সে অনেককাল আগের কথা। চট্টগ্রাম শহরে তখন বাস খুব কম মানুষের। যারা বাস করত, তাদের মধ্যে ছিল আরাকানি-হিন্দু আর মুসলমান সমাজ। সবে তখন হিন্দু মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম প্রথমে ছিল আরাকানদের দখলে। সময়টা আজ থেকে শ পাঁচেক বছর আগে। ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরকে তখনো পুরোদস্তুর পোর্ট চিটাগাং বানাতে পারেনি। শহর চট্টগ্রামের কোনো রকম উন্নয়ন সাধন করেনি ওরা। ফিরিঙ্গিরা সবে আসতে শুরু করেছে। ফিরিঙ্গিরা সঙ্গে আনে ওদের নিজস্ব স্থাপনা পদ্ধতি ও সংস্কৃতি। হিন্দুদের অনেকের মেলামেশা ছিল ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে। ফিরিঙ্গিরা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হলেও এদের সঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীর একদিক থেকে ছিল বেশ মিল। আর তা গান-বাজনায়। গান-বাজনাপ্রিয় হিন্দুদের মধ্যে রঙ্গালয়প্রীতি ছিল বেশ, যার রেশ ছিল হিন্দু জমিদারদের মধ্যেও। বহু দূর থেকে বাইজি আনিয়ে গান শোনার জন্য মুখিয়ে থাকত এলাকার মানুষ। অনেক রঙ্গালয় এ সময়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও ধীরে ধীরে পাকিস্তানিদের অত্যাচারে তা বিলুপ্ত হতে সময় নেয়নি। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে কালের অতলে। কিন্তু এখনো মাথা তুলে ইতিহাসের পাতা থেকে নূপুর-নিক্বন ধ্বনিত করছে সাজ্জালেলার আসরঘর। কেউ বলে রঙ্গালয়, কেউ বলে নাচঘর।
বর্তমানে চন্দনপুরা জামে মসজিদসংলগ্ন রাস্তার একপাশেই ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। এর পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই রঙ্গশালা। প্রায় ২৫০ বছর আগে স্থাপিত এই স্থাপনার সঙ্গে মিশে আছে প্রচুর গল্প। অগণিত ইতিহাস।

এই রঙ্গালয়ের শেষ উত্তরাধিকারীর নাম সাজ্জালেলা। নামটিতে আরাকানি গন্ধ থাকলেও নিশ্চিতভাবেই তিনি ছিলেন হিন্দু বংশোদ্ভূত জমিদার। পর্তুগিজ আমলে সাজ্জালেলার পিতামহ (নাম জানা যায়নি) ভবনটি তৈরি করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে দাদা, বাবা পর ভবনটির মালিক হন সাজ্জালেলা। মানুষ হিসেবে ছিলেন বেশ রসিক। প্রায়ই ঘোড়া ছুটিয়ে আসতেন রঙ্গশালায়। বসাতেন নাচ-গানের আসর। ধীরে হলেও বয়স বাড়ে সাজ্জালেলার। ইংরেজরা জমিদারি প্রথা উঠিয়ে নিতেই একেবারে সহায়হীন হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু জমিদারি ঠাট বজায় ছিল আগের মতোই। তত দিনে জল গড়িয়েছে বহু দূর। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকার খেসারত দিতে হলো তাকে। কখন যে ভারত উপমহাদেশ ভেঙে দুই টুকরো হলো টেরই পেলেন না। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নিল পাকিস্তান সরকার। সে সময় পাকিস্তান সরকার বহু হিন্দু জমিদারের জায়গা, জমি ও বাসভবন অধিগ্রহণের আওতায় নিয়ে আসে। সাজ্জালেলার চোখের সামনেই পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এ নাচঘরটিও হয়ে যায় সরকারি সম্পত্তি। পাকিস্তান সরকার এখানে স্থাপন করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন। দিনে দিনে এটি হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন। ১৯৯০ সালে একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে টাঙানো হয় ছোট্ট সাইন বোর্ড। একপাশে বিশাল ভবন নির্মাণ করে প্রতিদিন মহড়া ও প্রশিক্ষণ চলে কীভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। অন্যদিকে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায় প্রাণস্পন্দনকারী সদা সরব এ স্থাপনাটি।
কারও কারও মতে, ব্রিটিশ আমলে ভবনের চারদিক পরিষ্কার করে নিচের অংশে চুনকাম করার পর পরই মৃত্যু হয় সাজ্জালেলার। তাঁর পুরো পরিবার চলে আসে ভারতে। অনেকের মতে, সাজ্জালেলার পরিবারসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ভবনসহ পাশের জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হননি দখলের অনেক বছর পরও। শেষে হাল ছেড়ে সপরিবারে সবাই ভারতে চলে যান।

