ছত্রাক কী?
ছত্রাক বা Fungus একটি জীবাণু, যার উৎপত্তিস্থল শেওলা-জাতীয় অপুষ্পক উদ্ভিদ। সাধারণত বাসাবাড়ির দেয়ালে এটি দেখা যায়। কয়েক ধরনের ছত্রাক রয়েছে, যা মাইকোটক্সিন তৈরি করে এবং সেটি মানুষ এবং জীবজন্তুর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। উন্মুক্ত অবস্থায় উচ্চমাত্রায় মাইকোটক্সিন স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
যে কারণে ছত্রাক জন্মায়
ছত্রাক ভেতরে-বাইরে সর্বত্রই বিরাজ করে। যখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে, তখন এটা প্রায় সবকিছুর ওপরই জন্মায়। ছত্রাক তৈরি হয় এক প্রকার জীবাণু বা রেণুর সাহায্যে শেওলা-জাতীয় অপুষ্পক উদ্ভিদ থেকে। এটা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যখন এই জীবাণুটি আর্দ্র আবহাওয়া পায় তখন এটি সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সাধারণত বেশির ভাগ অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয় এমন উপকরণ দিয়ে, যাতে ছত্রাক সহজে জন্মাতে না পারে। অ্যাপার্টমেন্টে ছত্রাক জন্মানো সম্পূর্ণ নির্ভর করে পানি এবং ভেজা আবহাওয়ার ওপর। ছত্রাক জন্মাতে পারে যদি ঘরের মেঝে তৈরির শেষে সম্পূর্ণভাবে না শুকায়। এ ছাড়া অ্যাপার্টমেন্টে ছত্রাক জন্মাতে পারে বন্যাজনিত কারণে, ছাদে ফাটল থাকলে, অবকাঠামোর সংরক্ষণ সমস্যার জন্য, অভ্যন্তরীণ প্লাম্বিংয়ের মতো নানা কারণে।
ছত্রাক জন্মানোর জন্য পানি এবং বাতাসের আর্দ্রতাই যথেষ্ট। ছত্রাকের প্রধান খাদ্য পানি আর বাতাসের আর্দ্রতা। অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি এবং সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যেসব অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য বা আসবাব যেমন- প্লাইউড, শুষ্ক দেয়াল, কার্পেট এবং কার্পেট প্যাডিং- এগুলোই ছত্রাক জন্মানোর উপযুক্ত ক্ষেত্র। কোনো কারণে পানি দ্বারা যদি বিল্ডিং নষ্ট হয় তাহলে ছত্রাক দেয়ালে সুপ্ত অবস্থায় থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত আবহাওয়ার উচ্চমাত্রায় আর্দ্রতা না পায়।
ছত্রাকের জীবাণু জন্মানোর জন্য মোট তিনটি পরিবেশ বিশেষভাবে অনুকূল-
- খাদ্য ছত্রাকের জীবাণুর প্রধান খাদ্য হচ্ছে সেলুলোস। এটি সবুজ গাছের পাতায় বেশি থাকে।
- আর্দ্রতা প্রয়োজন হয় ছত্রাকের জীবাণু আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার জন্য।
- সময় ছত্রাক তৈরি হয় ২৪ ঘণ্টা থেকে ১০ দিনের মধ্যে। তবে এর মৃত্যু কত দিন পর তা জানা যায়নি।
ছত্রাকের খাদ্য হিসেবে রয়েছে সেলুলোসনির্ভর উপাদান যেমন কাঠ, কার্ডবোর্ড, ড্রাইসেলের ভেতরের এবং বাইরের দিকের অংশবিশেষ। এ ছাড়া অন্যান্য জৈব পদার্থ যেমন- সাবান, ফেব্রিকস এবং ত্বকের ধূলিকণা হতে পারে ছত্রাকের খাদ্য। অ্যাপার্টমেন্টে সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমের তাপমাত্রা কম-বেশির কারণে ছত্রাক জন্মাতে পারে। তাই মাঝে মাঝে গরম বাতাস দিয়ে ঘরকে ছত্রাকমুক্ত করা উচিত।

ছত্রাক থেকে পরিত্রাণের উপায়
ছত্রাক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রথমেই ধূলিকণা আসার প্রবেশপথ বন্ধ করা। তারপর ছত্রাক যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করা। প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে ছত্রাক দূর করার জন্য যা করণীয়, তা হলো-
