প্রতিপাদ্য : ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুরোনো কংক্রিট ব্যবহার করে গ্রহণযোগ্য শক্তিসম্পন্ন কংক্রিট নির্মাণ সম্ভব।
যে কারণে গবেষণা
ভূমিস্বল্পতার কারণে পুরোনো ও অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার ভবন ভেঙে বাড়ছে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ। ফলে সময়ের সঙ্গে পালা দিয়ে এক দিকে বাড়ছে কংক্রিটের (ইট, বালু, পানি আর সিমেন্টের মিশ্রণ) চাহিদা, অপর দিকে বাড়ছে কংক্রিট-বর্জ্য।
আগের কিছু গবেষণাপত্র সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ভবন, সেতু, মহাসড়ক, বাঁধসহ বিভিন্ন পুরকৌশল-বিষয়ক নির্মাণে গড়ে ১২ বিলিয়ন টন কংক্রিট দরকার। যার জন্য ১০ বিলিয়ন টন এগরিগেট (ইট, পাথর) প্রয়োজন। ফলে ইট তৈরি, পাথর উত্তোলন এবং কংক্রিট-বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে, বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা।
তাই পরিবেশদূষণ ও নির্মাণব্যয় কমাতে নতুন ইট বা পাথরের কিছু অংশের পরিবর্তে পুরোনো কংক্রিটের একাংশ পুনর্ব্যবহার নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জন্মায়। সেই আগ্রহ থেকেই প্রায় দেড় বছর আগে শেষ বর্ষের প্রকল্প হিসেবে নতুন ইট বা পাথরের কিছু অংশের পরিবর্তে পুরোনো কংক্রিটের একাংশ পুনর্ব্যবহার করে তৈরি করা কংক্রিটের শক্তি নিয়ে কাজ করা শুরু করি। বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করে বর্তমানে ট্রাস্ট এলায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেডে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। এ প্রকল্পে আমার সহকর্মী কায়সার আহমেদ। তিনি এখন ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সায়েন্সে (ইউআইটিএস) প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন।

পুরোনো কংক্রিট সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়। এর কোনো বাজারমূল্য নেই। তাই নতুন ইট বা পাথরের কিছু অংশের পরিবর্তে পুরোনো কংক্রিট ব্যবহার করলে পরিবেশদূষণ কমানোর পাশাপাশি কমবে নির্মাণখরচও।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের বার্ষিক কংক্রিটের চাহিদা ১৮ বিলিয়ন টনে পৌঁছাবে। ফলে বাড়বে এগরিগেটের চাহিদা। আর এ এগরিগেটের চাহিদা মেটাতে বাড়াতে হবে ইটভাটা অথবা পাথর উত্তোলন, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি করবে, বাড়াবে বৈশ্বিক উষ্ণতা। তাই কোর্স এগরিগেটের (ইট, পাথর) কিছু অংশের পরিবর্তে পুরোনো কংক্রিটের একাংশ পুনর্ব্যবহার করে কংক্রিট তৈরি করলে কার্বন ডাই-অক্সাইড কম নিঃসরণ হবে। অপর দিকে, পুরোনো কংক্রিট পরিবেশে ত্যাগ করার ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ পুরোনো কংক্রিট কোর্স এগরিগেটের কিছু অংশের পরিবর্তে ব্যবহার করা গেলে একদিকে কমবে পরিবেশদূষণ অপর দিকে কমবে নির্মাণখরচ। ফলে পুরোনো কংক্রিটের পুনর্ব্যবহার হবে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সেই সঙ্গে নির্মাণ সহায়ক।
গবেষণার ইতিহাস
পুরোনো কংক্রিটের পুনর্ব্যবহারের বিষয়ের গবেষণা শুরু ১৯৪৫ সালের দিকে। তখন গবেষণাগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন। দীর্ঘ ৩২ বছর গবেষণা শেষে নিক্সন ১৯৭৭ সালে প্রথম পুরোনো কংক্রিটের পুনর্ব্যবহার-সংক্রান্ত একটি গবেষণা শেষ করেন। তিনিই প্রথম আরআইএলইএম টেকনিক্যাল কমিটি ৩৭-ডিআরসির কাছে এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র ‘স্টেট অব আর্ট’ প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে হানসেনসহ আরও অনেকে সম্মিলিতভাবে ১৯৯২ পুরোনো কংক্রিট (রিসাইকেল এগরিগেট) ব্যবহার করে কংক্রিট তৈরির গাইডলাইনসহ একটি বিশদ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে প্রতিবছর গড়ে ১৮০ মিলিয়ন টন কংক্রিট বর্জ্য উৎপন্ন হয়। তাতে দেখা যায়, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিটি নাগরিক প্রতিবছর গড়ে ৫০০ কেজি কংক্রিট-বর্জ্য উৎপন্ন করে, যার প্রায় ১০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়।
