ভূমিকম্প সহনীয় স্থাপনার বিম ও কলামে রডের বিন্যাস

ভূমিকম্প প্রতিরোধী কংক্রিটের বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়ই মনে করা হয়, বিম কলামের মধ্যে যত বেশি রড ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। রডের পরিমাণের চেয়েও অধিক জরুরি বিম কলামের মাঝে রডের বিন্যাস ও কোড অনুযায়ী পর্যাপ্ত রডের পরিমাণ নিশ্চিত করা। অবকাঠামোতে প্রকৌশল প্রযুক্তির নিয়ম মেনে যদি সঠিকভাবে রডের বিন্যাস করা যায়, তাহলে সহজেই কমানো সম্ভব ভূমিকম্প ঝুঁকি।

বর্তমানে আমাদের দেশে বিগত দশকে রড, সিমেন্ট, কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি অবকাঠামোর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ আর ভবন তৈরিতে এখন এগুলোই থাকে প্রথম পছন্দে। ভূমিকম্পের সময় ভবনের ওপর সাধারণত আনুভূমিকভাবে ভূমিকম্প বল ক্রিয়া করার ফলে ভবনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন শক্তিশালী কলাম ও কলামের চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল বিম; প্রকৌশল বিদ্যায় যা Strong Colum-Weak Beam নামে বহুল প্রচলিত। অর্থাৎ ভবনের মধ্যে বিম যতটা না শক্তিশালী হবে, তারচেয়েও বেশি শক্তিশালী হতে হবে এর কলামকে। কারণ, ভবনের কাঠামোয় বিমের মধ্যকার বল স্থানান্তিত হয় কলামে। আর এই বিম ও কলামের মধ্যকার মেইনফোর্সমেন্ট ভূমিকম্প সহনশীল করে তোলার জন্য রডের বিন্যাস পদ্ধতিই এবারকার আলোচ্য বিষয়।

বিমের মধ্যে রেইনফোর্সমেন্টের বিন্যাস
সাধারণত বিমে দুই ধরনের রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, লম্বালম্বিভাবে বিমের দৈর্ঘ্য বরাবর মোটা রড, যেটাকে মেইন রেইনফোর্সমেন্ট বলা হয়। দ্বিতীয়ত, মেইন রেইনফোর্সমেন্টগুলোকে ঘিরে থাকে ট্রানভার্স রেইনফোর্সমেন্ট বা Stirrup. আমাদের নির্মাণকাজে যেটা পরিচিত বিমের মধ্যে রিং নামে। সাধারণত বিম দুই ধরনের দুর্বলতাজনিত কারণে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমটিকে ফ্লেক্সারাল ফেইলুর (Flexural Failure) বলা হয়, যা দুইভাবে সৃষ্ট হতে পারে। যদি বিমের টেনশন ফেইস (Tension Face)-এ প্রয়োজনের তুলনায় অধিক রড থাকে। তবে ওই স্থানে কংক্রিটের মধ্যে আগে কম্প্রেশন (Compression) জনিত কারণে ফাটল ধরে কিংবা Crushing হয়। এ ধরনের ফেইলুরকে Brittle Failure বলা হয়, যা ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কাম্য নয়। অপর দিকে যদি রেইনফোর্সমেন্টের পরিমাণ টেনশন ফেইসে কম হয়, সে ক্ষেত্রে স্টিল রডের Yield প্রথমে হয় এবং প্রসারণ হতে থাকে বল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, এ ধরনের ফেইলুরকে ডাকটাইল ফেইলুর বলা হয়। আর এই ধরনের ডাকটাইল আচরণই ভূমিকম্প বলের ক্ষেত্রে ভালো, যাতে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সময় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুরোপুরি ভেঙে পড়ে না। চিত্র: ১-এ বিমের মধ্যে রেইনফোর্সমেন্টের বিন্যাস এবং চিত্র: ২-এ বিমের মধ্যে ফ্লেক্সারাল ফেইলুর ও শেয়ার ফেইলুর দেখানো হয়েছে। সাধারণত বিমের মধ্য বরাবর নিচের দিকে উলম্বভাবে ছোট সাইজের ফাটল দেখা যায়, তবেই সেটাকে ডাকটাইল ফেইলুর বলে। অপর দিকে শেয়ার ফেইলুরে একটি বিমের মধ্যে যদি টান্সভার্স রেইনফোর্সমেন্ট ভূমিকম্পের সহনশীল নীতিমালা অনুযায়ী বিন্যাস না রাখা হয়, তবে শেয়ার ফেইলুর হতে পারে। দুটি স্টিরাপ (Stirrup)-এর মাঝে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ফাঁক রাখা হলেও এটি হয়।

