স্ট্রাকচার বা কাঠামোর গুরুত্ব অনুসারে কংক্রিট দুই ভাগে বিভক্ত- ১. সিমেন্ট কংক্রিট (সিসি), ২. রিইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট (আরসিসি)। সিসি সাধারণত নন-স্ট্রাকচারাল মেম্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এবং স্ট্রাকচারাল মেম্বরের ক্ষেত্রে আরসিসি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ফলে সিসি ঢালাইয়ের তুলনায় আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ অধিক গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে অনেক বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া জরুরি। একটি আরসিসি ঢালাই সম্পন্ন করার জন্য যেসব কাজ করতে হয়, তাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- ১. শাটারিং, ২. রড বাইন্ডিং এবং ৩. ঢালাই বা কংক্রিটিং। কংক্রিট ও কংক্রিটিং সম্পর্কে গত সংখ্যায় আলোচনা করা হয়েছে। এবারের আলোচ্য বিষয় ১. শাটার ও শাটারিং এবং ২. রড ও রড বাইন্ডিং।
শাটার ও শাটারিং
কংক্রিট ঢালা এবং জমানোর জন্য কাঠ-বাঁশ কিংবা স্টিলের সেকশন ও শিট ব্যবহারে তৈরি বাক্স বা খাঁচাকে শাটার এবং তা তৈরির কাজকে শাটারিং বলা হয়। কোনো আরসিসি স্ট্রাকচার নির্মাণ করার জন্য ডিজাইন ও ড্রয়িং হাতে পাওয়ার পর অত্র স্ট্রাকচারের গুরুত্ব ও উচ্চতা বিবেচনা করে প্রথমে শাটারিংয়ের মালামাল নির্বাচনের মাধ্যমে শাটারিং করা হয়। প্রতিটি শাটার ঢালাইকৃত কংক্রিট ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট মজবুত এবং ওয়াটারটাইট হওয়া জরুরি। কারণ, কংক্রিট ঢালাইয়ের পর তা জমাট বাঁধা এবং প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চার করা পর্যন্ত শাটারের ভূমিকাই মুখ্য। আমাদের দেশে ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে অতীতে বহুতল ভবনের প্রচলন না থাকায় শাটারিংয়ের কাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাঠ-বাঁশ ব্যবহার করা হতো, যা সহজলভ্য এবং স্টিলের তুলনায় ব্যয়সাশ্রয়ী, বিশেষ করে বহুতলবিশিষ্ট ইমারত নয় এমন ক্ষেত্রে কাঠ-বাঁশের শাটারিংই প্রণিধানযোগ্য।
কাঠ-বাঁশ দিয়ে তৈরি শাটার সাধারণত পাঁচ-ছয়বারের অধিক ব্যবহার করা যায় না। কাঠের শাটার পাঁচ-ছয়বারের অধিক ব্যবহার করলে কংক্রিটের গুণগত মান ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু স্টিলের তৈরি শাটার ৫০-এর অধিকবার পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। ফলে নির্মিতব্য স্ট্রাকচারের গঠন, তলা এবং কাজের গুণগত মান বিবেচনা করে শাটারিংয়ের মালামাল নির্বাচন করা অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া শাটার তৈরি এবং ফিটিং-ফিক্সিংয়ের কাজটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কংক্রিট ঢালাই করার পর তা জমাট বাঁধার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শক্তভাবে কংক্রিট ধরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। শাটার অবশ্যই ওয়াটারটাইট হতে হবে, যাতে কংক্রিট ঢালার পর কোনোভাবে কংক্রিটের তরল অংশ (পানি ও সিমেন্টমিশ্রিত স্ল্যারি) শাটারিংয়ের ফাঁকা কিংবা জয়েন্ট দিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে। এ ছাড়া কংক্রিট ঢালাই করার পর শাটার খোলার জন্য স্ট্রাকচারভেদে যে সময়সীমা থাকে, তা মেনে চলা জরুরি। মনে রাখতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ের আগে শাটার খোলা হলে ত্রæটিপূর্ণ স্ট্রাকচার তৈরি হবে এবং নির্মিত ভবনের স্থায়িত্ব কমে যাবে। আমাদের দেশে মিস্ত্রিরা তাদের কাজের সময় বাঁচাতে কিংবা শাটারিং মালামালের ব্যবহার বাড়াতে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শাটার খুলে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে থাকে, যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

