হয় Bilinear Hysteresis নীতির ভিত্তিতে।
চিত্রে Seisno Struct সফটওয়্যারে তৈরি কংক্রিটের ফ্রেমের মাঝে Masonry Infill Strut মডেল দেখানো হয়েছে। ইটের দেয়াল থাকা এবং না থাকা দুই অবস্থাতেই মডেলের বৈশিষ্ট্য যাচাই করে দেখা গেছে যে ফ্রেমের মধ্যে ইটের দেয়াল থাকলে প্রাথমিক অবস্থায় আনুভূমিক বলের বিপরীতে ইটের দেয়াল ফ্রেমের সঙ্গে দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে আনুভূমিক বল প্রতিরোধ করে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আনুভূমিক বল বৃদ্ধি পেলে মেশোনারি ইনফিলের কারণে কলামের প্রান্তে দেয়ালের সংযোগস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কাঠামোকে দুর্বল করে তুলতে পারে। এ কারণে ভবন তৈরির সময় কংক্রিটের ফ্রেমে ইটের তৈরি দেয়ালের ডিজাইনে যত্নবান হওয়া আবশ্যক।
– রামকৃষ্ণ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৬