শিল্পের কারুকার্যে ভরা যে হাত

ছোটবেলা থেকেই পছন্দ ছবি আঁকা। তখন থেকেই ভাবনাটা তাঁর আর্কিটেক্ট হওয়ার। নিজের বাড়ির ডিজাইন করার মাধ্যমে ছোটবেলায় দেখা স্বপ্নটার বাস্তব রূপ দেওয়া। এ যেন যেমন ভাবা তেমন কাজ। আর এ কাজের কাজি আর কেউ নন, অহনা অ্যান্ড আর্কিটেক্টের সত্ত্বাধিকারী স্থপতি অহনা রহমান।

বাবা ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। দাদার বাড়ি নোয়াখালীতে হলেও বেড়ে ওঠা রাজধানীর  শান্তিনগরে। কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে এসএসসি এবং সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর স্থাপত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর একটি ইন্টেরিয়র স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন বছর তিনেক।

২০০৭ সালে ইন্টার্নশিপ করেন স্থপতি রফিক আজমের স্বনামধন্য ফার্ম সাতত্যে। এর পরপরই যোগ দেন আর্কিটেক্ট ইশতিয়াক তিতাসের আর্কিটেকচার ফার্মে। এখান থেকে কর্ম অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃৃদ্ধ করে গড়ে তোলেন নিজস্ব স্থাপত্য ফার্ম। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ফার্মটির নাম রাখেন এ অ্যান্ড আর্কিটেক্ট অর্থাৎ অহনা অ্যান্ড আর্কিটেক্ট। স্বল্প সময়ের মধ্যে তরুণ এ স্থপতি কাজ করেছেন ছোট-বড় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের স্থাপত্য ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের। রোটারি ক্লাব অব ঢাকা মিড টাউনের নিয়মিত সদস্য স্থপতি অহনা রহমান। 

বারাকা, সেগুনবাগিচা

ডিজাইনে দেশীয় কাঁচামালকে প্রাধান্য দিয়ে নান্দনিক ও পরিচ্ছন্নভাবে কাজ করাই তাঁর মূলমন্ত্র। সততা আর পরিশ্রমেই সফলতা আনে এই নীতিতে অটল থেকেই প্রতিটি কাজ করেন তিনি। শিক্ষাজীবনে প্রথম ইন্টেরিয়রের কাজ করেন নিজের বাড়ির। ইতিমধ্যে অফিস, বাসা এবং শোরুমের বিল্ডিং ডিজাইনসহ নানা ধরনের স্থাপত্য ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছেন।

প্রতিষ্ঠানটি যাঁদের নিয়ে

অহনা অ্যান্ড আর্কিটেক্টে এখন কাজ করছে তিনজন জুনিয়র আর্কিটেক্ট ও দুজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারসহ একটি ওয়ার্কার গ্রুপ। যার নেতৃত্বে রয়েছে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার স্থপতি অহনা নিজেই।

যেভাবে কাজ হয়

নতুন কোনো প্রকল্পের মিটিং শেষে ক্লায়েন্টের প্রাথমিক চাহিদা বুঝে ড্রয়িং করা হয়। সেই অনুযায়ী তৈরি হয় ডিজাইনের ধারণা। ক্লায়েন্টের সঙ্গে আলোচনায় উন্নয়ন ঘটিয়ে থ্রি ডাইমেনশনাল প্রকল্পকে চূড়ান্তভাবে দাঁড় করানো হয়।

উল্লেখযোগ্য যত কাজ

ছায়ানীড়

চামেলীবাগে ছয়তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবন। ২৫ ফুট বাই ৩৫ ফুটের ছোট পরিসর। বড় জায়গায় যেমন ইচ্ছা তেমন ডিজাইন করা যায়। কিন্তু ছোট জায়গার যাবতীয় সেটআপ করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এরপরও স্বল্প পরিসরে রাজউকের সব নিয়মনীতি মেনে ডুপ্লেক্স মডেলে তৈরি করা হয়েছে চমৎকার এ ফ্ল্যাট বাড়িটি।

ড. কামাল হোসেনের ‘ল’ চেম্বার, মতিঝিল

বাংলো বাড়ি পারটেক্স

গাজীপুরে অবস্থান পারটেক্স হাউসের। যেখানে একতলা একটি পুরোনো ভবনকে ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন একটি ভবন। এতে সংযোজিত হয়েছে পাঁচটি বেডরুম, ওপেন ডাইনিংরুম ও কিচেন। আধুনিক ল্যান্ডস্কেপে সাজানো হয়েছে চারপাশকে। বাংলো বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ একটি উন্মুক্ত ঝরনা। এখানে আরও রয়েছে আগত অতিথিদের জন্য ইনডোর গেমস, টেবিল টেনিসসহ অন্যান্য খেলাধুলার যাবতীয় আয়োজন।  

