স্বপ্ন বাড়ির দুয়ারে

দিন দিন আমরা হারাতে বসেছি দেশীয় রুচি, অভ্যাস আর সংস্কৃতি। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের স্থাপত্যেও। শহরময় পশ্চিমা ধারার গগনচুম্বী সব ফ্ল্যাটবাড়ি। ভুলেই গেছি দেশীয় গ্রামীণ ঘরবাড়ির আদল। এমন যদি হয় আধুনিক বাড়ির ভেতরেই থাকবে দেশীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ছাপ। দখিনের খোলা দুয়ার; পুবে হাঁস আর পশ্চিমে বাঁশ। পুকুর ভরা টলমল করা জল। দোচালা ঘরের টিন বেয়ে ঝমঝমিয়ে পড়বে বৃষ্টির পানি। কবুতরের ঝাঁক হঠাৎ করেই উঠোন ধরে উড়ে যাবে দলবেঁধে। এমন স্বপ্নের আদলেই নির্মিত প্রকল্প ‘স্বপ্ন বাড়ি’। এমন বাড়ি যা হবে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। যুগ যুগ ধরে বহন করবে দেশীয় ঐতিহ্যকে।

দেশের প্রায় সব দোচালা-চৌচালা ঘরের কাঠামোতে দেখা যায় তা আলতো করে মাটিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর স্থাপত্যবিদ্যা শেখায় কীভাবে মাটিকে ভালোবাসতে হয়; মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমাদের সম্পর্ক। তাই মাটিকে কীভাবে স্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা যায় এ চেতনাকে লালন করেই শুরু প্রকল্পটির কাজ। ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি কিন্তু হতে হবে পরিবেশবান্ধব, থাকতে হবে সাসটেইনেবিলিটি, যা কি না আমাদের শত বছরের বাঙালি ঐতিহ্যকে ধারণ করে। কনসেপ্ট তৈরি হলেও ফর্ম নিয়ে ভাবতে হয় অনেক।  হোম-সুইট হোম, যেন স্বর্গীয় বাড়ি। আর কিউবকে বিবেচনা করা হয় স্বর্গীয় ফর্ম হিসেবে। আর তাই বেছে নেওয়া সলিড কিউব ফর্মকে। তার ফুটপ্রিন্ট কিন্তু সব পাশেই সমান। তাই যদি কিউবকে ৪৫ ডিগ্রি উলম্ব ও ৪৫ ডিগ্রি আনুভূমিকভাবে বাঁকা করা হয়, তবে তা মাটিতে নেবে একবারে জিরো ফুটপ্রিন্ট। আর এভাবে যদি কোনো বাড়ি তৈরি করা হয়, তবে তার ফুটপ্রিন্ট কম হলেও ভেতরের আয়তন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ফলে আবাসের জায়গা যেভাবে কমে আসছে তাতে এ ধরনের কাঠামো হবে দারুণ সময়োপযোগী। এতে পরিবেশের ওপর কমে আসবে কার্বন ফুটপ্রিন্টের প্রভাবও।

প্রকল্পটির নানামুখী নকশা

এবার আসা যাক, একটা কিউবকে বাঁকালে এর ভেতর কীভাবে আয়তন বাড়ে? কিউবকে ৪৫ ডিগ্রি উলম্ব ও আনুভূমিক তলে বাঁকালে তার কর্ণগুলো ভূমির সঙ্গে সমান্তরাল ত্রিভুজ আকৃতির ফ্লোর প্ল্যান প্যাটার্ন তৈরি করে। কর্ণ বাহু থেকে বড় হয় বলে জায়গা বেশি পাওয়া যায়। এতে সমানভাবে তার উচ্চতাও বেড়ে যাবে। এতে করে বিল্ডিং এনভেলাপে ছাদ বা দেয়াল বলে কিছু থাকছে না। যা ছাদ তা-ই দেয়াল। কিউবের প্রতিটি তল পাবে সমান আলো আর বাতাস। ফর্মের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্যই কখনোই স্ট্যাগ ইফেক্ট হবে না, তাই বাতাস সমানভাবে পাবে সব তল। ফলে স্থাপনা হবে এনার্জি এফিসিয়েন্ট। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই ফরমাল এক্সপ্রেশনেই আমরা পাচ্ছি গ্রামের দোচালা বাড়ির প্রতিচ্ছবি।

