একজন স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না নাজলি হোসেনের। মানুষের জীবনে অনেক কিছুই ঘটে অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সম্মানজনক এ পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে করেছেন নিরন্তর পরিশ্রম। আজকের স্থপতি নাজলি হোসেন হতে নিয়েছেন অনেক ঝুঁকি। ‘কিছুই শিখতাম না, যদি ঝুঁকি না নিতাম।’ এমনটাই মনে করেন তরুণ এ স্থপতি। এই পেশায় নিজস্ব অবস্থান সুদৃঢ় করতে পিছিয়ে পড়েছেন বারবার, হয়েছেন প্রতারণার শিকার। তাই বলে দমে যাননি। নিজের একান্ত চেষ্টা ও বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় নব উদ্যমে প্রবহমান স্রোতের মতো এগিয়ে চলেছেন, গড়ে তুলেছেন স্থাপত্য ও ইন্টেরিয়র ফার্ম প্রাকজিস আর্কিটেক্টস্।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সফলতার সঙ্গে ব্যাচেলর অব আর্কিটেক্টস পাস করার পর শুরু করেন তাঁর কর্মজীবন। সদ্য পাস করা একজন স্থপতির জন্য কোনো প্রকল্পে কাজ পাওয়া কত কঠিন তা তিনি জানতেন। আর তাই শিক্ষাজীবন শেষে চাকরি পাওয়াকেই উত্তম বলে মনে করেন তিনি। অবশ্য থিসিস চলাকালীন স্থপতি এন আর খানের হাত ধরে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে শুরু করেন শিক্ষকতা। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী শিক্ষক (টিএ) হিসেবে যোগ দেন।
এ সময়ে আত্মীয়দের সহযোগিতায় বেশ কিছু প্রকল্পের কাজও পেয়ে যান, পরে যা নিয়মিতই আসতে থাকে। ফেনীর একটি আবাস ভবনের কাজ ছিল তাঁর নিজস্ব প্রথম পরিপূর্ণ প্রকল্প। ‘কেউ নতুন প্রকল্পের অফার দেবে আর সঙ্গে সঙ্গে তা লুফে নেব এবং যা-ই করব ভালো করব এমন কখনো ভাবিনি।’ জানালেন তরুণ স্থপতি নাজলি হোসেন।

শিক্ষাজীবনেই বেশ কিছু কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের পঞ্চম বর্ষে পড়াকালীন হামিম গ্রুপের কাজ করেন। ছাত্রজীবনে লাকসামে একটি বাড়ির কাজ করে পাঁচ হাজার টাকা সম্মানি পেয়েছিলেন, যা আজও স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। এটাই ছিল তারুণ্যদীপ্ত এই স্থপতির প্রথম পাওয়া পারিশ্রমিক। কমলাপুরে ২৭৩ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত ভবনের কাজ করেছেন সফলতার সঙ্গে।
একসময়ে তাঁর কাজ স্থাপত্যকে ছাড়িয়ে ইন্টেরিয়রে ছড়িয়ে পড়ে। ইন্টেরিয়র-বিষয়ক বিশদ ধারণা থাকা সত্তে¡ও কাজটি করতে অপারগ ছিলেন তিনি। বিল্ডিং প্রজেক্ট করতে আগ্রহ নাজলি হোসেনের। পরবর্তী সময়ে তিনি এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসেন। কারণ, এখন স্থাপত্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ইন্টেরিয়র। একসময়ে বাবার আগ্রহে ইসলামী ব্যাংকের রাজধানীর একটি প্রকল্পের কাজ নেওয়ার প্রস্তাব দেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু নিজস্ব ফার্ম বা কোনো ফার্মে কর্মরত না থাকায় কাজটি পাওয়া তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি একদম নতুন আর কম বয়সী হওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজ পাওয়া হয়নি তাঁর। তবে এতে কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, পরবর্তী সময়ে স্বীয় যোগ্যতায় একই ব্যাংকের খুলনা শাখার প্রকল্পের কাজ পান তিনি। যদিও সেখানেও তাঁর বয়স নিয়ে কথা উঠেছিল। এত ঝুট-ঝামেলার পরও কাজটি সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেন। এ সময় মামার ফার্মে যোগ দিয়ে ফার্মটির হয়ে মিরপুর ৯-এ একটি ভবনের ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেন। এর পাশাপাশি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন, সেটা ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে।

