রাস্তা নির্মাণে প্লাস্টিক বর্জ্য

আমাদের যাপিত জীবনে বড় একটা জায়গাজুড়ে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। উন্নয়নশীল দেশে ইদানীং প্লাস্টিকের বহুমুখী ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারে রাস্তা নির্মাণ। চাহিদার কারণে দেশে এখন অনেক প্লাস্টিক কারখানা গড়ে উঠছে, সেই সঙ্গে দিনকে দিন বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। প্লাস্টিক দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় না সত্যি কিন্তু এটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তদুপরি মাটিতে না মেশায় এটি নষ্ট হয় না। স্বভাবতই বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে থাকে এটি। প্লাস্টিক বর্জ্যকে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তবে তা কমিয়ে আনবে পরিবেশদূষণের হার। 

প্লাস্টিক বর্জ্য যখন নির্মাণ উপকরণ

শিল্প-বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকার শীর্ষে অবস্থান প্লাস্টিকের। সাশ্রয়ের প্রশ্নে কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্যাকিং, অটোমোবাইল, অবকাঠামো নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি সব জায়গায় ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিক। তবে এটি নির্ভর করে সুবিবেচনাপূর্ণ প্লাস্টিকের ব্যবহার তথা পুনর্ব্যবহারকৃত প্লাস্টিক বর্জ্যরে ওপর। সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশ আগ্রহের সঙ্গে রাস্তা নির্মাণে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য। নির্মাণ উপাদান হিসেবে এর ব্যবহার প্রধানত প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক সাশ্রয় এবং পরিবেশগত সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধান প্রধান মেট্রো শহরের রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিক। প্রতিবছর ভারতে কয়েক মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়।

প্লাস্টিক কংক্রিট নি‍র্মিত স্পো‍র্টস জোন

সাধারণত রাস্তা নির্মাণে মাটি, পাথর, এগ্রিগেইট, বালু, বিটুমিন, সিমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। গবেষকেরা হাইওয়ে নির্মাণে নির্মাণ উপকরণের প্রতিস্থাপক হিসেবে কী ব্যবহার করা যায় এ ব্যাপারে গবেষণায় নামেন। তাঁদের বিবেচনায় প্রথমেই আসে প্লাস্টিক বর্জ্যরে নাম। কেননা এটি পরিবেশদূষণ কমিয়ে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী। তা ছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী। আমাদের এখানে স্থানভেদে ছোট পরিসরের রাস্তায় নির্মাণ উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় মূলত পলিইথিলিন (PE), পলিপ্রপেলিন (PP), পলিসটিরিন (PS), বিটুমিন, এসফেল্ট ইত্যাদি থেকে। প্লাস্টিক সাধারণত ১০০-১৬০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় নরম হয়। এর মধ্যে পলিইথিলিন, পলিপ্রোপিলিন এবং পলিসটিরিন বিশেষ ভূমিকা রাখে। কারণ, নরম অবস্থায় এদের বন্ডিং ক্ষমতা খুব ভালো। ব্লেডিং করে নরম প্লাস্টিককে বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে রাস্তা নির্মাণের কোনো একটা স্তরে ব্যবহার করা হয়। এই মিশ্রিত প্লাস্টিক বর্জ্যে ভারতের মহারাষ্ট্রে এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, পণ্ডিচেরি, কেরালা এবং অন্ধ্র প্রদেশে রাস্তায় প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়েছে। ব্যবহৃত রাস্তাগুলোয় সাধারণত অধিক ভারবাহী যানবাহন চলাচল করে। এ ছাড়া এখানে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার তারতম্যের মাত্রাটা তুলনামূলকভাবে বেশি।

