নির্মাণকৌশলে ছোট-বড় নদী পারাপারে সেতু যুগান্তকারী এক সৃষ্টি। কিন্তু বড় বড় নদীতে বিশাল আকারের সেতু দেখে প্রশ্ন জাগতেই পারে, বিশাল এই জলরাশির মধ্যে সেতুর ভিত্তি বা পিয়ারের (Pier) নির্মাণকাজ কীভাবে সম্ভব? প্রকৌশলবিদ্যায় এর রয়েছে সহজ নির্মাণকৌশল। আর এই কৌশল-প্রক্রিয়াই কফারড্যাম। কফারড্যাম হলো পানি ও কাদার মধ্যে নির্মাণে ব্যবহৃত অস্থায়ীভাবে নির্মিত পানি ও কাদানিরোধক কাঠামো। এ কৌশলের সাহায্যে পানি ও কাদামাটিকে খননকাজের স্থান থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা হয়। কফারড্যামের মধ্যে সেতুর পিয়ার ও আনুষঙ্গিক দরকারি কাঠামোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়। এই অস্থায়ী কাঠামোতে পানির নিচের কাজে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। সাধারণত কফারড্যাম হিসেবে সিট পাইলকে পানির মধ্যে স্থাপন করা হয়। সিট পাইল বা কফারড্যামের ভেতর থেকে পরে পানি ও কাদা অপসারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিট পাইলের নিচে ও সেতুর পিয়ারের নিচের অংশে ঝবধষ কংক্রিট স্থাপন করে সম্পূর্ণ কফারড্যামকে পানিরোধী করা হয়। এতে সহজেই সেতুর পিয়ারের নির্মাণকাজ করা সম্ভব হয়। সেতুর পিয়ারগুলো যথাযথ শক্তি অর্জন করলে সিট পাইল বা কফারড্যামকে অপসারণ করা হয়। অনেক সময় পিয়ারকে অধিক স্থায়িত্ব প্রদানের উদ্দেশ্যে বা নকশার চাহিদা থাকলে কফারড্যামকে পিয়ারের সঙ্গে স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়া হয়।
একটি কফারড্যামের গাঠনিক মিথোস্ক্রিয়ায় মাটি ও পানি অন্তর্ভুক্ত। চাপের কারণে পানির স্থিতি শক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ ও ঢেউয়ের কারণে যে প্রগতিশীল শক্তির সৃষ্টি হয়, কফারড্যাম তার মুখোমুখি হয়।
কফারড্যাম নির্মাণের ক্ষেত্রে অবিকল সহনশীলতা বজায় রাখা কঠিন। কারণ, কফারড্যাম সাধারণত সাগরমুখী নির্মাণসহ কখনো কখনো বিরূপ আবহাওয়ায়ও নির্মাণকাজ চালিয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নির্মাণের সময় কফারড্যাম উপাদানের আকৃতির উল্লেখযোগ্যভাবে বিকৃতি ঘটতে পারে। তাই প্রকৃত আকৃতি এবং মাপের চ্যুতি আবশ্যক পরিকল্পনা অনুসারে প্রকল্পটি শেষ করতে।
কফারড্যাম স্থাপন বা কাঠামো নির্মাণ উভয় ক্ষেত্রেই নির্মাণকাজের যন্ত্র এবং ক্রিয়াকলাপ চালনার জন্য কফারড্যামের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয় তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

কফারড্যাম অপসারণ অবশ্যই পরিকল্পিত হতে হবে। কাজটি কফারড্যাম স্থাপনের মতোই ধাপে ধাপে করতে হবে। স্থায়ী কাঠামোর ওপর অপসারণের প্রভাবগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। এ কারণে স্থায়ী কাঠামোর নিচে বিস্তৃত শিটের স্তূপগুলোকে কখনো কখনো কেটে জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। যেহেতু এগুলোর অপসারণে ভিত্তিপ্রস্তরের মাটি, যা কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায়, এর ক্ষতি হতে পারে।
কফারড্যাম নির্মাণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রধান বিবেচ্য বিষয়। যেহেতু শ্রমিকেরা বন্যা এবং ধসের মতো বিপত্তির মুখে একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় থাকে।
নিরাপত্তা দাবি করে যে কফারড্যাম এবং এর প্রতিটি অংশ নির্মাণ আকৃতির উপযুক্ত হবে এবং পর্যাপ্ত শক্তিশালী নির্ভরযোগ্য দ্রব্য হবে। এই উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। যথাযথ নির্মাণ, পরিকল্পনামতো কাঠামো নির্মিত হচ্ছে কি না তা যাচাই, কফারড্যামের বৈশিষ্ট্য নিরীক্ষণ, চারপাশের এলাকা পরীক্ষণ, আলো ও বাতাস এবং সুপারভাইজার ও সব শ্রমিকের নিরাপত্তা যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