ত্রিভুজাকৃতির ফ্লোর প্ল্যানে মেটামরফোসিসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রয়োজনীয় ফাংশনগুলো। ফ্লোরগুলোকে ভাগ করা হয়েছে বিভিন্ন জোনে। দক্ষিণে বড় বড় ওপেনিং, টলমলে পানির ওপর ঝুলন্ত বারান্দা আর ওপরতলায় জীববৈচিত্র্যের জন্য বায়ডায়ভারসিটি জোন। যেখানে থাকবে পাখির অবাধ বিচরণ, গাছগাছালি। এর ফলে দূর থেকে বাড়িটাকে মনে হবে একটা বটগাছ। যার মাথাভর্তি সবুজ পাতা, যাতে বাসা বেঁধেছে হরেক রকম পাখি। বাড়িটির কাঠামো হতে পারে রি-ইনফোর্সড কংক্রিট অথবা স্টিল স্ট্রাকচার, যা কি না শতভাগ নবায়নযোগ্য। ট্রাস আর ফাইবার কাঠামোতে এই বাড়িকে সহজেই দাঁড় করানো যাবে। আর পার্কিংয়ের জন্য আলাদা শেডিং ডিভাইসের প্রয়োজনও হবে না, কারণ বিল্ডিংয়ের বাঁকানো তলই শেডিং ডিভাইসের কাজ করবে। আর মডিউলার পদ্ধতিতে যদি একটা জোন তৈরি করা যায়, যাতে থাকবে এই বাড়িগুলো, ফলে তৈরি হবে একটা কমিউনিটি; যারা আধুনিকতার সঙ্গে বেড়ে উঠবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে। বাড়িগুলোর জলাধার আর বায়ডায়ভারসিটি জোনের কারণে তৈরি হবে ওসব এলাকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাইক্রো ক্লাইমেটল।

প্রকল্পটির বিভিন্ন মডেল

বাড়িটার ডিজাইন করা হয়েছে এ দেশের মানুষের কথা ভেবে। এখন যত ছোট পরিবার দেখা যায়, তা আগে কিন্তু দেখা যেত না। আগে বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এক বাড়িতে থাকত। এখনকার নতুন প্রজন্ম হয়তো জানেই না যৌথ পরিবারের মানে কিংবা যৌথ পরিবারের আনন্দময় মুহূর্তের কথা। এ ডিজাইনে উপস্থাপন করা হয়েছে সেসব স্পেসকে। তৈরি করা হয়েছে পারিবারিক বৈঠকখানা। ডাবল হাইটেড স্পেসে তৈরি পারিবারিক বৈঠকখানা আর থাকার জায়গাগুলো; যাতে অটুট থাকে সম্পর্ক। যেমন করে একটা উঠোন ধরে রাখে তার চারপাশের ঘরকে। একটা শিশু যখন শৈশব থেকে এই বাড়িতে বড় হবে, সে যেন সব সময় ধরে রাখে তার বড় হওয়ার হিরন্ময় সব স্মৃতিকে।

প্রকল্পটির লে-আউট প্ল্যান

ভোরের রোদের লুকোচুরি খেলা, টলমল পানিতে বাড়ির প্রতিচ্ছবি, ছাদ বাগানের অসংখ্য গাছ আর পাখিদের কিচিরমিচির, ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখা আর দোতলার বৈঠকখানা থেকে বর্ষার টাপুরটুপুর বৃষ্টি দেখা সবকিছু যাতে পুরোনো বাড়িটার স্মৃতি নতুন করে জাগিয়ে তোলে। সর্বোপরি এমন একটা স্পেস, যাতে যে কেউ খুঁজে পাবে আপন নীড়ের ছোঁয়া।

অমিত ইমতিয়াজ অয়ন

শিক্ষার্থী, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৩ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top