লম্বালম্বিভাবে রেইনফোর্সমেন্টগুলোর কাজ ফ্লেক্সারাল ফেইলুর প্রতিরোধ করা। যেহেতু বড় ভূমিকম্পের সময় বিমের ওপর কিংবা নিচে উভয় দিকেই এ ধরনের ফাটলের আশঙ্কা থাকে, তাই বিমের দুই দিকেই লম্বালম্বিভাবে মেইন রেইনফোর্সমেন্ট দরকার নির্মাণ কোডের নীতিমালা অনুযায়ী। কমপক্ষে দুটি করে মেইন রড সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য বরাবর বিমের ওপর ও নিচের বড় অংশে থাকতে হবে এবং বিমের প্রান্তের দিকে রেইনফোর্সমেন্ট পরিমাণ নিচের অংশে অন্তত ওপরের অংশের অর্ধেক হতে হবে।

বিমের মধ্যে অবস্থিত স্টিরাপ ভূমিকম্প প্রতিরোধে তিনভাবে কাজ করে-
শেয়ার ফেইলুর প্রতিরোধ করে আড়াআড়ি ফাটল রোধ করে।
কংক্রিটের মধ্যে ফ্লেক্সারের কারণে Blildging প্রতিরোধ করে।
মেইন রেইনফোর্সমেন্টগুলোর কম্প্রেশনের সময় Buckling প্রতিরোধে সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে।

বিমের মধ্যে ট্রান্সভার্স রেইনফোর্সমেন্ট বিন্যাসের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা আবশ্যক-

  • ১. মধ্যম থেকে বড় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে স্টিরাপের ব্যাস কমপক্ষে ৬ মিলিমিটার হতে হবে। যদি কোনো বিম ৫ মিটারের চেয়ে দৈর্ঘ্যে বেশি হয়, তবে তা কমপক্ষে ৮ মিলিমিটার হতে হবে।
  • ২. স্টিরাপের দুই প্রন্তে অবশ্যই ১৩৫ ডিগ্রি করে হুক বানাতে হবে এবং ব্যাসের দৈর্ঘ্য যথেষ্ট পরিমাণে থাকতে হবে, যাতে ভূমিকম্পের সময় হুকগুলো সহজে খুলে না যায়।
  • ৩. দুটি পাশাপাশি স্টিরাপের মধ্যে দূরত্ব অবশ্যই কোডের নিয়মানুযায়ী হিসাব করে বসাতে হবে।
  • ৪. দুটি স্টিরাপের মধ্যে সর্বোচ্চ দূরত্ব অবশ্যই বিমের গভীরতায় অর্ধেকের চেয়েও কম হবে এবং
  • ৫. বিমের প্রান্ত থেকে বিমের গভীরতার দ্বিগুণ পরিমাণ দূরত্ব পর্যন্ত স্টিরাপের ঘনত্ব বেশি থাকবে। এই অঞ্চলকে Critical অঞ্চল বলে এবং বিমের মধ্য অঞ্চলের চেয়ে দুটি স্টিরাপের মাঝে দূরত্ব হবে অর্ধেক।

সাধারণত একটি রেইনফোর্সমেন্টে দৈর্ঘ্য হয় ১২-১৫ মিটারের মতো। এ কারণে বিম বা কলামের মধ্যে রডের ওভার ল্যাপিং করাতে হবে। ল্যাপিংয়ের ক্ষেত্রে-

  • অবশ্যই কলামের প্রান্তের অংশ থেকে দূরে রাখতে হবে।
  • এমন জায়গায় করতে হবে, যেখানে বলের কনসেনট্রেশন বেশি হয় এবং অবশ্যই একই স্থানে ল্যাপিং করার সময় সর্বমোট মেইন রেইনফোর্সমেন্ট সংখ্যায় অর্ধেকের বেশি হতে পারবে না। আবার যেখানে ল্যাপিং হবে, সেখানে উলম্ব স্টিরাপের ঘনত্ব বেশি রাখতে হবে। চিত্র: ৪-এ বিমের মধ্যে স্টিরাপের বিন্যাস দেখানো হয়েছে।

কলামের মধ্যে রেইনফোর্সমেন্টের বিন্যাস
কংক্রিট ভবনের ক্ষেত্রে কলাম হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত বস্তু; কলামেও দুই ধরনের রেইনফোর্সমেন্টে থাকে- ১. লম্বালম্বিভাবে মেইন রেইনফোর্সমেন্ট কলামের দৈর্ঘ্য বরাবর থাকে এবং ২. মেইন রেইনফোর্সমেন্টগুলোকে ঘিরে থাকে ট্রান্সভার্স বার, যা আনুভূমিকভাবে কলামের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর বসানো থাকে। সাধারণত কলাম দুই ধরনের প্রতিরোধ করে থাকে, যা হচ্ছে Axial Flexural Failure I Shear Failure. দ্বিতীয়টিকে কলামের ক্ষেত্রে ভঙ্গুর আচরণের কারণ হিসেবে দেখা দেয় এবং অবশ্যই ভবনের ভূমিকম্পরোধী আচরণের ক্ষেত্রে কাম্য নয়। আর শেয়ারজনিত ক্ষতিরোধ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই অধিক পরিমাণে ট্রান্সভার্স রেইনফোর্সমেন্ট দিতে হবে।