কাঠ-বাঁশ দিয়ে শাটারিংয়ের কাজ করতে হলে নির্মিতব্য স্ট্রাকচারের গুরুত্ব অনুসারে শাটারিং মালামালের গুণাগুণ নিশ্চিত করা দরকার। এই কাজের জন্য দাম একটু বেশি হলেও গর্জন কাঠ ব্যবহার করাই শ্রেয়। কারণ, শক্ত ও মজবুত শাটার এবং অধিকবার ব্যবহারের জন্য গর্জন কাঠের বিকল্প নেই। যদিও কাঠের দাম ও দুষ্প্রাপ্যতা বিবেচনা করে অনেক ক্ষেত্রে শাটার তৈরির কাজে আম কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে, তবে তা কোনোভাবেই ব্যয়সাশ্রয়ী নয়। আম কাঠের শাটার দুই-তিনবারের অধিক ব্যবহার করা যায় না। এ ছাড়া আম কাঠের শাটার একের অধিকবার ব্যবহার করলে ঢালাইয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ কিংবা স্থায়ী সম্পদ হিসেবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে স্টিল শাটারের কোনো বিকল্প নেই। তবে স্টিল শাটার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি শাটার কাজের শেষে ঠিকমতো পরিষ্কার করা, প্রয়োজনানুসারে রং করা এবং সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করার মতো বিষয়গুলোর ওপর তীক্ষè নজরদারি করা অপরিহার্য। উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো মাথায় রেখে শাটার ও শাটারিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা দরকার, যাতে শক্ত, মজবুত ও স্থায়ী একটি কাঠামো নির্মাণে কোনো রকম বিঘ্ন না ঘটে।
রড ও রড বাইন্ডিং
আগে আমাদের দেশে রডের প্রকারভেদ কম ছিল, ছিল গুণগত মানের নিশ্চয়তা। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক নানা ধরনের রড বাজারজাত করা হচ্ছে। মিডিয়াতে আসছে নজরকাড়া কিছু বিজ্ঞাপন। কিন্তু এসব মালামালের প্রকৃত গুণাগুণ নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে ল্যাব টেস্ট করা অত্যাবশ্যক। সুতরাং, যে কোম্পানির রড ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেই কোম্পানির বিভিন্ন সাইজের রড থেকে র্যানডাম কিছু স্যাম্পল কালেকশন করে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে রডের সার্বিক গুণাগুণ বিশ্লেষণপূর্বক অত্র রড কাজে লাগানো জরুরি। এ ছাড়া বাজারে বিভিন্ন গ্রেড ও মানের রড বিদ্যমান। ফলে প্রস্তাবিত ভবন বা স্ট্রাকচার নির্মাণকল্পে সংশ্লিষ্ট ডিজাইনার (ইঞ্জিনিয়ার) কোন গ্রেড এবং কী মানের রড ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে এবং ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে ব্যবহৃতব্য রডের কাক্সিক্ষত গুণাগুণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া শুধু মিস্ত্রির পরামর্শে কোনো রড বা অন্যান্য মালামাল ব্যবহার করা যাবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, আরসিসি স্ট্রাকচারের স্থায়িত্ব নির্ভর করে ডিজাইনমাফিক রড, সিমেন্ট, বালু, খোয়া ও পানির গুণাগুণ এবং পরিমাণ ঠিক রেখে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ওপর।