ল চেম্বার

ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের ল চেম্বারের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করেছে অহনা অ্যান্ড আর্কিটেক্ট। জায়গাটা বেশ ছোট। কিন্তু ক্লায়েন্টের চাহিদা ছিল লাইব্রেরিতে কম পরিসরের মধ্যে দ্বিগুণ বই রাখার ব্যবস্থা করা। ফলে এখানে হুইল সিস্টেমের মাধ্যমে ডাবল লেয়ার তৈরি করা হয়, যা সরানো যায় প্রয়োজনমতো। আগের লাইটিং সিস্টেম পরিবর্তন করে লাগানো হয়েছে সিলিং পদ্ধতির লাইট। যার ফলে এখন আর বই পড়ার সময় বইয়ের ওপর পড়বে না কোনো ছায়া। পরিবর্তন আনা হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায়ও।

বিআই লিমিটেড অফিস

বিআই লিমিটেডের অফিস মতিঝিলে। অফিসের আকার বেশ বড় নয়। তবু এর মধ্যেই রয়েছে সব ধরনের ব্যবস্থা। জায়গা নিবার্চনের পর ঢুকতেই রাখা হয়েছে ছোট একটি ওয়ার্ম রিসিপশন। যেখানে আছে এক সেট সোফা। স্থানটির লাইটিং, টেবিল সেটসহ অন্যান্য সজ্জাবিন্যাস করা হয়েছে নান্দনিকভাবে।

বাংলো বাড়ি পারটেক্স, গাজীপুর

এমএফসিএল

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আউয়াল মিন্টুর নিজস্ব অফিস এটি। অবস্থান বাংলামোটরে। অফিসের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কাজ করছে অহনা অ্যান্ড আর্কিক্টেট। এখানে ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক সব ফার্নিচার।

এ ছাড়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি, যা শুরু হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। 

অনন্য যে বৈশিষ্ট্যে

অহনা অ্যান্ড আর্কিক্টেটের কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুণগতমান ঠিক রেখে বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব আনয়ন। সাধারণত চেষ্টা থাকে টেকসই দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে প্রতিটি প্রকল্পের কাজ করার। যেকোনো কাজ পাওয়ার পর ঠিক করা হয় এটা কী ধরনের কাজ। আবাসিক না বাণিজ্যিক ভবনের। যদি আবাসিক কাজ হয়, সেখানে কৃত্রিমতাকে যতটা সম্ভব বাদ রেখে কাজ করা হয় প্রাকৃতিক আলো নিয়ে। আজকাল ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট কেবিনেট কিংবা রান্নাঘরটি সাজানো হয় সুন্দর অবয়বে।

পেইন্টিংস

বাণিজ্যিক ভবনে সঠিক লাইটিং, সিলিংয়ের মতো বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করা হয়। অফিস ডিজাইনের সময় চেষ্টা করা হয় অফিশিয়াল লুক দিতে। এরপর বিশেষ নজর দেওয়া হয় কাজের ক্ষেত্রটিতে। এই জায়গাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে অফিসের কর্মীদের কাজ করতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। ওয়ার্ক প্লেসের সাজসজ্জাটা রাখা হয় গ্রাহকের চাহিদামতো। একই জায়গায় অধিকাংশ লোক কাজ করলে পার্টিশন দিয়ে আলাদা জায়গা তৈরি করা হয়। আর যদি আলাদা আলাদা রুম হয় তবে থাই গ্লাস কিংবা কাঠ দিয়ে রাখা হয় এ রকম ব্যবস্থা।

বাধা যেখানে

আমাদের এখানে সাধারণত মেয়েদের কাজের সুযোগ পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। যেকোনো কাজেই বাধা আসবে তাতে থেমে থাকলে চলবে না। ভালো কাজে সুউদ্যোগ নিতে হবে। গুণগতমান ঠিক রেখে প্রতিটি কাজ করলে সাফল্য আসবেই। অবশ্য কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ শেষে পেমেন্ট কালেকশন করাটা মাঝেমধ্যে কষ্টকর হয়ে পড়ে।

বিআই লিমিটেড অফিস, মতিঝিল

আমাদের দেশে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হলেও প্রকল্পভিত্তিক ভালো কাঁচামালের সংকট রয়েছে। এ জন্য প্রায়ই বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনতে হয়, যা ব্যয়বহুল। একজন নতুন স্থপতি ও উদ্যোক্তার জন্য এ এক বিরাট সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে।

যোগাযোগ : অহনা অ্যান্ড আর্কিটেক্ট (এ অ্যান্ড এ), ১৩/১৭ শান্তিনগর বাজার রোড, ঢাকা।                                                                        

আফরিন

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top