পলিমার-এগ্রিগেইট-বিটুমিন মিশ্রণ প্রণালি

  • পরিষ্কার শুষ্ক প্লাস্টিক বর্জ্য (যেমন- পরিত্যক্ত বহনযোগ্য ব্যাগ, ফিল্ম, প্লাস্টিক কাপ এবং থামোকল), যার সর্বোচ্চ পুরুত্ব থাকবে ৬০ মাইক্রোন। সেগুলো ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে (২.৩৬-৪.৭৫ মি.মি. সাইজের)। তবে পিভিসি (পলিভিনাইল ক্লোরাইড) এই পদ্ধতির জন্য সঠিক নয়।
  • একটি মিনি হট মিক্স প্লান্টে ১৬৫০ সে. তাপমাত্রায় এগ্রিগেইট উত্তপ্ত করা হয়।
  • টুকরো টুকরো উত্তপ্ত প্লাস্টিক মিশ্রণে স্থাপন করলে প্লাস্টিক ধীরে ধীরে নরম হয়ে ৩০-৬০ সেকেন্ডের মধ্যে এগ্রিগেইটের চতুর্দিকে প্লাস্টিকের প্রলেপ পড়বে, যা দেখতে অনেকটাই তৈলাক্ত।
  • গরম বিটুমিন (যা উত্তপ্ত করা হবে সর্বোচ্চ ১৬০ সে., যাতে বন্ডিংটা নিশ্চিত হয়) তাৎক্ষণিক মিশ্রণে যোগ করে ভালোভাবে মেশাতে হয়।
বিভিন্ন উপাদান সমৃদ্ধ কংক্রিট রেডিমিক্স ও এগ্রিগেইট, বিটুমিন ও পলিমারের মিশ্রণে রাস্তা নির্মাণপ্রক্রিয়া
  • মিশ্রণটির তাপমাত্রা যখন ১১০-১২০ সে. তখন তা রাস্তার কাজে ব্যবহার করে তাতে আট টন ক্ষমতাসম্পন্ন রোলারের সাহায্যে রাস্তা সমতল করতে হয়। যেহেতু উত্তপ্ত প্লাস্টিকের তাপমাত্রা ১৬৫ সে. থাকে, সে জন্য সেখান থেকে কোনো প্রকার গ্যাস উদ্গিরণ হয় না। যখন ২৭০ সে. তাপমাত্রায় মূল উপাদানগুলো পৃথক হয় এবং ৭৫০ সেন্টিগ্রেডের ওপর পুড়ে যায় তখন তা ক্ষতিকর গ্যাসে পরিণত হয়।

মিশ্রণের গুণাগুণ বাড়াতে

  • ১০-১৫% ওজনবিশিষ্ট বিটুমিনে এগ্রিগেইটের ওপর প্লাস্টিক কোটিংয়ের মিশ্রণের ফলে বাইন্ডিং ক্ষমতা ভালো হয়।
  • বিটুমিনের সঙ্গে পলিমার অণুগুলোর অভ্যন্তরীণ সংযোগ নির্ভর করে উচ্চমাত্রা ও ধীরগতির প্রবেশের ওপর।
  • প্লাস্টিক প্রলেপের ওপর জলীয় বাষ্প শোষণের হার কমানো।
  • পৃথক হওয়ার প্রবণতা কম থাকে (৭২ ঘণ্টা পানিবন্দী থাকলেও এগ্রিগেইট থেকে প্লাস্টিক কোটিং খুলে যায় না)
  • উচ্চমাত্রায় কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ (>১০০ MPa) এবং উচ্চমাত্রায় ফ্লেক্সিবাল স্ট্রেন্থ (>৪৫০) বাইন্ডিং গুণাগুণের সঙ্গে তুলনীয়।
  • রাস্তা দ্বিগুণ শক্ত হয় সাধারণ রাস্তার তুলনায় এবং জলাবদ্ধতায় বাধা না পেলে।
  • ঠান্ডা অবস্থায় পেটানো যায় অর্থাৎ নমনীয় স্থিতিস্থাপক গুণ ভালো।
  • পলিমার মোড়কে বিটুমিন উচ্চ নমনীয় গুণসহ নরম মাটিতে সহজেই প্রবেশ করে। পলিমার কোটেট এগ্রিগেইট বিটুমিনে প্লাস্টিক বর্জ্যরে প্রলেপ খুলে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকায় মিশণটি রাস্তায় বিছানো সহজ।
  • রাস্তা তৈরিতে পলিমার-এগ্রিগেইট-বিটুমিন মিশ্রণ স্থাপন পদ্ধতি।

পলিইথিলিন, পলিপ্রোলিন এবং পলিসটিরিন থেকে তৈরি প্লাস্টিক বর্জ্য (ব্যাগ, কাপ, থার্মোকল) প্রথমে পরিষ্কার করতে হয়। এরপর সেগুলো ছোট ছোট টুকরো করে (যাতে ছাঁকনিতে ৪.৩৫ মিলিমিটার সাইজের বর্জ্য ভেদ করতে পারে) এগ্রিগেইট (গ্রানাইট) মিনি হট মিক্স প্ল্যান্টে ১৭০ সে. তাপমাত্রায় তাপ দিতে হয়। এতে প্লাস্টিক বর্জ্য নরম হয়ে এগ্রিগেইটের ওপর একটি প্রলেপ ফেলে। এরপর গরম বিটুমিন ১৬০ সে. তাপমাত্রায় এটির সঙ্গে ভালোভাবে মেশাতে হয়। যখন পলিমার এবং বিটুমিন গলিত অবস্থায় আসে তখন প্লাস্টিক মিশ্রণ প্রলেপ এগ্রিগেইটের ওপর পড়ে। এই মিশ্রণটিই রাস্তায় বিছাতে হয়।

