অন্দরসজ্জায় সর্বত্রই এখন আধুনিকতার ছোঁয়া। এ থেকে ঘরের দরজাই বা কেন বাদ যাবে? হাজার বছর ধরে দরজা তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে কাঠ। লোহা, বাঁশ, চাটাইয়ের দরজাকে ছাপিয়ে এক সময় কাঠের তৈরি দরজা জনপ্রিয়তায় ছিল শীর্ষে। দিন বদলের সাথে সাথে সব কিছুতে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। মানুষের রুচিতেও এসেছে পরিবর্তন। তাই তো কাঠের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, পারটেক্স, প্লাইউডসহ প্রক্রিয়াজাত সব কাঠ। তবে দীর্ঘস্থায়ী ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে প্লাস্টিক ডোরের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
গৃহ নির্মাণের সাথে দরজার সম্পর্ক প্রাচীন। ‘প্রবেশ এবং বাহির’ এ দুই ধরনের জাগতিক প্রয়োজনের সমীকরণই দরজা। তবে দরজাকে ঘিরে নিরাপত্তার বিষয়টিই চলে আসে সবার আগে। এর সঙ্গে সৌন্দর্য ও রুচিবোধের বিষয়টিও যুক্ত। অতীতে কাঠের কারিগরেরা কাঠ খোদাই করে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে দরজায় নকশা করত। দরজাগুলো তাদের হাতের জাদুকরী স্পর্শে হয়ে উঠত শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন। তবে বিশ্বব্যাপী বনভূমি ধ্বংসের ফলে কাঠ হয়ে উঠছে দুষ্প্রাপ্য। দামও চলে যাচ্ছে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। ফলে বিশ্বজুড়ে দরজায় কাঠের ব্যবহার কমছে ধীরে ধীরে। এটি কিছুটা একঘেয়েমিতাও আনছিল। চাহিদা আর ভিন্ন কিছুর প্রত্যাশায় জনপ্রিয়তা পেতে থাকে প্লাস্টিক ডোর বা দরজা। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে প্লাস্টিক ডোরের ব্যবহার। চাহিদার কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে বাজারে এনেছে প্লাস্টিকের চমৎকার সব দরজা। বিশেষত নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে এসে বাংলাদেশে প্লাস্টিক ও প্লাইউডের তৈরি দরজার ব্যবহার বেড়েছে। এই দরজাগুলোর রঙে, ডিজাইনে, আকার ও সাইজে রয়েছে ভিন্নতা, যা আপনার বাড়ি বা ফ্ল্যাটের বসার ঘর, শোওয়ার ঘর, খাবার ঘর, এমনকি বাথরুমেও ব্যবহার করতে পারবেন। প্রত্যেকটি ঘরের জন্য আলাদাভাবে নির্মিত এই দরজাগুলোর ব্যবহারে প্রকাশ পায় স্বাচ্ছন্দ্য, আভিজাত্য ও সুরুচির। তবে পানিরোধক ক্ষমতা থাকায় বাথরুম ও রান্নাঘরে প্লাস্টিকের দরজার ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে।

বাহারি নকশা
আধুনিক এ সময়ে ঘরের প্রতিটি জিনিস হওয়া চাই নান্দনিক। ঘরের দরজাতেও এর ব্যতিক্রম নয়। ঘরের রঙের বা ডেকোরেশনের সঙ্গে কী ধরনের দরজা ব্যবহার করলে ফুটে উঠবে আধুনিক সৌন্দর্য, তা নিয়ে হরহামেশাই চলে চিন্তাভাবনা। কাঠের দরজার বিভিন্ন নকশা যেমনÑ ফুল, লতাপাতা, অ্যাবস্ট্রাক্ট ইত্যাদি ডিজাইনের কথা মাথায় রেখেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দরজাকে সাজিয়েছে বাহারি ডিজাইনে। ঘরের দেয়ালের বিভিন্ন রঙের সাথে মিল রেখেই দরজাগুলোকে রাঙানো