আকাশছোঁয়া ভবন

প্রকৌশলী এমদাদুুুুল ইসলাম

আকাশছোঁয়া ভবন, সত্যি কী একটি ভবন আকাশ ছুঁতে পারে? আক্ষরিক অর্থে হয়তো পারে না, তবে বিশ্বে এমন কিছু ভবন আছে, যেগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আকাশের সঙ্গে ভবনটির বেশ মিতালি। এখন বিশ্বব‍্যাপী হাইরাইজ, ‘সুপার-ডুপার’ বা ‘মেগা’ (আকাশছোঁয়া) ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। তবে ১৭০০-১৮০০ শতকে ১০-২০ তলাবিশিষ্ট উঁচু স্থাপনা বা ভবনকেই আকাশছোঁয়া ভবন বলা হতো। যদিও এখনো হাইরাইজ বা স্কাইক্রাপার্সের সংজ্ঞা নিয়ে রয়েছে কিছুটা বিভ্রান্তি! যেমন বাংলাদেশে এখনো ১০ তলা ভবনকে হাইরাইজ ভবন বলা হয়। ১৭০০ শতকে যুক্তরাজে‍্যর স্কটল‍্যান্ডের এডিনবরায় স্টোনের তৈরি ১১-১৪ তলা আবাসিক ভবন বা ১৮৮৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে স্টিল ফ্রেমে তৈরি ১০ তলা অফিস ভবন (হোম ইনস্যুরেন্স বিল্ডিং) বা ১৮৪৯-৫০ সালে ফিলাডেলফিয়ায় নির্মিত ১০ তলা জায়েন বিল্ডিং সুউচ্চ ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপর ১৮৯৫ সালে নিউইয়র্কে নির্মিত ১০৩ মিটার বা ৩৩৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ২৩-২৬ তলার আমেরিকান শিওরিটি বিল্ডিং বহু বছর ধরে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে বিবেচিত ছিল।

তবে এর অনেক আগে (এমনকি খ্রিষ্টপূর্বেও) বিশ্বের অনেক দেশের তৎকালীন স¤্রাট, রাজা-বাদশাহ বা ধনাঢ‍্য ব‍্যক্তিদের আগ্রহে তাঁদের শৌর্যবীর্য প্রদর্শন বা নিজের স্বপ্নপূরণে বিভিন্ন সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব সময়কালে মিসরের গিজায় ৪৭৯ ফুট উচ্চতায় গ্রেট পিরামিড, ১৩১১ সালে ইংল‍্যান্ডে ৫২০ ফুট উচ্চতায় লিংকন ক্যাথেড্রাল, ১৬৩৫ সালে তাজমহল, ১৮৮৪ সালে ৫৫৫ ফুট উচ্চতায় ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, বা ১৮৮৭-৮৯ সালে প‍্যারিসের উপকণ্ঠে ১০৬৩ ফুট উচ্চতার আইফেল টাওয়ার ইত‍্যাদি নির্মিত হয়, যার সবই এখন সুউচ্চ ভবনের সমতুল‍্য! এসব প্রায় স্থাপনাগুলোই তখনকার স্থানীয় দক্ষ শিল্পী, কারিগর/প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের কায়িক পরিশ্রমেই নির্মিত হয়। যেখানে তখন হাজার-লাখ শ্রমিক ওই সব কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং আবার এগুলোর নির্মাণের সময় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক‚লতা ও দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে অসংখ‍্য কারিগর এবং শ্রমিক মারাও যান। এভাবে তখন বিভিন্ন দেশে স্থানীয় নানা প্রযুক্তি ও নির্মাণসামগ্রীর মাধ‍্যমে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অসংখ‍্য মনুমেন্টাল স্ট্রাকচার নির্মিত হয়।