- সূর্যের আলো পর্যাপ্ত থাকা দরকার।
- ভেন্টিলেশন বা অবাধ বাতাস আগমন ও নির্গমনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- দেয়ালে ভালো ইনসুলেশন ব্যবহার করা কিংবা শুষ্ক দেয়াল থাকা বাঞ্ছনীয়।
- নন-পোরাস বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল দ্বারা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করা।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য অ্যাপার্টমেন্টের নিজস্ব জনবল থাকা।
- ডিহিমুইডিফায়ারের ব্যবস্থা রাখা।
বর্তমানে নতুন প্রযুক্তিতে ঘরে শুষ্ক কুয়াশা প্রয়োগ করে ছত্রাক ধ্বংস করা যায়। এভাবেই নতুন করে ছত্রাক জন্মানোর কাজটি রোধ করা সম্ভব। ফগ (Fog)-এর সঙ্গে EPA নামক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা মানবদেহে বা জীবজন্তুর দেহে কোনো প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।
অন্য পদ্ধতির মধ্যে ছত্রাক পরিষ্কার করার জন্য উচ্চ তাপমাত্রা, শুষ্ক বাতাস এবং সূর্যালোকে উন্মুক্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ ফেলে রাখলে ছত্রাকমুক্ত হয়। সবচেয়ে উত্তম উপায় হচ্ছে ডিটারজেন্ট সলিউশন ব্যবহার করলে ছত্রাকের বংশ ধ্বংস হয়। বর্তমানে অনেক কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গিসাইড ব্যবহার করে ছত্রাক পরিষ্কার করছে।
ছত্রাক পরিষ্কারকালীন পোশাক
যখন কোনো স্থানে ছত্রাক পরিষ্কার করার প্রয়োজন হয় তখন সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় কাজ হচ্ছে শ্বাস বন্ধ করে কাজ করা, যাতে ছত্রাকের জীবাণু নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নাকে প্রবেশ করতে না পারে। বাতাসে যে ছত্রাকের জীবাণু ভেসে বেড়ায় এটা থেকে নিষ্কৃৃতি পাওয়ার জন্য রেসপাইরেটর ব্যবহার করা উচিত। তা ছাড়া ধূলিকণা থেকে নিরাপদে থাকার জন্য ডাস্টমাস্কও ব্যবহার করা যেতে পারে। হাতের জন্য হ্যান্ড গ্লাভস পরা যেতে পারে। চোখের সুরক্ষার জন্য গগলস ব্যবহার করা উত্তম।
অধুনা ড্রাই আইস ব্লাসটিং পদ্ধতিতে কাঠ বা সিমেন্ট থেকে ছত্রাক সরানো হচ্ছে। সোডা ব্লাসটিং পদ্ধতিতেও ছত্রাক পরিষ্কার করা যায়। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মাধ্যমেও মেঝে, কার্পেট ও অন্যান্য শক্ত মসৃণ স্থান থেকেও ছত্রাক সরানো যেতে পারে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারটি ব্যবহার করার পর খুব ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। ড্যাম্প ওয়াইপ দ্বারাও অসমতল বা এবড়োখেবড়ো স্থান শুষে নিয়ে বা স্ট্রেবিং পদ্ধতিতে পানির সঙ্গে ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে ছত্রাক নির্মূল করা হয়। সাধারণ মেটাল, গ্লাস, হার্ডউড, প্লাস্টিক ও কংক্রিটে স্কেলিং করে ছত্রাক দূর করা হয় এবং পরিশেষে ফাঙ্গিসাইড বা ছত্রাকনাশক ক্লিনার ব্যবহার করে।

ছত্রাক প্রতিরোধযোগ্য যন্ত্রপাতির ব্যবহার
অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় শুধু ছত্রাকের উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্য। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