হয়েছে। এ ছাড়াও শোওয়ার ঘর, বসার ঘর, রান্না ঘর ও বাথরুমের দরজার ডিজাইনে আনা হয়েছে ভিন্নতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নকশি ফুলের কাজ। ফুলগুলোয় বাড়তি সৌন্দর্য দিতে কিছুটা ঢেউ তোলা বা অ্যাম্বুশ লুক দেওয়া হয়েছে। নকশা ছাড়াও প্লেন দরজাও রয়েছে, যা ফুটিয়ে তোলে আলাদা সৌন্দর্য। ডাইনিং বা ড্রয়িং রুমে বসে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে মজার গল্পকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতে কারুকাজ খচিত প্লাস্টিক ডোর রাখে অনন্য ভূমিকা।
ইন্টেরিয়রের যোগসূত্র
এখন অনেকেই তাদের ঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ব্যাপারে দারুণ সচেতন। ঘরের আকার, রঙ, আসবাবপত্র, বিছানার চাদর, জানালার পর্দা ইত্যাদির একটার সাথে আরেকটির সম্পর্ক রাখতে করা হয় নানা আয়োজন। সেই আয়োজনকেই আরো রাঙিয়ে দিতে প্লাস্টিক দরজাকে সাজানো হয় আকর্ষণীয় রঙ ও ডিজাইনে। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের প্লাস্টিক দরজাগুলোর নামকরণ ও ডিজাইনে ভিন্নতা এনেছে। এর মধ্যে রয়েছে সলিড, গোল্ড, ক্ল্যাসিক, প্লাটিনাম, পপুলার, ফ্লোরাল প্লাস্টিক ডোর। এগুলো একটির থেকে অন্যটি আলাদা মোটিফে। রঙ বৈচিত্র্যেও আনা হয়েছে ডার্ক বা হালকা কালার। কিছু ডোরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রাচীন রাজকীয় ডিজাইন। আধুনিক ফ্লোরাল ও অ্যাবস্ট্রাক্ট ডিজাইন মোটিফেরও অনেক ডিজাইন আনা হয়েছে বাজারে। কিছু প্লাস্টিক দরজাতে কাচের সমন্বয়েও বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। পানি ও খারাপ আবহাওয়ায় নষ্ট হয় না বলে সারা বছর ধরেই প্লাস্টিক ডোরগুলো থাকে দারুণ উজ্জ্বল।
বিশেষত্ব
এই দরজার প্রধান বৈশিষ্ট্য, এটি হালকা ও সহজেই বহনযোগ্য। যেখানে ভালো কাঠ দিয়ে তৈরি একটি দরজার দাম পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, সেখানে একটি প্লাস্টিকের তৈরি দরজার দাম পড়ে মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। দাম কম বলে এর স্থায়িত্ব, গুণগতমান বা সৌন্দর্যে কমতি নেই। বরং অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি হওয়ায় বাহ্যিক সৌন্দর্য ও মানের বিচারে অনেক সময় কাঠকেও হার মানায়। বাংলাদেশে বিকল্প দরজা উৎপাদকরা মনে করছেন, দেশের বনভূমি যে হারে উজাড় হচ্ছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে প্লাাস্টিক আর প্লাইউডের দরজা হয়ে উঠতে পারে কাঠের দরজার বিকল্প। সে ক্ষেত্রে কাঠের তৈরি দরজা হয়ে যাবে বিলাস সামগ্রী। আর তাই দেশে প্রতিবছর প্লাস্টিক ও প্লাইউড দিয়ে তৈরি দরজার ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। কাঠের দরজার একমাত্র বিকল্প হতে না পারলেও কাঠের দুষ্প্রাপ্যতার প্রেক্ষাপটে এবং তুলনামূলকভাবে দামে সস্তা ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ার কারণে প্রক্রিয়াজাত উপাদানে তৈরি প্লাস্টিক ও প্লাইউডের দরজার প্রচলন দিন দিন