ইদ্রাকপুর জলদুর্গ
মোগলদের প্রতিরক্ষা স্থাপনার একটি

ক্রমাগত জলদস্যুদের আক্রমণে আতঙ্কিত ছিল রাজধানী ঢাকার সুবাদাররা। জলদস্যুদের আক্রমণ ও লুটতরাজ ঠেকাতে সুবাদার মীর জুমলা তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে বসেন প্রকৌশলীদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকাকে জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে মুক্ত করতে তিন ধাপে প্রতিরোধ দুর্গ তৈরি করা হবে। নদীর তীরে গড়ে তোলা এই দুর্গ পরিচিত পাবে জলদুর্গ নামে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রথম দুর্গটি নির্মিত হয় বর্তমান মুন্সিগঞ্জের কাছে ইছামতী নদীর তীরে ইদ্রাকপুরে। ওই সময় ধলেশ্বরীর জল ছুঁয়ে ইছামতী বয়ে যেত ইদ্রাকপুরের পাশ দিয়ে। দুর্গের পূর্ব দেয়ালের পাশে নির্মিত হয় উঁচু স্তম্ভ। তারই ওপরে ধলেশ্বরীর দিকে মুখ করে বসানো হয় কামান। এভাবেই ইদ্রাকপুর জলদুর্গটি তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবে আনেন সুবাদার মীর জুমলা।

মুন্সিগঞ্জে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মোগলদের ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনা ইদ্রাকপুর দুর্গ। মীর জুমলা দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে। দুর্গের বর্তমান অবস্থান দেওভোগ গ্রামের পূর্ব প্রান্তে অফিসারপাড়ার দক্ষিণে মধ্য কোটগাঁও এলাকায়। কালের বিবর্তনে এখন আর মোগল সেনাদের তীব্র কোলাহল দুর্গে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয় না। মোগল সেনাদের যুদ্ধোদ্যমের সাংকেতিক ত‚র্যধ্বনি এখন আর বাতাসের সঙ্গে মিশে কেঁপে কেঁপে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে না। নেই ইছামতী নদীর সেই অবারিত জলধারাও।

খিলান আকৃতির খাঁজ কাটা সুদৃশ্য প্রাচীর

বিবর্ণ রূপে দাঁড়িয়ে আছে দুর্গটি। চোখ মেলে দেখার যেন কেউ নেই। দীর্ঘদিন যথাযথ সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় দুর্গটি জরাজীর্ণ ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুর্গটির পূর্ব ও পশ্চিম এবং উত্তরে তিন দিকে পাকা ঘাটবাঁধা পুকুর। এর মধ্যে পূর্ব ও উত্তরের পুকুর দুটো সীমানা প্রাচীরের বাইরে, অন্যটি ভেতরে। উত্তরের পুকুরঘাটের সামনে খিলান আকৃতির তোরণ। ভেতরে কয়েক পা এগিয়ে গেলে পশ্চিমের পুকুরঘাট বরাবর প্রায় দোতলা বাড়ির সমান উঁচু বৃত্তাকার মঞ্চ। মোট ২৪ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যায় ৩৩ মিটার ব্যাসের এ মঞ্চের ছাদে। সেখানেই টালির ছাউনি দিয়ে তৈরি হয়েছে বসতঘর। এ ঘর অবশ্য মঞ্চটির মতো প্রাচীন নয়। দেখেই বোঝা যায়, বহু পরে এটি নির্মাণ করা হয়েছে এবং মূল স্থাপত্যের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। পূর্ব পাশে এর গায়ে পাথরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ইদ্রাকপুর ফোর্ট। তবে উত্তর পাশের মূল ফটকে কিছু লেখা নেই। ফটকের বাইরে রয়েছে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসসংবলিত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নেভি ব্লুু রঙের ওপর সাদা লেখা সাইনবোর্ড।

মোগল স্থাপত্যশৈলীর চমৎকার নিদর্শন এই দুর্গটির আয়তন ৮২ মিটার বাই ৭২ মিটার। ঐতিহাসিকদের মতে, এটি নির্মিত হয়েছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে। বাংলার সুবাদার ও সেনাপতি মীর জুমলা এ দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। লোকশ্রুতি অনুযায়ী দুর্গটির নাম ইদ্রাকপুর কেল্লা রাখা হয়েছিল। কারণ, তৎকালে এলাকাটির নাম ছিল ইদ্রাকপুর। এখন এ এলাকাটির নাম আর ইদ্রাকপুর নেই। তবে এর এক কিলোমিটার দূরে ইদ্রাকপুর নামে একটি গ্রাম রয়েছে। বর্তমান জেলা শহর মুন্সিগঞ্জ যে এই কেল্লাকে ঘিরেই বসতি গড়ে উঠেছে তা ইতিহাসে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যখন কেল্লাটি স্থাপিত হয় তখন এখানে কোনো জনবসতি ছিল না। 

