অধুনা ফ্ল্যাটবাড়ি কিংবা বসতবাড়ির সব ধরনের কাঠের আসবাব তথা দরজা-জানালায় ব্যাপক হারে কাঠবিনাশী তথা ধ্বংসকারী পোকার সংক্রমণ দেখা যায়। উইপোকা সাধারণত কাঠ ধ্বংসকারী ঘুণপোকা হিসেবে বহুল পরিচিত। উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে বা আধা উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে এই জাতীয় পোকা বেশি দেখা যায়। এই জাতীয় পোকা কাঠ ও অন্যান্য সেলুলোজ পদার্থ অথবা কাঠ-জাতীয় যেকোনো আসবাব; যেমন- মেলামাইন বোর্ড, প্লাইবোর্ড, ভিনিযার বোর্ডের মতো সামগ্রী খুব দ্রুতই খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। তাই বিভিন্ন প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কাঠবিনাশী পোকার হাত থেকে দালানকে রক্ষা করা জরুরি। কাঠ ধ্বংসকারী পোকার উৎপত্তিস্থল হয় নানা স্থানে। অন্যদিকে এদের ধরন, বংশবিস্তার আর কাঠ ধ্বংসের পদ্ধতিতে রয়েছে ভিন্নতা।
ধরনের ভিন্নতায়
সাধারণত কাঠ ধ্বংসকারী পোকা দুই ধরনের হয়ে থাকে-
১. ড্রাই উড টারমাইট (Dry Wood Termites)
২. স্যাবট্যারানিয়ান টারমাইট (Subterranean Termites)
ড্রাই উড টারমাইট
ড্রাই উড টারমাইটের উৎপত্তি সাধারণত শুষ্ক স্থানে; এক কথার এ জাতীয় কাঠ ধ্বংসকারী পোকা শুষ্ক বা শুকনা কাঠে বাস করে। সাধারণত মাটি কিংবা অন্য জলীয় পদার্থের ওপর এদের বংশবিস্তার নির্ভর করে না। এরা দরজা-জানালার চৌকাঠ, কাঠের আসবাবের মতো শুকনা কাঠের মধ্যে বাস করে। আস্তে আস্তে কাঠকে খেয়ে পাউডারের মতো করে এটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। অনেক সময় কাঠকে শস্য দানার মতো করে খেয়ে ছিদ্র করে এর মধ্যে বাস করে। এরা সবর্দাই কাঠের মধ্যে চলাচল করে।
সাবট্যারানিয়ান টারমাইট
এ জাতীয় কাঠ ধ্বংসকারী পোকা মাটির সংস্পর্শ ছাড়া বাঁচতে পারে না। প্রথমে এরা মাটির নিচে বাসা তৈরি করে। অনেক সময় কাঠের রসের পচন থেকে অথবা কাঠের জলীয় অংশে এরা বংশবিস্তার করে। এরপর খাদ্য অন্বেষণে বের হয়। তৈরি করে সুড়ঙ্গ। কাঠকে খেয়ে দিনে দিনে এটিকে নষ্ট করে ফেলে। কাঠই এদের প্রধান খাদ্য। যে সাবট্যারানিয়ান টারমাইটগুলোর উৎপত্তি মাটি থেকে তারা প্রথমে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে ভবনে প্রবেশ করে। ভবনের গাঁথুনির ফাটল, জোড়া, মেঝের জয়েন্ট, পাইপ ইত্যাদির মাধ্যমেও ভবনে প্রবেশ করে থাকে। প্লিন্থ লেভেলের ওপরে যেকোনো কাঠের কাঠামো দিয়ে এরা দালানের ভেতরে প্রবেশ করে। প্রায়ই এরা দরজার চৌকাঠকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে বেছে নেয়। পরবর্তী সময়ে এরা বাসা করে কাঠের মধ্যেই স্থায়ী হয়। ধীরে ধীরে কাঠকে খেয়ে বেঁচে থাকে। কাঠের কাঠামো শেষ হলে অপেক্ষাকৃত বেশি জলীয় কণাসমৃদ্ধ কাঠের অন্য আসবাবকে টার্গেট করে এরা ছড়িয়ে পড়ে ঘরের আনাচকানাচে। সাবট্যারানিয়ান টারমাইট-জাতীয় পোকার জন্য প্রচুর জলীয় অংশ বা আর্দ্রতার প্রয়োজন। আর তাই এরা বাথরুমের কাঠের দরজা, নিচতলার দরজার চৌকাঠসহ অন্যান্য আসবাবকে এদের নিরাপদ আবাসস্থল মনে করে। এরা কাঠ, ঘাস ইত্যাদি সেলুলোজ-জাতীয় পদার্থ খায়। লেদার, প্লাস্টিক, রাবার, আসবাব, কাপড়চোপড় প্রভৃতি এদের দ্বারা কোনো কোনো সময় আক্রান্ত হয়।