১৯০০ শতকে দ্বিতীয় শিল্প-বিপ্লব, উন্নত কারিগরি প্রযুক্তির আবির্ভাব, নতুন নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ সহায়ক যন্ত্রপাতির মাধ‍্যমে তৎকালীন উন্নত/উন্নয়নাধীন কিছু দেশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ শুরু হয়। ওই প্রক্রিয়ায় ১৯০৩ সালে কংক্রিট টেকনোলজির রেইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট মাধ‍্যমে আমেরিকার ওহাইও নগরীর সিনসিনাতিতে ১৬ তলাবিশিষ্ট প্রথম আরসিসি উঁচু ভবন ইনগলস বিল্ডিং নির্মিত হয়, যখন ৪০ তলা (৪৯২ ফুট উচ্চতার) পর্যন্ত ভবনকে সুউচ্চ বা আকাশছোঁয়া ভবন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন নিউইয়র্কের ম‍্যানহাটানে স্টিল ফ্রেমে ২২ তলা ফুলার বা ফ্লাটির বিল্ডিং নির্মিত হয়। এরপর ১৯৩০-৩১ সালে নিউইয়র্কের ম‍্যানহাটানে ইট ও এমএস রডের সমন্বয়ে ১ হাজার ৪৬ ফুট উচ্চতায় দ্য ক্রাইসলার টাওয়ার এবং ১ হাজার ৪৫৪ ফুট উচ্চতার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং ভবনগুলো নির্মিত হয়, যা ছিল তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন। তারপর ১৯৭৩ সালে ১ হাজার ৩৬৮ ফুট উচ্চতায় নির্মিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (টুইন টাওয়ারস) বহুদিন (১৯৭৩-২০০১ পর্যন্ত) বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল।

সে সময় (তৃতীয় শিল্প-বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বে নির্মাণাধীন উঁচু/সুউচ্চ ভবনের মনিটরিং ও বিভিন্ন পরামর্শে কাউন্সিল অন টল বিল্ডিংস অ্যান্ড আরবান হ্যাবিট্যাট শীর্ষক একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটি সুস্পষ্টভাবে উঁচু/সুউচ্চ ভবন, সুপার টল ও মেগা টল বিল্ডিংসকে সংজ্ঞায়িত করে। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ৩০০ মিটার বা ৯৮৩ ফুট উঁচু ভবনকে ‘সুপার টল’ ও ৬০০ মিটার বা ১ হাজার ৯৬৯ ফুট উঁচু ভবনকে ‘মেগা টল’ বলা হয়। তবে অনেক সুপার টল ও মেগা টল বিল্ডিংসের ওপরে আবার যোগ হয় ভ্যানিটি হাইটস, যা ইমারতের বসবাসযোগ‍্য টপ ফ্লোর থাকে ভবন/স্থাপনার সর্বোচ্চ পয়েন্ট (পিনাকেল) পর্যন্তকে অংশকে বোঝায়। তবে কিছু সুউচ্চ ভবনে এই ভ্যানিটি হাইটস নিয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে অনেক সুউচ্চ ভবনের সঠিক উচ্চতা নির্ধারণে জটিলতাও দেখা দেয়!

অন‍্যদিকে কংক্রিট টেকনোলজি তথা রিইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিটের মাধ‍্যমে অনেক আগে থেকে বহুতল ভবন নির্মাণ করা শুরু হলেও তা দিয়ে সুউচ্চ ভবন বা সুপার টল ও মেগা টল বিল্ডিং নির্মাণে সমস‍্যা দেখা দেয়। কারণ এতে ইমারতের ভার্টিক্যাল বা ডেড লোডস খুব বেশি বেড়ে যাচ্ছিল। এ জন‍্য আকাশছোঁয়া ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণ পদ্ধতি ৪০-৫০ তলা ওপরের বহুতল ভবনের চেয়ে ভিন্নতর হয়ে যায় অর্থাৎ সুউচ্চ/সুপার টল বা মেগা টল ভবনের স্ট্রাকচারাল সিস্টেমসে বিভিন্ন ধরনের উন্নত ব‍্যবস্থা যেমন টিউব স্ট্রাকচারস, আউটরিগার বা বাস্ট্রেস কোর ইত‍্যাদির মাধ‍্যমে ডিজাইন করতে হয়। এভাবে ১৯০০ শতকের শুরু থেকে বহুতল ভবন বিভিন্ন পদ্ধতিতে ডিজাইন এবং নির্মাণ করা হলেও গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অর্থাৎ ১৯৫০-৬০ সাল থেকে এর পুরো পদ্ধতিই পাল্টে যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরই সন্তান প্রকৌশলী ও স্থপতি এফ আর খান (ফাদার অব টিউবলার ডিজাইন)-এর উদ্ভাবিত তত্ত¡ যেমন শেয়ার ওয়াল, ফ্রেমড/ট্রাসড টিউব, বান্ডিলড টিউব ইত‍্যাদি ডিজাইন কনসেপ্ট বা স্ট্রাকচারাল সিস্টেম আকাশছোঁয়া ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণের পূর্বেকার পদ্ধতিকে পাল্টে দেয়। তিনি সে সময় অটোক্যাডেরও অন‍্যতম উদে‍্যাক্তা ছিলেন। এই কম্পিউটার এইডেড অ্যনালিস্টস অ্যান্ড টিউবলার পদ্ধতিতে ১৪০ তলা পর্যন্ত সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা সম্ভব, যা তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আমেরিকায় অনেক সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করে বিশেষ করে শিকাগোতে ১ হাজার ৪৫০ ফুট উচ্চতায় আকাশছোঁয়া সিয়ার্স টাওয়ার পরবর্তী সময়ে উইলস টাওয়ার এবং জন হান কক ভবন ডিজাইন ও নির্মাণ করে তাঁর উদ্ভাবিত তত্তে¡র প্রমাণ করে দেন।