জনশ্রুতি আছে, জমিদার সাজ্জালেলার পৈতৃক বাড়ি ছিল পটিয়ায়। সেখান থেকে বিনোদনের জন্য কখনো ঘোড়ার গাড়ি, কখনো পালকিতে চড়ে শহরে আসতেন। তারপর রাতদিন চলত বাইজি-নৃত্য, চলত গান-বাজনা। এসব উপভোগের সুযোগ পেতেন তাঁর পছন্দের জমিদারেরাও। জমিদার রায়বাহাদুর ঘোষের সঙ্গে সাজ্জালেলার ছিল বিশেষ বন্ধুত্ব। রায়বাহাদুর বার্মায় ফেরার আগে এখানে বসে গান শুনেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। এককালে এখানেই আসর বসত বহু ফিরিঙ্গি ব্যবসায়ী আর রাজরাজড়াদের। বড় রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বহু দূর থেকে আলো-ঝলমলে এই ভবন চোখে পড়ত সবার। চট্টগ্রামে পরির পাহাড়ের পরে এই বাড়িকে ঘিরে সবার নজর ছিল সমীহ করার মতোই। গান-বাজনা তথা সংগীত পরিবেশনকারীদের মধ্যে এখানে নিমন্ত্রণ পাওয়ার জন্যই বিরাজ করত বিশেষ আগ্রহ। ভারতবর্ষের বহু তবলচি, বেহালাবাদক, বাইজি, নাচিয়ে, এস্রাজ শিল্পী এখানে এসে তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সপ্তাহের দুই দিন ছিল সাধারণ শ্রোতাদের জন্য উন্মুক্ত। তখন ঢল নামত মানুষের। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বাইজি-নৃত্য দেখতে আসত এখানে।
ভবনটির স্থাপত্যশৈলী দারুণ মনোহর ও চমকপ্রদ। প্রতিটি কোনায় রয়েছে শিল্পের ছোঁয়া। এখানে বাইজিদের জন্য আছে আলাদা সাজকক্ষ। দুটি অতিথিকক্ষসহ দ্বিতল ভবনে রয়েছে ১৪টি কক্ষ। নাচঘরের চারদিকে ১০টি দরজা দিয়ে সহজেই প্রবেশ করা যায়। প্রতিটি ঘর থেকে নাচঘরে আসা যায়। ভবনের নির্মাণশৈলীও অভিনব। কোথাও নেই লোহার কাঠামো। ব্রিক স্ট্রাকচারের এই বাড়িটির ১০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল সম্পূর্ণ ইটের তৈরি। ভবনের কোণে সিঁড়ি রয়েছে মাত্র একটি। ভেতরে দেয়ালে দেব-দেবী আর ফুলের টেরাকোটা বসানো হয়েছে শৈল্পিক ছোঁয়ায়। ভবনের গায়ে ইটালিক আর্চ বসানো। এই স্থাপনার এ নিদর্শন ইংরেজ পরবর্তী আমলের। সে সময় একধরনের বিপ্লব চলছিল বঙ্গজুড়ে। কোন স্থাপনায় যাব এটা নিয়েই যেন একধরনের দ্বিধায় ভুগছিল পুরো বাংলার স্থাপনার মালিকেরা। কেউ ইসলামিক স্থাপনার কথা ভাবছিলেন, কেউ চাইছিলেন হিন্দু স্থাপনাশৈলীকে ধরে রাখতে, কেউ ইউরোপীয় স্থাপনা পদ্ধতিতে গা ভাসাচ্ছিলেন ইচ্ছেমতো, কেউ ফিরে যেতে চাইছিলেন একেবারেই প্রাচীন বাংলার স্থাপনশৈলীতে। এর মধ্যে রঙ্গালয়ের এ বাড়িটি যেন একধরনের বিপ্লব ঘটায়। এর আর্চগুলো একেবারেই মোগল স্থাপনারীতির বিপরীত। এখানে নেই ইসলামিক কোনো স্থাপনশৈলীর নকল পরিবেশনা, যা আছে তা হলো ইংরেজ ও ভারতীয় স্থাপনাশৈলীর অনন্য মিশ্রণ। একেবারেই নিজস্ব নিয়মে প্রতিটি কক্ষের সঙ্গে টানা বারান্দার সংযোগ দিয়ে একের পর এক অন্দর জোড়া দিয়ে বানানো হয়েছে কালজয়ী এ স্থাপনা। চারটি মৌচাকসদৃশ অংশের ধারক বড় চতুর্ভুজ। প্রতিটি কক্ষের উচ্চতা ১৫ ফুট। বিশাল এই স্থাপনার অন্তরে-বাইরে আছে ইটের সুচারু কারুকাজ।
বাড়িটিকে ঘিরে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে অনেক রকম ঘটনা শোনা যায়। একজন জানান, ‘আমি আমার বাবার কাছে শুনেছি, এ ভবনে সপ্তাহে চার দিন নাচ ও গানের আসর বসত। প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী রুনু বিশ্বাস এখানে নৃত্য পরিবেশনের কথা জানিয়েছিলেন উনার জীবদ্দশায়।’

চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নিউটন দাশ বলেন, ভবনটি বর্তমানে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে রয়েছে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা। অগ্নিনির্বাপক সদস্যরা প্রতিদিন সকালে রোলকলসহ প্যারেড করে এই মাঠে। পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি। প্রায় এক বছর আগে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় থেকে একটি টিম এসে সরেজমিন তদন্ত করে যায়। রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। প্রায়ই ভবনের ইট, সুরকি খসে খসে পড়ে। কিন্তু কেউ এই ভবনের উন্নয়নের কথা ভাবেনি। এখন এই ভবনটি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। হয়তো একদিন ধুলোয় মিশে যাবে কোলাহলমুখর রঙ্গশালাটি। মিশে যাবে শত বছরের শত শত মানুষের স্পর্শের স্মৃতি। ধুলোয় আসীন হবে এখানে নাচ ও গান গাওয়া সেই সব কিংবদন্তি শিল্পীর নাম। ইটকাঠের খাঁচা থেকে ইতিহাসকে মুছে ফেলার জন্য আমরা কি নিজেরা দোষী নই? সত্যিই এ দায় আমাদের! এ দায় ইতিহাসের।
স্থপতি রাজীব চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