দূর থেকে দৃশ্যমান ইদ্রাকপুর দুর্গ

পুরো দুর্গটি খিলান আকৃতির খাঁজকাটা সুদৃশ্য প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। চার কোণে রয়েছে চারটি গোলাকার মঞ্চ চৌকি দেওয়ার জন্য। মূল মঞ্চটি এগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ আকার ও উচ্চতাবিশিষ্ট। এটি পূর্বদিকে প্রাচীরসংলগ্ন। যদিও সে সময় চারদিকে নজরদারির জন্যই এ সুউচ্চ মূল মঞ্চটি নির্মাণ করা হয়েছিল, কিন্তু এখন এর ছাদে উঠলে দৃষ্টি তেমন বেশি দূর এগোয় না। দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ কোটগাঁও গ্রাম। দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারে ঘেঁষা টেনিস মাঠ ও শ্রীনাথ ক্লাব। পূর্বে পুকুর, লেডিস ক্লাব ও ডাকবাংলো। পশ্চিমে লাগঘেঁষা এভিজেএম (অ্যালভার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন) সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। উত্তরে পুকুর ও মুন্সেফ কোয়ার্টার। বহুতল ভবনের মধ্যে এটিকে এখন নেহাত গেরুয়া রঙের ছোট একটি জরাজীর্ণ ইমারত বলেই মনে হয়। মূল মঞ্চের পাশ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে তলদেশে। সিঁড়ির মুখ বহুকাল আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভেতরে প্রবেশ করা হতো এবং এর মধ্যে অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করে রাখা হতো।

দুর্গ প্রাচীর

অন্যদিকে ছাদে ওঠার প্রশস্ত সিঁড়ির উত্তর কোনায় মুখবন্ধ একটি গম্ভুজ আকারের ইটের ভগ্নস্তূপ রয়েছে। এটি ছিল সুড়ঙ্গপথ। পরে এর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এ সুড়ঙ্গ দিয়ে লালবাগ কেল্লার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল। 

ইদ্রাকপুর কেল্লাটির দৃশ্য অতি মনোহর। ১৯০৯ সালে ইদ্রাকপুর কেল্লাটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছিল। সর্বশেষ ১৯৯৫ সালের দিকে কিছু সংস্কার করা হলেও এরপর আর কোনো সংস্কারই হয়নি কেল্লাটির। কিন্তু নিদর্শনটি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিত্যদিন। অযত্ন-অবহেলায় মূল্যবান এ পুরাকীর্তি ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে। বিশেষ করে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি অর্থাৎ মূল বৃত্তাকার মঞ্চের ওপর বসতবাড়ি তৈরি করে ঘরসংসার শুরু করায় এর স্থাপত্যশৈলীর যেমন সৌন্দর্যহানি ঘটেছে, তেমনি অবকাঠামোগতভাবেও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে সীমানা প্রাচীররে পলেস্তারা খসে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। পূর্বদিকের পুকুরটি সংস্কার না করায় পচা পানিতে এটি প্রায় এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করলে মূল্যবান এ পুরাকীর্তির যেমন স্থায়িত্ব বাড়বে, তেমনি নয়নাভিরাম এ মোগল স্থাপত্যকর্মটি হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান।

দুর্গের প্রবেশদ্বার

পুকুরগুলো সংস্কার করে কেল্লার চত্ব¡রে বাগান করে মঞ্চগুলোকে সাজিয়ে যেমন করে লালবাগ কেল্লায় করা হয়েছে, তেমন ব্যবস্থাপনা যদি ইদ্রাকপুর কেল্লায় থাকত তবে নগরবাসী অন্তত ছুটির দিনে এই শ্বাসরুদ্ধকর নগরের পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে চমৎকার সময় কাটিয়ে আসতে পারতেন সবুজের সমারোহে পুরোনো দিনের স্মৃতিগন্ধময় এ কালজয়ী স্থাপত্যের সৌন্দর্য উপভোগ করে। প্রাচীন এ জনপদের ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে ‘বিক্রমপুর জাদুঘর’ করার জোর দাবি এলাকাবাসীর।

মেহেদী হাসানই-মেইল[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৬ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top