ভারতের দিল্লীতে ভূমিকম্পে ভবনধ্বস। ছবি: স্প্রিঞ্জার

কলামে রেইনফোর্সমেন্টের বিন্যাস উপকরণ নির্বাচন (কংক্রিটের শক্তিমাত্রা, স্টিল রডের গ্রেড) কলামের ক্রস সেকশন এবং রেইনফোর্সমেন্টের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। কলামের প্রস্থ ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত রাখা যাবে, যদি কলামের দৈর্ঘ্য ৪ মিটার এবং বিমের দৈর্ঘ্য ৫ মিটার পর্যন্ত হয়। ভূমিকম্প বল প্রতিরোধে অবশ্যই শেয়ার ফেইলুর থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং দক্ষতার সঙ্গে কলামের মধ্যে রেইনফোর্সমেন্টের বিন্যাস করাতে হবে।

কলামের মধ্যে ভার্টিক্যাল বারস বা মেইন রেইনফোর্সমেন্ট আনুভূমিক টাইয়ের মাধ্যমে আটকে রাখতে হবে। এই ট্রান্সভার্স রেইনফোর্সমেন্ট শেয়ার ফোর্স প্রতিরোধ করে। টাইসের মাধ্যমে ভার্টিক্যাল বারস একসঙ্গে আবদ্ধ থাকে এবং বাইরের দিকে বক্র হওয়া থেকে কলামকে রক্ষা করে। এই বক্র হওয়াকে প্রকৌশলবিদ্যায় Buckling বলা হয়। এ ছাড়া টাই বারস কংক্রিটকে ধরে রাখে। এ কারণে ট্রান্সভার্স রেইনফোর্সমেন্টের প্রান্তে চিত্রের মতো ১৩৫ ডিগ্রি বাঁকা করে হুক বানাতে হয় এবং এই হুক থাকলে সহজে টাইয়ের লুপ খুলে যাবে না। সাধারণত ভূমিকম্প সহনশীল কলামের জন্য নিচের বিধিমালা রেইনফোর্সমেন্ট বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদিও বিভিন্ন ভবনের কোডভেদে কিছুটা ভিন্ন রয়েছে। তবে প্রায় সব কোডই মোটামুটি নিচের পদ্বতিতে বিন্যস্ত-
১. কলামের প্রান্তের অংশে টাই বারের পরিমাণ বেশি হবে এবং টাই স্পেসিং তুলনামূলক কম হবে। এই প্রান্ত অঞ্চলের দৈর্ঘ্য কলাম এবং বিমের সংযোগস্থল হবে i), ii) এবং iii) এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির সমপরিমাণ।
i. কলামের ক্রস-সেকশনের বড় ডাইমেনশন
ii. কলামের উচ্চতা ১/৬ অংশ পরিমাণ
iii. ৪৫০ মিলিমিটার
২. কলামের প্রান্তের অংশে টাই বারের স্পেসিং অবশ্যই D/4-এর চেয়ে বেশি হবে না যেখানে উ বলতে কলামে ক্রস সেকশনের ছোট দৈর্ঘ্যকে বোঝায়। এ ক্ষেত্রে এই টাই স্পেসিং সর্বনিম্ন ৭৫ মিলিমিটার থেকে সর্বোচ্চ ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত হবে। অন্যান্য জায়গায় স্পেসিং কোড অনুযায়ী হিসাব করতে হবে। তবে তা কোনোভাবেই D/2-এর বেশি হবে না।

যে ব্যাসের রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহৃত হবে হুকের দৈর্ঘ্য ওই ব্যাসের ১০ গুণের সমান হবে এবং তা কোনোভাবেই ২৫ মিলিমিটারের চেয়ে কম নয়। কলামের ল্যাপিং ক্ষেত্রের বিমের মতো স্পেসিংয়ের বিধিমালা মেনে চলতে হবে এবং টাই বারসগুলোর ঘনত্ব ল্যাপিং অঞ্চলে বেশি হবে। নির্মাণক্ষেত্রে সুন্দর এবং পরিচ্ছন্নভাবে তৈরি করা Construction Drawing-এ রেইনফোর্সমেন্ট বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োজন। কলাম ও বিমের রেইনফোর্সমেন্ট স্থাপনের সময় যত্নশীল হতে হবে, যাতে করে বিল্ডিং কোডে উল্লেখিত রডের বিন্যাস পদ্ধতি যথাযথভাবে স্থাপন করা যায়।

রামকৃষ্ণ মজুমদার

সহকারী অধ্যাপক, ভূমিকম্প প্রকৌশল গবেষণা ইন্সটিটিউট

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top