বিশ্বব্যাপী নির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে কংক্রিট সর্বাধিক ব্যবহৃত ও সবচেয়ে জনপ্রিয়। বর্তমানে বহুমুখী কাজে কংক্রিটের বহুল ব্যবহার প্রচলিত। কংক্রিট মূলত সিমেন্ট, বালু, পাথরের টুকরো ও পানির সংমিশ্রণে তৈরি, যাকে যেকোনো আকৃতি দেওয়া সম্ভব। এত সব সুবিধার পরও কংক্রিটের একটি অসুবিধার কথা বলতেই হবে আর তা হলো একবার এটি শক্ত হলে হারিয়ে ফেলে এর নমনীয়তা। আর এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি অভিনব নির্মাণসামগ্রী আবিষ্কারে সক্ষম হয় ‘কংক্রিট ক্যানভাস’ (Concrete Canvas) নামক এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। নাম যার ‘কংক্রিট ক্লথ’ (Concrete Cloth) বা কংক্রিটের কাপড়।
নির্মাণ ও পুরকৌশল শিল্পে কংক্রিট ক্লথের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। এটি অতি নমনীয় আর পানির সংস্পর্শে এটি পাতলা, টেকসই, পানি ও আগুন প্রতিরোধী কংক্রিট স্তর তৈরিতে সক্ষম। কংক্রিট ক্লথ কোনো প্রকার প্লান্ট বা মিশ্রণ যন্ত্র ছাড়াই নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম। শুধু প্রয়োজন ক্যানভাস স্থাপন ও পানি সংযোজন, এতেই জাদুর মতো কাজ হয়। কংক্রিট ক্লথের জীবনকাল ১০ বছরের বেশি। এ ছাড়া এতে নির্মাণকাজ হয় প্রচলিত কংক্রিটের তুলনায় অনেক দ্রুত ও কম খরচে।

কংক্রিট ক্লথের ইতিহাস
সা¤প্রতিককালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নতুন নির্মাণ উপাদান তৈরিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে, যা হতে হবে কাপড়ের মতো নমনীয় আর তার সঙ্গে যুক্ত হবে কংক্রিটের বৈশিষ্ট্য। আর এ গবেষণা করতে গিয়ে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি আবিষ্কার করে অভূতপূর্ব এক নির্মাণ উপাদান, যা কংক্রিটের ব্যবহারে সূচনা করে নব দিগন্ত, আর এর নামকরণ করা হয় ‘কংক্রিট ক্লথ’ বা কংক্রিটের কাপড়। বর্তমানে এই কংক্রিট ব্যবহৃত হচ্ছে আফগানিস্তানের সম্মুখভাগের প্রতিরক্ষা জোরদার করতে।
কংক্রিট ক্লথ বা কাপড়ের উদ্ভাবনের পেছনের ইতিহাসটা একটু অন্য রকম। প্রায় নয় বছর আগে উইল কের্ফার্দ ও ব্রায়ান ক্লার্ক হাওয়ার্ডের নেতৃত্বে গঠিত গবেষক দল ‘ব্রিটিশ সিমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ (British Cement Association) আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তখনো তারা ভাবতে পারেনি যে তাদের এই নতুন আবিষ্কার একটি নতুন কো¤পানি গঠনের প্রথম ধাপ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের গবেষণায় প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রাধান্য ছিল। এখন অবশ্য বহু ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হচ্ছে দারুণ জনপ্রিয়তায়।
কংক্রিট ক্লথের বৈশিষ্ট্য
সাধারণত তিন ধরনের কংক্রিটের ক্লথ বা কাপড় পাওয়া যায়, প্রতিটি স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে দেওয়া হলো :
শক্তি
উচ্চ সংকোচন ক্ষমতা কংক্রিট ক্লথের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাধারণ সংকোচন ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
এএসটিএম সি ৪৭৩ -০৭ অনুসারে :
– ১০ দিন পরে সর্বোচ্চ সংকোচন ক্ষমতা ৪০ মেগা প্যাসকাল (40 MPa)
– ১০ দিন পরে ইয়ংয়ের সংকোচন মাপাঙ্ক (Compressive Young Modulus) ১৫০০ মেগা প্যাসকাল (1500 MPa)