আগের বিভিন্ন গবেষণাপত্র সূত্রে জানা যায়, নেদারল্যান্ডে প্রতিবছর গড়ে ১৪ মিলিয়ন টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৮ মিলিয়ন টনই আনবন্ড রোড বেস কোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জার্মানিতে প্রতিবছর ২৮৫ মিলিয়ন টন নির্মাণ-বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৭৭ মিলিয়ন টন ডেমলিশড কংক্রিট, যার প্রায় ৭০ শতাংশ নতুন নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয়। ফ্রান্সে প্রতিবছর গড়ে ১৩ মিলিয়ন টন, জাপানে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন টন ও হংকংয়ে ২০ মিলিয়ন টন কংক্রিট বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার অধিকাংশই নানা কাজে পুনর্ব্যবহার করা হয়।
গবেষণার ফলাফল
গবেষণায় আমরা ১০০:০, ৭৫:২৫, ৫০:৫০, ২৫:৭৫, ০:১০০-এ পাঁচটি অনুপাতের নতুন ও পুরোনো কংক্রিটের মিশ্রণ ব্যবহার করে তৈরি করা নমুনা কংক্রিট সিলিন্ডার ও বিমের শক্তি পর্যবেক্ষণ করি। এ নমুনাগুলোতে রিসাইকেলড কোর্স এগরিগেট হিসেবে পরীক্ষাগারে সিলিন্ডার টেস্ট করার পর ওই সিলিন্ডারগুলোর অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ফাইন এগরিগেট হিসেবে ১.২৯ ফাইননেস মডুলাসের (এফএম) লোকাল স্যান্ড (স্থানীয় বালু), ওয়াটার সিমেন্ট অনুপাত ০:৪৫, সিমেন্ট, ফাইন এসরিগেট (বালু) ও কোর্স এসরিগেট (পাথর) এর অনুপাত ১:১.৫:৩ ব্যবহার করা হয়েছে এবং কিউরিং পিরিয়ড ছিল ২৮ দিন।
তৈরিকৃত নমুনাগুলোর বিভিন্ন পরীক্ষা ও গুণগতমান বিচার করে আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন অনুপাতের মিশ্রণের মধ্যে ৭৫:২৫ অনুপাতের নতুন ও পুরোনো এগরিগেটের মিশ্রণ সবচেয়ে ভালো ফলাফল প্রদর্শন করে, যা কম গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল অনুসারে, নতুন ইট বা পাথরের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুরোনো কংক্রিট দ্বারা অপসারণ করলে যে শক্তি সম্পন্ন কংক্রিট পাওয়া যায় তা দিয়ে নির্মাণকাজ করা সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে পুরোনো কোর্স এগরিগেটের (ইট, পাথর) ঘনত্ব ২১০০ কেজি/ঘনমিটারের বেশি, শোষণ ক্ষমতা ৫০%-এর কম এবং অপদ্রব্য ১%-এর কম হওয়া দরকার।
মন্তব্য
এ বিষয়ে আরও বিশদ গবেষণা দরকার। বিশেষ করে, বিভিন্ন অনুপাতের সিমেন্ট, ফাইন এগরিগেট (বালু) ও কোর্স এগরিগেটের (পাথর) মিশ্রণ, বিভিন্ন ওয়াটার সিমেন্ট অনুপাত, কিউরিং পিরিয়ডের এবং বিভিন্ন ফাইননেস মডুলাসের (এফএম) ফাইন এগরিগেট (বালু) ব্যবহার করে কংক্রিটের শক্তি পরীক্ষা করা যেতে পারে। এতে কোনো অনুপাতে পুরোনো ও নতুন এগরিগেটের মিশ্রণ ব্যবহার সর্বাধিক সাশ্রয়ী ও গ্রহণযোগ্য হবে তা নিরূপণ সহজ ও সঠিক হবে।

এ প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম।
এ প্রসঙ্গে তাঁর মত, নতুন কোর্স এগরিগেটের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত রিসাইকেল এগরিগেট (পুরোনো কংক্রিট) দ্বারা অপসারণ করলে কম খরচে গ্রহণযোগ্য শক্তিবিশিষ্ট কংক্রিটের তৈরির পাশাপাশি পরিবেশদূষণও কমানো সম্ভব।
- প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খান
প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার
ট্রাস্ট এলায়েন্স টেকনলোজি লিমিটেড
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৫ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