প্লাস্টিক ব‍র্জ্য ও থা‍র্মোকলে নি‍র্মিত সংযোগ সেতু
  • পলিমার বর্জ্য আর বিটুমিনে তৈরি রাস্তায়
  • রাস্তার বিয়ারিং ক্যাপাসিটি দ্বিগুণ হয় সাধারণ রাস্তার তুলনায়।
  • পানি জমে না।
  • প্লাস্টিক বর্জ্য আগুনে পুড়িয়ে ফেলা পরিহার করা সম্ভব হয়।
  • বাড়তি কোনো মেশিনারির প্রয়োজন হয় না।
  • রাস্তা নির্মাণে খরচ কমে।
  • বিটুমিনাস রাস্তার ধরন 
  • বিভিন্ন ধরনের বিটুমিন রাস্তা আছে। এর মধ্যে
  • ঘন বিটুমিনাসসমৃদ্ধ ইট-সুরকি বিছানো কয়েক স্তরবিশিষ্ট রাস্তা।
  • বিটুমিনাসসমৃদ্ধ ইট-সুরকির স্তরবিহীন রাস্তা।

এই রাস্তাগুলোর ভিন্নতা তিন ধরনের-

  • এগ্রিগেইটের কম্পোজিশন
  • বিটুমিন ব্যবহারের ধরন
  • প্রলেপের পুরুত্বমাত্রা।

রাস্তা নির্মাণের জন্য বিটুমিন উত্তম বন্ডিং হিসেবে কাজ করে। বাজারে বিভিন্ন গ্রেডের বিটুমিন যেমন- ৩০/৪০, ৬০/৭০ এবং ৮০/১০০ পাওয়া যায়। এটা নির্ভর করে রাস্তায় বিটুমিন ঢালার পর তা কতটুকু অবধি প্রবেশ করছে। এসব গ্রেড নেওয়া হয় স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী। প্লাস্টিক বর্জ্য (বিটুমিনের স্থানে ১০%) ব্যবহার করা যেতে পারে বিভিন্ন ধরনের বিটুমিন রোড তৈরিতে। একটি সেমি বিটুমিনাস ২৫ মি.মি. কংক্রিট রাস্তায় (যা পূর্ব প্রস্তুতকৃত) বিছানোর জন্য যে যে উপাদান প্রয়োজন-

  • ১১.২৫০ টন (৬০/৭০ গ্রেডের) বিটুমিন।
  • ছোট ছোট টুকরোর প্লাস্টিক : ১০% ওজন অনুযায়ী। (৪.৭৪ মি.মি. ছাঁকনিতে ছাঁকার পর যাতে ২.৩৬ মি.মি. থাকে)।
  • এগ্রিগেইট (১১.২ মি. মিটার) = ৭০.৮৭৫ মিটার৩
  • এগ্রিগেইট ডাস্ট = ২৩.৬২৫ মিটার৩

সুবিধা যত

প্লাস্টিক বর্জ্যে তৈরি রাস্তা সাধারণ এসফেল্টসহ অন্যান্য মিশ্রণের তৈরি রাস্তা থেকে দীর্ঘস্থায়ী। প্লাস্টিকের বন্ডিং গুণাগুণের জন্য তৈরিকৃত রাস্তা বেশি দিন টেকে, যা অধিক ভারবাহী গাড়ি চলাচলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সনাতনভাবে তৈরি রাস্তা ভালোভাবে টিকে প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর। সে তুলনায় প্লাস্টিক বিটুমিনের রাস্তা টিকে ১০ বছর অবধি। বৃষ্টির পানি চুইয়ে ভেতরে প্রবেশে প্লাস্টিক বাধা দেয়। তাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় কম। সনাতন পদ্ধতিতে রাস্তা তৈরির চেয়ে প্লাস্টিক কোটেটেড নির্মিত রাস্তায় খরচ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু অপর দিকে এ ধরনের রাস্তা নির্মাণ-প্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধবও। এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছিল ভারতের কর্ণাটকের রাস্তায়। ভারত সরকার ইতিমধ্যে একটি ছোট প্লান্ট তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। যেখানে বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য মিশ্রণের প্লান্ট থাকবে রাস্তা নির্মাণে। আশা করা যায়, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে শক্ত, মজবুত রাস্তা তৈরি করে একে বৃষ্টির পানির ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে। এতে প্রতিবছর রক্ষণাবেক্ষণের খরচও কমবে। তা ছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্যরে হাত থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ।

ভিন্ন ভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে নি‍র্মিত রাস্তা

শেষের আগে

প্লাস্টিক বিটুমিনের গলনাংকের তাপমাত্রাকে বাড়ায়। ফলে উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু নির্মিত রাস্তার শক্তিকে বাড়াবে না, বাড়বে এর আয়ুও। পরিবেশকে সুন্দর রেখে সাশ্রয় করবে অর্থও। কেননা আমাদের এখানকার রাস্তা নির্মাণে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে প্রতিবছর রাস্তা সংস্কার বাবদ যে অর্থ খরচ হতো তার অনেকটাই বেঁচে গিয়ে লাভ হবে সরকারের।

  • প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ

সাবেক অতি. প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৬ তম সংখ্যা, ফেবু্রুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top