প্রতিরোধে যা করণীয়
কাঠ ধ্বংসকারী পোকা নির্মূল বা প্রতিরোধের জন্য দুই ধরনের প্রতিরোধী ব্যবস্থা রয়েছে-
১. নির্মাণকাজ-পূর্ব ব্যবস্থা (Pre-Construction Treatment)
২. নির্মাণকাজ-পরবর্তী ব্যবস্থা (Post-Construction Treatment)
নির্মাণকাজের আগের ব্যবস্থা
দালানের বা ভবনের নির্মাণকাজের প্রাথমিক অবস্থাতেই বা শুরুতেই কাঠ ধ্বংসকারী পোকা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নির্মাণকাজ চলাকালীন যে ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়-
১. জায়গা প্রস্তুতকরণ (Site Preparation)
২. সয়েল ট্রিটমেন্ট (Soil Treatment)
ক. খননকৃত ভিত্তির গর্ত ট্রিটমেন্ট (Treatment of Excavated Foundation Trenches)
খ. পার্শ্ব ভরাট মাটি ট্রিটমেন্ট (Treatment of back fill soil)
গ. প্লিন্থ লেভেলে ভরাটকৃত মাটি ট্রিটমেন্ট (Treatment of filling of Plinth Level)
ঘ. বহিঃস্থ চারদিকের মাটি ট্রিটমেন্ট (Treatment of Soil along the External Periphery)
৩. কাঠামোগত প্রতিরোধ বা বাধা (Structural Barrier)

জায়গা প্রস্তুতকরণ
নির্মাণ কার্যস্থলে গাছের গুঁড়ি, শিকড়, লগ, গাছের নষ্ট কাঠ ও অন্যান্য আঁশযুক্ত কোনো জৈব পদার্থ থাকলে তা মাটি থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে। এসব পদার্থ মাটিতে থাকলে কাঠ ধ্বংসকারী পোকা সক্রিয় হয়ে উঠে পুনরায় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। যদি কাঠ ধ্বংসকারী পোকার ঢিবি বা স্তূপ খুঁজে পাওয়া যায়, তবে নিম্নোক্ত রাসায়নিক সলিউশন ব্যবহার করে তা ধ্বংস করা সম্ভব।
Chemical Concentration by weight
DDT 5%
BHC 0.5%
Aldrin 0.25%
Heptachlor 0.25%
Chlordane 0.5%
রাসায়নিক এসব পদার্থ পানির সাথে মিশিয়ে ইমালশন প্রস্তুত করা হয়। এরপর চার লিটার পানি মিশ্রিত ইমালশন এক ঘন মিটার কাঠ ধ্বংসকারী পোকার ঢিবিতে বা স্তূপে প্রয়োগ করা হয়।
২. সয়েল ট্রিটমেন্ট
সয়েল ট্রিটমেন্ট সবচেয়ে ভালো ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ভবনের নির্মাণকাজ চলাকালীন মাটিতে রাসায়নিক সলিউশন ব্যবহার করে কাঠ ধ্বংসকারী পোকার আক্রমণ থেকে ভবনকে রক্ষা করা যায়। নিচের যেকোনো একটি রাসায়নিক পদার্থ পানির সাথে মিশিয়ে ইমালশন প্রস্তুত করা হয়।
Chemical Concentration by Weight
- Aldrin 0.5%
- Heptachlor 0.5%
- Chlordane 1%
ইমালশন ছিটানো যন্ত্রের সাহায্যে ধাপে ধাপে এটি প্রয়োগ করা হয়-