বিএস ইএন ১২৪৬৭:২০০৪ অনুসারে বেন্ডিং টেস্টে পাওয়া গেছে:
– ১০ দিন এ বেন্ডিং স্ট্রেস ৩.৪ (MPa)
– ১০ দিন পরে ইয়ংয়ের সংকোচন মাপাঙ্ক ১৮০ মেগা প্যাসকাল (180 MPa)
এএসটিএম সি ১৩৫৩-৮ অনুসারে:
– ১০০০ চক্রে (1000 cycle) কংক্রিটের ক্লথ বা কাপড়ের ক্ষয় মার্বেলের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম।
ব্যবহারের পদ্ধতি
কংক্রিট ক্লথ ব্যবহারের প্রক্রিয়া খুবই সহজ ও সাশ্রয়ী। কোনো প্রকার জটিল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। প্রথমেই যা করতে হয় তা হলো যেকোনো প্রকার কাঠামো; যেমন- তাঁবু বা এ জাতীয় কিছুর অবয়ব গঠন করে তার ওপর কংক্রিটের কাপড় বসিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি দিতে হয়। আর পানি শুকিয়ে গেলেই তৈরি হয়ে যায় আকর্ষণীয় ও অবাক করা সব স্থাপত্য। মজার বিষয় হলো কংক্রিটের কাপড় হাইড্রেসান হওয়ায় ব্যবহৃত পানি লবণাক্ত হলেও কোনো সমস্যা হয় না। ন্যূনতম পানি ও কংক্রিটের কাপড়ের ওজনভিত্তিক অনুপাত ১:২। কংক্রিটের কাপড় যাতে অতিরিক্ত হাইড্রেটেড না হয়ে যায় সে জন্য পানি পরিমাণে বেশি ব্যবহার করতে হয়। উত্তপ্ত পরিবেশে প্রাথমিকভাবে পানি দেওয়ার দুই থেকে চার ঘণ্টা পরে পুনরায় পানি ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

পানি ব্যবহার প্রক্রিয়ার রকমফের
– নিমজ্জিকরণ (Immersion): কংক্রিটের কাপড়কে পানিতে ৯০ সেকেন্ড পর্যন্ত চুবিয়ে রেখে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।
– ছিটানো (Spraying): কংক্রিটের কাপড় যতক্ষণ পর্যন্ত পানি দ্বারা শক্ত না হয় ততক্ষণ পানি ছিটাতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চ চাপযুক্ত পাইপ না ব্যবহার করা ভালো।
কংক্রিটের ক্লথের ব্যবহার
প্রায় সব জায়গায়ই কংক্রিটের ক্লথ বা কাপড় ব্যবহার করা যায়। যেমন-
নালার আস্তরণ (Ditch Lining): কংক্রিট ক্লথ বা কাপড় নমনীয় হওয়ায় খুব সহজে নালা-নর্দমার ঢালে আস্তরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ছবিতে ৩০ মিটার নালা দেখানো হয়েছে, যা কি না আস্তরণে আবৃত করা হয়েছে মাত্র ৪৫ মিনিটে।
ঢাল রক্ষা (Slope Protection): কংক্রিটের কাপড় নদী বা পাহাড়ের পাড় রক্ষা, ধারণকারী প্রাচীর (Retaining Wall), নিচু বাঁধ (Low Level Bunds) তৈরির সাময়িক বা স্থায়ী সমাধান হতে পারে।
পাইপলাইন রক্ষা (Pipeline Protection): কংক্রিটের কাপড় পানির ওপর বা নিচের পাইপলাইন রক্ষা, পাইপের ওপর পাথরের মতো শক্ত আবরণ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যায়। অনেক দূরে কোনো স্টিল পাইপলাইনে আবরণ দেওয়ার কাজে কোনো আলাদা ভেজা কংক্রিট প্লান্ট (Wet Concrete Application Plant) তৈরি করা ছাড়াই খুব কম খরচে কংক্রিটের ক্লথ বা কাপড়ের সহায়তায় একই কাজ সম্পন্ন করা যায়।
ভূমি পুনঃস্থাপন (Ground Resurfacing): কংক্রিটের কাপড় ব্যবহার করে খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়া রাস্তা বা ভূমি মেরামত করা যায়। এ ছাড়া রাস্তার পাশের পথচারী চলাচলের জায়গায় ব্যবহার করে অনেক দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে কাজ করা সম্ভব।
এ ছাড়া আরও অনেক কাজে ব্যবহার রয়েছে কংক্রিট কাপড়ের। শৌখিন শিল্পীদের জন্য এটি একটি নতুন শিল্প উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো কারুকার্যের কাঠামো তৈরি করে তাকে কংক্রিটের কাপড় পরিয়ে পানি দিলেই তৈরি হবে মনের মতো দারুণ সব ভাস্কর্য।