আরও উল্লেখ‍্য, সাধারণত ১০-২০-৪০ তলা পর্যন্ত‍ বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে ভার্টিক্যাল/ডেড লোডস গভার্ন করে, তাই এতে ল্যাটারাল লোডসের প্রভাব অনেকটা উপেক্ষা করা হয়। আর সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ল্যাটারাল তথা আনুষঙ্গিক লোডস (যেমন ভূমিকম্প, বায়ু লোড ইত্যাদি) বেশি গভার্ন করে- বিশেষ করে সুউচ্চ ইমারতের ড্রিফট, সয়ে ইত‍্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন‍্যই এই ব‍্যবস্থা গৃহীত হয়। এসব বিষয়াদি নিয়ে প্রকৌশলী এফ আর খানের টিউবলার কনসেপ্ট উদ্বোধনের পর পর্যায়ক্রমে আরও অনেক দক্ষ প্রকৌশলীর উন্নত গবেষণার মাধ‍্যমে বর্তমানে বিশ্বব‍্যাপী আকাশছোঁয়া ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণ অনেক সহজতর হয়ে গেছে। সে সঙ্গে অতি উঁচু ভবনের ভাইব্রেশন নিয়ন্ত্রণে টিএমডিএস অর্থাৎ টিউনড ম্যাস ড্যাম্পার্স আবিষ্কারের পর ভবনের উচ্চতা আরও অধিকতর বৃদ্ধি করারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীনে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। যেমন চীনে (২০২৩ সাল পর্যন্ত) ১৫০ মিটার বা ৪৯০ ফুট উচ্চতায় ৩ হাজারের মতো ভবন রয়েছে, যার মধে‍্য ১০৬টি সুপার টল আর মেগা টল বিল্ডিংস। আর একটি ছোট্ট দেশ হিসেবে হংকংয়ে রয়েছে ৬৫৭টা সুউচ্চ ভবন, যার মধ্যে ৬টা সুপার টল বিল্ডিং।

বর্তমানে বিশ্বে ভিজিটাল বিজ্ঞানের বিকাশ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ শিল্পও এখন বেশ আধুনিক। এখন সব বহুতল বিশেষ করে সুপার ও মেগা টল বিল্ডিংগুলো অধিকতর উন্নত ডিজাইন পদ্ধতি অর্থাৎ ঝঞঅঅউ চৎড় সফটওয়‍্যারের মাধ‍্যমে হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক দেশে এখন সুউচ্চ ভবন নির্মিত হচ্ছে রোবোটিক টেকনোলজিতে। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বাংলাদেশের আরেক প্রকৌশলী ফিরোজ আলম সুউচ্চ আকাশছোঁয়া ভবনের ডিজাইনে ‘প্যারালাল শেয়ার ওয়ালস (চঝড) অ্যান ইনোভেশন কনসেপ্ট অন মেগা টল বিল্ডিংস’ শীর্ষক এক গবেষণাগ্রন্থে তাঁর এই নতুন পদ্ধতি রচনা করেছেন। তাঁর গবেষিত ‘চঝড’ পদ্ধতিতে নাকি ভবিষ্যতে এক কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত ভবন নির্মাণ সম্ভব হবে! এভাবে এখন যেখানে যাদের সামর্থ‍্য আছে, সেখানে আধুনিক কারিগরি উৎকর্ষ তথা স্মার্ট টেকনোলজিতে ডিজাইন এবং রোবোটিক পদ্ধতিতে আকাশচুম্বী ভবনের পরিকল্পনা ও নির্মাণ অব‍্যাহত আছে।