ধাপ-১: ভিত্তির গর্তের তলদেশ এবং পার্শ্বে 30cm উঁচু পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়। প্রতি বর্গমিটারে পাঁচ লিটার হারে ইমালশন ব্যবহার করা হয়।
ধাপ-২: ভিত্তির দেয়াল নির্মাণের পর এর উভয় পাশে মাটি দিয়ে পূর্ণ করার আগে খাঁড়া পৃষ্ঠে প্রতি বর্গমিটারে পাঁচ লিটার হারে ইমালশন প্রয়োগ করা হয়। আনুভূমিক যা হবে 30cm চওড়া এবং 45cm গভীর।
ধাপ-৩: মেঝে তৈরি করার আগে সমগ্র সমতলপৃষ্ঠে প্রতি বর্গমিটারে পাঁচ লিটার করে ইমালশন প্রয়োগ করা হয়।
ধাপ-৪: দালানের চারদিকের মাটিকে টারমাইট প্রতিরোধী করার জন্য 15cm পরপর 12cm ব্যাসের 30cm গভীর ছিদ্র করতে হয়। প্রতি একক মিটারে ২.২৫ মিটার হারে দ্রবণ প্রয়োগ করে মাটি দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হয়।
৩. কাঠামোগত প্রতিরোধ
কাঠ ধ্বংসকারী পোকা যাতে মাটি থেকে ভবনের ওপরের অংশে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য প্লিন্থ লেভেলে 50-75mm পুরু সিমেন্ট কংক্রিটের D.P.C লেয়ার অর্থাৎ Damp Proof Course প্রদান করতে হবে। প্রয়োজন হলে D.P.C-এর নিচে বিটুমিন অ্যাসফল্টের লেয়ার দিতে হবে। D.P.C ভেতরের দিকে বা বাইরের দিকে 50-75mm বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। নতুন কাঠের যেকোনো দরজা, জানালা, চৌকাঠ প্রভৃতি ব্যবহারের আগে অবশ্যই কাঠকে ভালোভাবে ঘষে সিজনিং, বার্নিশ ও পেইন্টিং করতে হবে। কারণ, ভবনে ব্যবহৃত কাঠের সব কাঠামোই হতে হবে ড্যামপ্রুফ। যেটা কাঠকে কাজে লাগানোর আগে সঠিকভাবে করা সম্ভব। কাঠ ধ্বংসকারী পোকার আক্রমণ রোধে পেইন্টিং অনেক বেশি কার্যকরী।
নির্মাণকাজের পরের ব্যবস্থা
সাধারণত বর্ষার সময় মাটি ও অন্যান্য কাঠে জলীয় কণার উপস্থিতিতে সাবট্যারানিয়ান টারমাইট-জাতীয় পোকার আক্রমণ বেশি হওয়ার ভয় থাকে। যেসব বিল্ডিং আগে নির্মিত দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে কাঠের সব স্থানে Post-Construction Treatment একটি কার্যকরী ব্যবস্থা। কাঠ ধ্বংসকারী পোকার আক্রমণ এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। যেভাবে এটা করা হয়-
১. নিয়মিত পরিদর্শন (Regular Inspection)
নিয়মিত দালান বা ভবন পরিদর্শন করা উচিত। যদি কোথাও এদের শেল্টার টিউব বা আবাসস্থলের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে দ্রুত কেরোসিনযুক্ত রাসায়নিক ইমালশন ব্যবহার করে তা দূর করা উচিত। অনেক সময় দেখা যায় উইপোকা মাটির সাথে কাঠের কাঠামো সংযুক্ত করার জন্য মাটি আর দরজায় শেল্টার টিউব তৈরি করে। এ ধরনের মাটির সাথে সরাসরি দালানের সম্পর্কযুক্ত স্থানকে ভেঙে দিতে হয়। তা ছাড়া কোথাও যদি ড্রাই উড টারমাইট বা সাবট্যারানিয়ান টারমাইট-জাতীয় কাঠ ধ্বংসকারী পোকার উপদ্রব দেখা দেয়, তবে আক্রান্ত স্থানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