কংক্রিট ক্লথ বা কাপড়ের সুবিধা
- পানি ছিটিয়ে বা পানিতে চুবিয়ে রেখে খুব সহজে এটি ব্যবহার করা যায়। এর জন্য কোনো জটিল যন্ত্রপাতির দরকার নেই। আর একবার পানি প্রয়োগ করলে প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা যায়। এরপর এটি কার্যক্ষমতা (Workability) হারিয়ে শক্ত হতে শুরু করে, আর মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্জন করে ৮০ শতাংশ শক্তি।
- কংক্রিটের কাপড় নমনীয় হওয়ায় ইচ্ছেমতো আকার দেওয়া যায়।
- কংক্রিটের ক্লথ বা কাপড় অনেক শক্ত হয় আর যে কাপড় বা অ্যাশ (Fiber) ব্যবহার করা হয় তা এর ফাটল ধরা থেকে রক্ষা করে।
- কংক্রিটের কাপড় একটি সিরামিক বেসড উপাদান তাই এটি অগ্নি প্রতিরোধী।
- এর এক পৃষ্ঠে পিভিসির আবরণ থাকে বলে এটি পানি প্রতিরোধে সক্ষম।
- বর্তমানে কংক্রিটের কাপড় ১ দশমিক ২ মিটার (৪ ফুট) প্রস্থ রোলে সরবরাহ করা হয়, কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে ৫ মিটার (১৬ দশমিক ৪ ফুট) পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব। আর এর পুরুত্ব ৫ থেকে ২০ মিলিমিটার (০ দশমিক ২ থেকে ০ দশমিক ৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়।
- কংক্রিটের কাপড় রাসায়নিকভাবে স্থায়ী, তাই আলট্রাভায়োলেট রশ্মিতে এর কোনো ক্ষতি হয় না।
- এটি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।
সীমাবদ্ধতা
- কংক্রিটের কাপড় কখনোই অতিরিক্ত হাইড্রেটেড বা শুষ্ক হতে দেওয়া যাবে না, এ জন্য বেশি পরিমাণে পানি ব্যবহার করতে হবে।
- কখনোই উচ্চচাপযুক্ত পানির পাইপ ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এতে কংক্রিটের কাপড়ে যেকোনো একটি অংশের উপাদান ধুয়ে যেতে পারে।
- কংক্রিটের কাপড় এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাই কোনোভাবেই শক্ত হওয়া শুরু করার পর একে নাড়াচাড়া করা যাবে না।
- তপ্ত পরিবেশে এর কার্যক্ষমতা অনেক কমে যায়।
- যদি কংক্রিটের কাপড় সুসিক্ত না করা হয় তাহলে এটি জমাট বাঁধতে অনেক সময় নেয় আর সেই সঙ্গে এর শক্তিও কমে যায় অনেকাংশে।

শেষের আগে
মনে করুন, আপনার হাতে সময় অনেক কম কিন্তু খুব দ্রুত কোনো পাহাড়ি ঢাল রক্ষা করতে হবে বা বৃষ্টির সময় কোনো রাস্তা মেরামত করতে হবে কিংবা অন্য কোনো কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু প্রচলিত উপায়ে কংক্রিট ঢালাই দিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। এখন আর এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নেই। কারণ, কংক্রিটের ক্লথ বা কাপড় এসব সমস্যার কথা বিবেচনায় রেখেই উদ্ভাবিত হয়েছে। ভাবতে ভালোই লাগে, এখন আর কোনো প্রকার যন্ত্রপাতি বা ছাচ ছাড়াই কংক্রিটের সাহায্যে যেকোনো আকার-আকৃতির কাঠামো তৈরি করা সম্ভব। আর যেকোনো স্থানে সহজ বহনযোগ্যতার সুবিধার পাশাপাশি থাকছে না প্লান্ট স্থাপনের কোনো ঝক্কি-ঝামেলা। যদিও নব আবিষ্কৃত বিস্ময়কর এই নির্মাণ উপাদান এখনো সুলভ নয় কিন্তু আশা করা যায় খুব শিগগিরই এটি চলে আসবে সবার হাতের নাগালে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন কংক্রিট ক্লথের ব্যবহার হবে সর্বব্যাপী।
মো. নূর বাসিত জামান
প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