বর্তমানে বিশ্বব‍্যাপী ৩০০ মিটারের নিচে অসংখ‍্য উঁচু ভবন রয়েছে। সুপার টল বিল্ডিং রয়েছে ২০০ মতো! তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সিডনি টাওয়ার, মালয়েশিয়ায় পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, নিউইয়র্কে ব্যাংক অব আমেরিকা টাওয়ার, তাইওয়ানে তাইপে ১০১, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ার, চীনে জিফেঙ টাওয়ার উল্লেখযোগ‍্য। তবে বিশ্বজুড়ে মেগা টল বিল্ডিংসের সংখ‍্যা এখনো মাত্র চারটি, যদিও ডিজাইন এবং নির্মাণে রয়েছে আরও অনেক মেগা টল বিল্ডিংস। এই পর্যন্ত নির্মিত মেগা টল বিল্ডিংগুলো হলো বুর্জ খলিফা (দুবাই), মারদেকা টাওয়ার (কুয়ালালামপুর), সাংহাই টাওয়ার (সাংহাই) এবং মক্কা ক্লক টাওয়ার (সৌদি আরব)। তা ছাড়া নির্মাণাধীন ও প্রস্তাবিত রয়েছে আরও ১৩টি মেগা বিল্ডিংস, যার মধ্যে সৌদি আরবে (জেদ্দা বা কিংসডম টাওয়ার ও রাশিয়ার সেন্ট পিটারসবার্গে আরেকটি মেগা টল বিল্ডিং নির্মাণাধীন এবং অচিরে জাপানে স্কাই মাইল টাওয়ার ও কুয়েতে বার্জ মোবারকের মতো আকাশছোঁয়া ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পথে। আর এসব প্রতিটা আকাশছোঁয়া ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণের সঙ্গে বিশ্ববরেণ‍্য স্থপতি ও প্রকৌশলীরা এবং নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত।

তবে আন্তর্জাতিক সুউচ্চ ভবনবিষয়ক সংস্থা (ঈঞইটঐ)-এর মতে, আমেরিকায় নাইন-ইলেভেনে টুইন টাওয়ারসে হামলা তথা বিশ্বব‍্যাপী যুদ্ধ ও যুদ্ধ-উত্তর পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণে ধীরগতি শুরু হয়েছে। যদিও সমসাময়িক সময়ে এর মধ্যে মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুরে পেট্রোনাস টাওয়ার, দুবাইয়ে বুর্জ খলিফা টাওয়ারসহ অনেক দেশে আরও কিছু সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে। আবার বিশ্বব‍্যাপী করোনা মহামারি-উত্তর পরিস্থিতি তথা অন‍্যান‍্য বিভিন্ন কারণে (যেমন পরিবেশ-প্রতিবেশের সংরক্ষণে) অনেক দেশ এখন এ ধরনের আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণ থেকে আপাতত দূরেও সরে এসেছে। চীনে আকাশছোঁয়া নতুন ভবন নির্মাণে অনেক বিধিনিষেধও জারি করা হয়েছে। এসব কারণে এখন সৌদি আরব, জাপান ও কুয়েতের মতো দেশেও মেগা টল বিল্ডিংস প্রকল্পের কাজে ধীরগতি লক্ষ‍ করা যাচ্ছে!!

বাস্তবে একেক দেশের আবহাওয়া, অবস্থান, অর্থনীতি, লোকসংখ‍্যা ও বহুতল ইমারতের প্রয়োজন একেক রকম। তবে সুউচ্চ বা আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর বেশির ভাগই প্রায় একই রকম। এ ক্ষেত্রে এখনো বেশির ভাগ দেশেই যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ হয়ে চলছে। তবে চীনেই এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উঁচু ভবন নির্মিত হয়েছে। তবে ‘করোনা-পরবর্তী’ অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিশ্ব‍ব‍্যাপী যুদ্ধ ও যুদ্ধ-উত্তর পরিবেশে প্রায় দেশে এসব সুউচ্চ ভবনে ব‍্যবহারকারীও অনেক কমে গেছে। চীনে পাঁচটি আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মি. স্মিথ বলেন, বিগত বছরগুলোতে চীন অনেক সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করেছে, যার আসলে কোনো প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। আবার অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ করলে একটি দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয় না! এই অবস্থা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। যার দরুন বিগত অনেক দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আর তেমন কোনো সুউচ্চ বা মেগা বিল্ডিংস নির্মিত হয়নি।