কাজে ব্যবহৃতব্য রড নির্বাচন করার পর ডিজাইন ও ড্রয়িং মোতাবেক সঠিকভাবে রড কাটা এবং বাঁধার (বাইন্ডিং) বিষয়টিও নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। রড কাটার ক্ষেত্রে ড্রয়িং অনুযায়ী বার শিডিউল (অর্থাৎ কোথায়, কোন সাইজ, কয়টি এবং কী সেইপের রড লাগবে তার তালিকা) তৈরি করে তদনুযায়ী রড কাটা, সোজা করা এবং বাঁধার ব্যবস্থা করতে হবে। আরসিসি ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি মেম্বরের জন্য আলাদা আলাদা ক্লিয়ার কভার দেওয়ার নির্দেশনা থাকে। তাই রডের খাঁচা তৈরির আগে প্রতিটি মেম্বরের নির্দেশনা অনুযায়ী কংক্রিটের ক্লিয়ার কভার অর্থাৎ রডের ওপর কত পুরুত্বে কংক্রিট থাকবে তা দেখে নিয়ে সে অনুযায়ী রড বাঁধা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে রডের ক্লিয়ার কভার ঠিক রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিয়ার কভার প্রয়োজনের তুলনায় কম হলে কংক্রিট সারফেসে ফাটল দেখা দেবে এবং ওই ফাটলের মাধ্যমে আর্দ্রতা প্রবেশ করে রড ও কংক্রিট উভয়েরই ক্ষতি করবে, যা ভবিষ্যতে পুরো স্ট্রাকচারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ ছাড়া ক্লিয়ার কভার বেশি হলেও রডের ইফেক্টিভ ডেইপথ কমে যাবে এবং একইভাবে পুরো স্ট্রাকচারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং কোনো স্ট্রাকচার নির্মাণকল্পে শুধু ভালো মানের রড ব্যবহার করেই আত্মতুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সবশেষে, রড বাইন্ডিংয়ের ক্ষেত্রে রডের স্পেসিং ঠিক রাখার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কোথায় কয়টি রড কত ইঞ্চি পর পর বাঁধতে হবে তা অবশ্যই ঠিকভাবে জেনে নিয়ে তদনুযায়ী রড বাঁধা নিশ্চিত করতে হবে। আরও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রডের ল্যাপিং বা জোড়া। কাজের সময় বিভিন্ন কারণে রড জোড়া দিয়ে লম্বা করার প্রয়োজন পড়ে। এই রড জোড়া দেওয়ারও নির্দিষ্ট একটি নিয়মাবলি আছে, যা অনুসরণ করা জরুরি। রডের ডায়া অনুসারে ভার্টিক্যাল এবং হরিজন্টাল মেম্বরের জন্য রডের ল্যাপ লেইন্থ আলাদা আলাদা হয়ে থাকে, যা সংশ্লিষ্ট ডিজাইনারের (ইঞ্জিনিয়ার) কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। যদিও এসব বিষয় সবিস্তারে ড্রয়িংয়ে উল্লেখ করা থাকে। তদুপরি ড্রয়িং সঠিকভাবে বোঝার একটি বিষয় থাকে। ফলে কাজ বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি ড্রয়িং ঠিকমতো বুঝতে না পারলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে তা বুঝে নিতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত চিকন তার দিয়ে রড বাঁধা হয়, যা ভালোমতো টাইট করে না বাঁধলে রডগুলোর স্থানচ্যুত ঘটে। একটি স্থায়ী এবং মজবুত স্ট্রাকচার নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়। প্রসঙ্গত, উন্নত দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রডসমূহ তার দিয়ে বাঁধার পরিবর্তে ওয়েল্ডিং করা হয়, ফলে রডের স্থানচ্যুতির কোনো সুযোগ থাকে না। যা হোক, কংক্রিট ও কংক্রিটিংয়ের কাজের ব্যাপারে সবিস্তারে যেসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হলো তা একটি স্থায়ী ও মজবুত কাঠামো নির্মাণের সময় পঙ্খানুুপুঙ্খভাবে মেনে চলা অতীব জরুরি। আর এই কাজগুলো সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে বাস্তবায়নার্থে অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগ করা এবং সার্বক্ষণিক তদারকি নিশ্চিত করা অত্যাবশক। সব ধরনের নির্মাণত্রুটি ও ঝুঁকিমুক্ত করার লক্ষ্যে সবার সার্বিক সচেতনতা প্রয়োজন।
প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ, জীবন ফেলো, আইইবি (এফ-৭৫৯৭) জীবন সদস্য, বিএসটিকিউএম বিএএএস, এওটিএস (জাপান) ডিজিএম (কিউএ অ্যান্ড এমআর) দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি.
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