কফারড্যামের উপাদানসমূহ
শিট পাইল
ধনুবন্ধনী বা জোড়া কাঠামো এবং
কংক্রিট সিল।
শুষ্ক এবং নিরাপদ পরিবেশে কফারড্যাম রিংয়ের সাহায্যে একেবারে তলদেশে পৌঁছানো সম্ভব। স্টিলের ছিদ্রযুক্ত আবরণটি কেটে সিলের উপরিভাগে ফেলে দেওয়া হয় এবং মিহি বা দুর্বল কংক্রিটগুলো ছিদ্র দিয়ে নিচে পড়ে যায় আর ভালো কংক্রিটগুলো শক্ত ভিত তৈরি করে।
কফারড্যামের রকমফের
১. জোড়া
এটি শিট পাইলয়ের একক দেয়াল থেকে গঠিত, যা ভূমির মধ্যে চালনা করা হয় বাক্স গঠনের জন্য (খননস্থলে)। তারপর ওই বাক্স বা কক্ষটিকে ভেতরে জোড়া লাগিয়ে ভেতরের পানি নিষ্কাশন করা হয়। এটি প্রাথমিকভাবে অগভীর পানিতে (30-35ft) ব্রিজের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. মাটির ধরন
এটি কফারড্যামের সবচেয়ে সাধারণ ধরন। খনন স্থানকে ঘেরাও করার জন্য মাটির বাঁধ বা খাড়া শিট এটি। এটিকে নিম্ন উচ্চতা এবং কম বেগপূর্ণ পানির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
৩. কাঠের আবন্ধন
ভূমির ওপর নির্মিত, তবে যথাস্থানে ভাসমান। প্রতিটি কোষের নিম্নাংশ নদীর তীরের সীমাসূচক রেখার সঙ্গে মিলিত। এটার সাহায্যে মাটি এবং নুড়িপাথর ব্যবহার করে পানি চোয়ানো কমানো যায়।

৪. দুই দেয়ালবিশিষ্ট শিট পাইল
এগুলো দুই দেয়ালবিশিষ্ট কফারড্যাম যেখানে দুইটি সমান্তরাল শিট পাইলকে ভূমির ভেতরে স্থাপন করা হয় এবং এগুলো একটি পদ্ধতির দ্বারা যুক্ত থাকে। সাধারণত রড দিয়ে এক বা একাধিক স্থানে এগুলো বাঁধা থাকে। এই দুই দেয়ালের ভেতরের খালি স্থান সাধারণত ঝরঝরে দ্রব্য; যেমন- বালু, নুড়ি বা চুনাপাথর দিয়ে ভর্তি করা হয়।
৫. ছিদ্রযুক্ত কফারড্যাম
কোষীয় কফারড্যাম শুধু সেই পরিস্থিতে ব্যবহার করা হয়, যেখানে গর্তের মাপ (cross excavation bracing)-এর ব্যবহারকে নির্ধারণ করে। এই ক্ষেত্রে কফারড্যামকে অবশ্যই পার্শ্বিক চাপকে প্রতিহত করে হতে হবে স্থিতিশীল।
কফারড্যামের যত সুবিধা
একই কাজ ভূমির ওপর করার চেয়ে পানির ভেতর করাটা সব সময়ই কঠিন এবং ব্যয়বহুল। আর যখন কাজটি পানির নিচে করা হয় তখন গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা ও ব্যয় বাড়ে জ্যামিতিক হারে।
কফারড্যামের উল্লেখ করার মতো কিছু সুবিধা
তুলনামূলক খারাপ পরিবেশে কাঠামো নির্মাণ ও খননকাজের সুবিধা দেয়।
কাজের জন্য নিরাপত্তাপূর্ণ পরিবেশ থাকে।
আকৃতির দায়িত্ব মূলত ঠিকাদার ঠিক করেন।
স্টিলের শিটের পাইল সহজেই স্থাপন ও অপসারণযোগ্য।
ব্যবহৃত দ্রব্যাদি অন্য প্রকল্পগুলোতে পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
স্থাপন
যেকোনো পাইলিং পরিকল্পনার সন্তোষজনক সমাপ্তি এবং সফলতার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণীয়-
দক্ষভাবে কর্মক্ষেত্র যাচাই, আদর্শ ও প্রাসঙ্গিক পরীক্ষণে কাজের আকৃতি অনুসরণ।
নির্মাণের সব ধাপেই পর্যাপ্ত ডিজাইন থাকা।
পাইলগুলো স্থাপন এবং যথাযথভাবে অপসারণ।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য প্রাসঙ্গিক আইন প্রণয়ন এবং পথ প্রদর্শন। পাইল স্থাপনের জন্য যে উপকরণগুলো লাগবে তা হলো হাতুড়ি, ক্রেন, স্টিলের সিট, H-Piles ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে কফারড্যামের সুদক্ষ স্থাপনার জন্য বজরার প্রয়োজন হতে পারে।
২. আরোপিত ভারের ধরন
একটি রূপক কফারড্যাম বিভিন্ন ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে পারে। যেহেতু এটি নির্মাণের রয়েছে নানা ধাপ। উল্লেখযোগ্য চাপসমূহ হলো- স্থিতিশক্তির চাপ, মাটির কারণে সৃষ্ট চাপ, পানি বিদ্যুতের চাপ, ঢেউয়ের চাপ, বরফের চাপ, ভূকম্পীয় চাপ এবং আকস্মিক চাপ। কফারড্যামের পরিকল্পনার চিত্র-