বাড়ছে। দেশে ভবন ও অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে চাহিদার যোগান দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। তাই প্রতিষ্ঠানগুলো এই চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়েই তৈরি করছে বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙের প্লাস্টিক ও প্লাইউডের দরজা; যাতে প্রাধান্য পাচ্ছে বিভিন্ন মানুষের রুচি ও চাহিদা। বিভিন্ন আয়তনের অ্যাপার্টমেন্টের হিসেব অনুযায়ীই ছোট-বড় সব সাইজের প্লাস্টিক ও প্লাইউডের দরজা পাওয়া যাচ্ছে বাজারে, যা আপনার ঘর সাজাতে অন্য সব আসবাবের সঙ্গে ঘরের আভিজাত্যে যোগ করবে ভিন্ন মাত্রা।

ব্যবহারে যত সুবিধা
বর্তমানে প্লাস্টিক দরজাগুলো আধুনিক মেশিনে উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি, যা পণ্যের সঠিক গুণগতমানের নিশ্চয়তা দেয়। এই দরজা ব্যবহারের সব চেয়ে বড় সুবিধা, এটি পানিরোধক হওয়ায় ক্ষয় হয় না, ফুলে ওঠে না কিংবা ঘুণে ধরে না। দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই দরজা রোদে ও তাপে বাঁকা বা রঙ নষ্ট হয় না। এটি নমনীয়, যা একটি প্লাস্টিক পণ্যের অন্যতম গুণগত মানদন্ড হিসেবে বিবেচিত; সহজে ভাঙে না। ইউপিভিসি দরজা ও চৌকাঠ খুবই উন্নতমানের প্লাস্টিক রেজিন দ্বারা তৈরি। এটার অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, দরজাগুলো আগুন সুপরিবাহী নয়। উন্নতমানের এ দরজাগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় বলে ফিটিংস কখনও খুলে আসে না এবং পাল্লা ঝুলে পড়ে না। কাঠের দরজার মতো এ দরজায় রঙ বা বার্নিশের প্রয়োজন হয় না। ফলে নিশ্চিন্তে অফিস, ব্যাংক, বীমা, শো-রুম, ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও অন্যান্য স্থাপনার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দরজাগুলো ব্যবহার করা যায়।
দরদাম ও প্রাপ্তিস্থান
অধুনা প্লাস্টিক ডোরের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বাড়ায় এখন প্রায় সারা দেশের শহরগুলোতেই পাওয়া যাচ্ছে ঘর তৈরির প্রয়োজনীয় এ অনুষঙ্গটি। রাজধানীতে প্লাস্টিকের এই দরজাগুলো পাওয়া যাবে পান্থপথ-সোনারগাঁও রোডের পার্শ্ববর্তী দোকানগুলোতে, কারওয়ানবাজার ও হাতিরপুলে। এ ছাড়া নয়াবাজার, মিরপুর, রোকেয়া সরণি, বংশাল, ফকিরাপুল, বাড্ডা ও কুড়িল বিশ্বরোডে পাইকারি ও খুচরা দরে প্লাস্টিকের তৈরি এ দরজাগুলো পাওয়া যায়। ব্র্যান্ড, সাইজ ও ডিজাইনের ভিন্নতায় দরজার দামও ভিন্নরকম। বাজারে আরএফএল, নাভানা ফার্নিচার, অটবি ফার্নিচার, আকতার ফার্নিশার্স, ব্রাদার্স ফার্নিশার্সসহ বিভিন্ন ডিজাইনের মানসম্পন্ন ও টেকসই প্লাস্টিক ডোর পাওয়া যায়। এসবের দাম পড়বে ২০০০ থেকে ৬০০০ টাকা। এ ছাড়াও ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে প্লাস্টিক ডোরের ফ্রেম পাওয়া যায়।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩১ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১২