কথা হলো, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো যখন নিজেদের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অবস্থা বিবেচনা করে আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ নিয়ে নতুন করে গবেষণা করছে, তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী রকম? বিশাল জনসংখ‍্যার আবাসন ও কর্মক্ষেত্রের চাপে রাজধানী ঢাকাতে তো বটেই, দেশের অপরাপর নগর/শহর এবং পৌর এলাকায়ও দিন দিন উঁচু ভবনের সংখ‍্যা বাড়ছে, যদিও এর বেশির ভাগই অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হচ্ছে! ঢাকার তেজগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ৩৮-৪০ তলাবিশিষ্ট ‘পিনাকেল’ এখনো ঢাকার সবচেয়ে উঁচু ভবন। আবার কারিগরি বোদ্ধামহলেও এ নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের জনসংখ‍্যা ও অর্থনীতির বিবেচনায় দেশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের প্রয়োজন কতটুকু তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে!

আসলে চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সেই অর্থে বাংলাদেশে এখনো কোনো আকাশছোঁয়া অর্থাৎ সুপার টল বা মেগা টল বিল্ডিংস নেই, যদিও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে রাজধানীর আশপাশে কিছু সুউচ্চ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং আরও অনেকে চিন্তাভাবনাও করছেন। যেমন দেশে প্রথম এই ধরনের প্রথম ও আন্তর্জাতিক মানের একটা সুউচ্চ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে। সেখানে ১৯ নম্বর সেক্টরের সিবিডি এলাকায় তিনটি সুউচ্চ টাওয়ারকে কেন্দ্র করে একটি নান্দনিক বিজনেস হাব, কনফারেন্স ও কনভেনশন সেন্টার, হাসপাতাল, স্কুলসহ উন্নতমানের আবাসন ও ট্রাফিক ম‍্যানেজমেন্টের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ জন‍্য রাজউক ইতিমধ্যে পূর্বাচল প্রকল্পের সিবিডি এলাকায় ১০০ একর জমিও বরাদ্দ করেছে।

এই প্রকল্পের আওতায় রাজউক সেখানে ১৪২ তলাবিশিষ্ট একটি আইকনিক টাওয়ার নির্মাণের জন‍্য সর্বোচ্চ দরদাতাকে জমির বরাদ্দপত্র জারি করে। সম্প্রতি অনেক টানাপোড়েন তথা দেন-দরবারের পর বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি (ঈঅঅই) ওই জমির ওপর ৪৭৩ মিটার বা ১ হাজার ৫৫২ ফুট উচ্চতায় সুউচ্চ ভবন নির্মাণের জন‍্য ছাড়পত্র প্রদান করেছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ‘শিকদার গ্রæপের’ সিস্টার কোম্পানি ‘পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস’ লিমিটেড এবং জাপানের ‘কাজিমা করপোরেশন’-এর যৌথ উদে‍্যাগে। এটির ডিজাইনের সঙ্গে জড়িত হতে চলেছে বিশ্বের নামীদামি স্থপতি, প্রকৌশলীরা এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২৮-৩০ সালের দিকে প্রকল্পটি দৃশ্যমান হওয়া শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে!

এটি বাস্তবায়িত হলে এটাই হবে দেশের প্রথম সুপার টল বিল্ডিং। সতি‍্যকার অর্থে, এই প্রকল্পটির বাস্তবায়নের মাধ‍্যমে বাংলাদেশে আকাশছোঁয়া বা সুউচ্চ ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা, বাস্তবতা ও ভবিষ‍্যৎ স্থির হবে! তবে এটা ঠিক যে আমাদের মতো দেশে বিশেষ করে অল্প জমিতে এত বিশাল মানুষের দেশে এখন উঁচু বা সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করে কৃষিজমি, পাহাড় ও জলাভূমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদেরই বাস্তব প্রয়োজনে রাজধানীসহ দেশের আর কোথায় এসব সুউচ্চ ভবনের পরিকল্পনা করা যায়, তার একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি।

তবে প্রতিটা সুউচ্চ ভবন বিশেষ করে সুপার টল ও মেগা টল বিল্ডিং নির্মাণ খুবই চ‍্যালেঞ্জের। আশার বিষয়, তৎকালীন বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবনের এক স্থপতি ডিজাইনারের জন্মতারিখ অনুসারে প্রতিবছরের ৩ সেপ্টেম্বর তারিখকে বিশ্ব স্কাইক্রাপার্স ডে হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top