৩. ভূকম্পনীয় চাপ
নির্মাণের সময় কফারড্যামের বহিরাংশের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উচ্চতা এবং ভেতরে পানির উচ্চতার কথা বিবেচনা করতে হবে। এগুলো নেট ডিজাইন চাপে পরিণত হয়, যেটা ছবি-১-এ দেখানো হলো :
৪. মাটির বোঝার কারণে সৃষ্ট চাপ
কফারড্যামের দেয়ালের ওপর স্থানীয়ভাবে এবং সর্বোপরি গঠনের ওপর মাটি চাপ সৃষ্ট হয়। এই চাপ ভূকম্পীয় চাপের সঙ্গে যুক্ত। শিট পাইলের ওপর পার্শ্বীয় চাপ সৃষ্টির অন্যতম বড় কারণ ভূমির চাপ। এই চাপের কারণে শিটগুলো বেঁকে অথবা সংকুচিত হতে পারে।
৫. গঠনের ওপর তাপীয় চাপ
একটি রূপক কফারড্যামে তাপীয় চাপ শুধু কফারড্যামের অভিক্ষেপণের ওপরই চাপ দেয় না বরং পাশের কর্মক্ষেত্রগুলোর ওপরও চাপ প্রয়োগ করে। সমতল শিট পাইলগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট হতে পারে, যেখানে Z-Pile-গুলো পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। যেহেতু বিদ্যুৎ প্রতিটি প্রোফাইলের খাঁজকাটা অংশের পেছনে এডি তৈরি করে।
৬. ঢেউয়ের চাপ
যে ঢেউগুলোতে কফারড্যামের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় তা সাধারণত বাতাসের কারণে আর তাই এ ধরনের ঢেউয়ের উচ্চতা হয় সীমিত। যদিও ঢেউয়ের উচ্চতার চেয়ে কফারড্যামের উচ্চতা কমপক্ষে ৩ ফুট উঁচু হওয়া উচিত।
৭. বরফজনিত চাপ
এই চাপ দুই ধরনের। একটি এক জায়গায় স্থির বরফের চাপ এবং অন্যটি সেই সব বরফের চাপ, যেগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভেসে বেড়ায়।

৮. ভূকম্পীয় চাপ
আগে সাধারণত অবস্থায়ী নির্মাণের সময় এটা বিবেচনা করা হতো না। কিন্তু খুব বড়, গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর কফারড্যাম স্থাপনের সময় অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের ক্ষেত্রে ভূমি পরীক্ষা করা অতি জরুরি।
৯. মার্জিতকরণ
নদীর পানিতে সৃষ্ট বিদ্যুৎ, জোয়ার-ভাটাসংক্রান্ত বিদ্যুৎ বা ঢেউয়ের কারণে সৃষ্ট বিদ্যুতের কারণে নদী বা সমুদ্রের নিম্নাংশ পরিষ্কার হতে পারে। একই সময়ে যখন এই বিদ্যুৎ একসঙ্গে সৃষ্টি হয় তখন সৃষ্টি হতে পারে ভয়াবহ দুর্যোগ। এ ধরনের দুর্যোগ এড়ানোর একটি উপায় হচ্ছে কফারড্যামের চারপাশে চুনাপাথরের চাদর সৃষ্টি করা।
নির্মাণকৌশল হিসেবে কফারড্যাম ব্যবহারের ফলে পানি ও কাদা বিশেষ করে প্রতিকূল পরিবেশে নির্মাণকাজ পরিচালনা করা অনেক বেশি সহজতর। তা ছাড়া এর ফলে নির্মাণশ্রমিকদের জন্য অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। কফারড্যামের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষে বিশেষত এর উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাওয়ার পরে একে অপসারণ করা প্রয়োজন। অনেক সময়ই কফারড্যাম অপসারণের সময় দেখা দেয় নানা বিপত্তি। তাই কফারড্যাম অপসারণের সময়ও কফারড্যামকে নির্মাণকাজ পরিচালনার স্থানে সংযুক্ত করার মতো সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কফারড্যামসমূহকে অবমুক্ত করা জটিল বলে একে স্থায়ী কাঠামো হিসেবে পিয়ারের সঙ্গে রেখে দেওয়া যায়। তা ছাড়া কফারড্যাম অপসারণের সময় ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সংযুক্ত মাটির ক্ষতি হতে পারে। তাই কফারড্যামসমূহকে পিয়ারের সঙ্গে স্থায়ী কাঠামো হিসেবে রেখে দেওয়া অনেক বেশি সমীচীন। বর্তমানে নির্মাণকাজে কফারড্যামকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিয়ারের সঙ্গে স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়া হয়।
প্রকৌশলী সনজিত সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