চাকরি আর শিক্ষকতাতেও তৃপ্ত হতে পারছিলেন না স্থপতি নাজলি। এ পর্যায়ে এসে নাজলির উপলব্ধি স্বনামে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিজস্ব ফার্ম নতুবা কাজ নিতে হবে কোনো স্বনামধন্য ফার্মে। কেননা অন্যের কাজ করতে গিয়ে নিজের মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না। এই অনুভব থেকেই শুরু করলেন স্বাধীন স্থাপত্যকর্ম। প্রতিষ্ঠা করলেন প্রাকজিস আর্কিটেক্টস্ নামের নিজস্ব স্থাপত্য ফার্ম। একের পর এক করে গেলেন কনসালটেন্সি ও কনস্ট্রাকশনের কাজ। ২০১১ থেকে ঠিকাদারি কাজও শুরু করেন। পাশাপাশি চলতে থাকল ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজও। এভাবে কাজের প্রয়োজনে তিনি ছুটেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। খুলনা, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলায়। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘোরাঘুরিটাও হয়ে যায় একই সঙ্গে। এভাবেই খুঁজে পান কর্মব্যস্ত জীবনে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া।
প্রাকজিস আর্কিটেক্টস্-এর চলমান কিছু প্রকল্প
- শরীয়তপুরের বিনোদপুরে একটি পাঁচতলা বাড়ি, যেটাকে নির্মাতা স্বপ্নবাড়ি হিসেবে মনে করছেন।
- বাসাবোতে ১০ কাঠা জমির ওপর ১৪ তলাবিশিষ্ট ভবনের একটি প্রকল্প।
- বাড্ডা মডেল হাইস্কুল গলিতে চার কাঠা জায়গাজুড়ে নির্মিত হচ্ছে ৭ তলাবিশিষ্ট আবাসন প্রকল্প।
- টঙ্গীতে চলছে ১০ জন ইঞ্জিনিয়ারের সম্মিলিত আবাসন প্রকল্প।
- রামপুরা টিভি সেন্টারের বিপরীতে নির্মিত হচ্ছে আবাসিক ভবন।
ইন্টেরিয়র
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭০০০ স্কয়ার ফিটের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শাখা। গুলশানের ওমেন এন্টারপ্রেইনার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়।

ব্যাংক প্রকল্প
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) উত্তরা শাখা, ফেঞ্চুগঞ্জ শাখা, সাউথইস্ট ব্যাংক নরসিংদী আড়াইহাজার গোপালদি শাখা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ধানমন্ডি শাখা, কাওরান বাজার শাখা। এ সবকটি ব্যাংকের ইন্টেরিয়রের কাজ করেছেন স্থপতি নাজলি হোসেনের প্রাকজিস আর্কিটেক্টস্।
স্পেনের একটি কোম্পানির ELCORTE ENGLES ব্যাংক ইন্টেরিয়র ডিজাইনসহ এযাবৎ ৬০টার মতো কাজ শেষ করেছেন। বিল্ডিং প্রজেক্ট করেছেন ১২টার মতো। মোট প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ৮০ থেকে ৯০টা। তবে নাজলি হোসেনের সবচেয়ে পছন্দের প্রকল্পের কথা জানতে চাইলে তিনি শরীয়তপুরের গোপালদি শাখার আবাসন কাজের কথা বলেন। এটি ছিল তাঁর এবং প্রাকজিস্-এর অনেক কষ্টের একটি প্রকল্প। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। শরীয়তপুরের এ আবাসনটা পানির ওপরে ভাসমান অবস্থায় দেখায়। তাই পছন্দের এবং গর্বের এই দুটো তালিকার একটি থেকেও বাদ পড়েনি এই প্রকল্পটি।

স্থপতি নাজলি হোসেনের জন্ম ২৩শে মার্চ ১৯৮৩। বাবা বেলায়েত হোসেন ও মা চেমনা আফরোজ। তানিয়া আফরোজ ও বেলা ওয়াদুদ এই দুই বোনের বড় তিনি। ভিকারুননিসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে এসএসসি ও ২০০০ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদপ্রাপ্ত হন।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৫ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