২. ভিত্তির মাটি ট্রিটমেন্ট (Soil Treatment of Foundation)
ভবনে যদি সাবট্যারানিয়ান টারমাইটের উপস্থিতি বেশি বোঝা যায়। তবে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। সে জন্য প্রথমে দালানের বাইরের চারদিকে ০.৫ মিটার গভীর করে গর্ত খনন করা হয়। ক্রো-বার (Crow-bar)-এর সাহায্যে দেয়ালকে স্পর্শ করে 150mm পরপর 15mm ব্যাসের ছিদ্র তৈরি করা হয়। ছিদ্রের গভীরতা ভিত্তির কংক্রিট পর্যন্ত হয়। এরপর ছিদ্রগুলো রাসায়নিক ইমালশন দিয়ে পূর্ণ করা হয়। ছিদ্র ও খননকৃত গর্ত মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হয়। প্রতি বর্গমিটারে ৭.৫ লিটার হারে ইমালশন ভরাট মাটিতে ব্যবহার করা হয়।

৩. মেঝের নিচের মাটি ট্রিটমেন্ট (Soil Treatment Under Floor)
প্রসারণ জোড়, নির্মাণ জোড় অথবা ফাটল দিয়ে টারমাইট ভেতরে উঠতে পারে। এ অবস্থায় জোড় ও ফাটলগুলোতে 30mm পরপর 12mm ব্যাসের ছিদ্র থাকে। ট্রিলের সাহায্যে এর মধ্যে রাসায়নিক ইমালশন দিয়ে পূর্ণ করা হয়। মেঝের ছিদ্রগুলোকে বন্ধ করে দিতে হয়।
৪. ম্যাসনারির শূন্যস্থান ট্রিটমেন্ট (Treatment of Voids in Masonory)
যদি দেয়াল ভালোভাবে প্লাস্টার না করা থাকে অথবা Damp Proof Course সঠিকভাবে করা না হয়, তাহলে ম্যাসনারির ফাঁকা স্থানের মাধ্যমে টারমাইট প্রবেশ করে। সে জন্য প্রয়োজন ম্যাসনারির ফাঁকা বা শূন্য স্থানে ট্রিটমেন্ট দেওয়া। P.L অর্থাৎ প্লিন্থ লেভেলে দেয়ালের ভেতর এবং বাইরে উভয় দিকে ৪৫০ কোণে 30cm পরপর 12mm ব্যাসের ছিদ্র করে তার ভেতর রাসায়নিক ইমালশন প্রয়োগ করতে হয়। সম্পূর্ণ ছিদ্র বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ইমালশন প্রয়োগ চালিয়ে যেতে হয়।
৫. কাঠের কাজের ট্রিটমেন্ট (Treatment of Wood Work)
আক্রান্ত কাঠে ৪৫০ কোণে 15cm পরপর 6mm ব্যাসের ছিদ্র করে রাসায়নিক ইমালশন প্রয়োগ করে কাঠ ধ্বংসকারী পোকা প্রতিরোধ সম্ভব হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা দৃষ্টিনন্দন হয় না। তা ছাড়া কাঠ সহজলভ্য হওয়ায় কাঠে পচন বা কাঠ ধ্বংসকারী পোকার আক্রমণ হলে কাঠ পরিবর্তন করে নতুন কাঠ ব্যবহার করাই উত্তম। নতুন কাঠ ব্যবহারের আগে অবশ্যই সেটা সিজনিং করে নিতে হবে, সেই সাথে প্রয়োজনমতো বার্নিশ এবং পেইন্টিং করাতে হবে। তবেই সম্ভব হবে কাঠকে টারমাইটের হাত থেকে রক্ষা করা।
শেষ করার আগে একটি ইংরেজি প্রবাদ মনে করিয়ে দিই ‘Prevention is Better than Cure’ তাই Post-Construction Treatment করার থেকে Pre-Construction Treatment পদ্ধতি প্রয়োগ করাই হবে প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ।
প্রকৌশলী সুবীর কুমার সাহা
engr_subir.bandhan@gmail.com
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫২ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৪