১. ময়েশ্চার মিটার
এই যন্ত্রের সাহায্যে কোনো আবাসস্থানে বাতাসে ধূলিকণার অবস্থান কোন্ স্তরে রয়েছে তা জানা যায়। এটা দিয়ে কোনো স্থানের কাজ করার পর শুষ্ক হতে কতক্ষণ সময় লাগছে তা নিরূপণ করা যায়। পিন ময়েশ্চার মিটার প্রবেশের মাধ্যমে সিগনাল পৌঁছে সেনসিং স্থানে লাগানো হয়। সরাসরি যে বস্তুটিতে ময়েশ্চার কতটুকু অবস্থান করছে তা জানার জন্য। ময়েশ্চার মিটার ব্যবহার হয় কার্পেট, ওয়ালবোর্ড, কাঠ, ইট এবং অন্যান্য মেসোনারি মেশিনারি কাজের জন্য।
২. হিউমিডিটি গজ
এর দ্বারা কোনো স্থানে অভ্যন্তরীণ পরিবেশে কী পরিমাণ আর্দ্রতা বজায় থাকে তা নিরূপণ করা যায়। অনেক সময় হিউমিডিটি গজের সঙ্গে থার্মোমিটার যুক্ত থাকে। ফলে স্থানটির তাপমাত্রাও নির্ণয় করা যায়।
৩. বারস্কোপ
এটি একটি হস্তচালিত যন্ত্র, যার দ্বারা কোন্ স্থানে কী পরিমাণ ছত্রাক জমে আছে তা নিরূপণ করা যায়। যেহেতু হস্তচালিত যন্ত্র, তাই এর দ্বারা দেয়ালের আনাচকানাচ, ছাদ, যে স্থানে হামাগুড়ি দিয়ে যাওয়া সম্ভব সেসব স্থানে এবং অন্যান্য খুব নাজুক সংকীর্ণ স্থানে এটা ব্যবহার করা যায়। এর শেষ মাথায় সাপের মতো নমনশীল ছোট একটি ক্যামেরা থাকে। এর জন্য কোনো শুষ্ক দেয়ালে ছিদ্র অথবা কাটার প্রয়োজন হয় না।
৪. ডিজিটাল ক্যামেরা
এটা ব্যবহার করা হয় তাৎক্ষণিক তথ্য ধরে রাখার জন্য।
৫. পার্সোনাল প্রকেটটিভ ইকুইপমেন্ট
নিজের নিরাপত্তার জন্য রেসপিরেটর ব্যবহার করা হয় নিরাপদে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, হ্যান্ড গ্লাভস, সেফটি স্যু, চোখের জন্য আই প্রটেকশন চশমা ইত্যাদি।
৬. থার্মোগ্রাফিক ক্যামেরা
ইনফ্লারেড/ ইনফ্রারেড থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা কখনো কখনো ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে ময়েশ্চার মিটার, যাতে দুই দফা ছত্রাকের উপস্থিতি সঠিকভাবে পাওয়া যায় এবং ছত্রাক যাতে আরও বড় আকারে দেখা সম্ভব হয় তাই এ ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়।
ছত্রাক থেকে মুক্তি পাওয়া নির্ভর করছে কতখানি স্থানজুড়ে ছত্রাক আছে। এ জন্য চারটি স্তর নির্ণয় করা হয়েছে। প্রথম স্তর হিসেবে ১০ বর্গফুট অথবা এর নিচের স্থান ধরা হয়েছে। যেমন ছাদ বা ছোট দেয়ালে ছত্রাক থাকলে। দ্বিতীয় স্তর হিসেবে ১০ থেকে ৩০ বর্গফুট স্থান। যেমন ওয়ালবোর্ড প্যানেল। তৃতীয় স্তর হিসেবে ৩০ থেকে ১০০ বর্গফুট স্থান। যেমন বিশেষ ধরনের ওয়ালবোর্ড প্যানেল। চতুর্থ স্তর হিসেবে ১০০ বর্গফুটের চেয়ে বেশি স্থান। যেমন প্লাস্টিক শিট দ্বারা তৈরি কোনো বদ্ধ স্থান।
অ্যাপার্টমেন্ট ছত্রাকমুক্ত রাখার উপায়
ছত্রাক অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে যাতে না থাকে এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। এ ব্যাপারে অবহেলায় ছত্রাক অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তখন রক্ষণাবেক্ষণে অনেক বেশি খরচ হয়। নিচের কয়েকটি পদক্ষেপ সময়মতো গ্রহণ করলে ছত্রাক থেকে একদিকে যেমন মুক্তি মিলবে, সেই সঙ্গে সাশ্রয় হবে অনেক টাকা। নিচে ছত্রাকমুক্ত রাখার কয়েকটি টিপস দেওয়া হলো-
ক. শক্ত বা সমতল স্থান থেকে ছত্রাক নির্মূল করা :
ছত্রাক শনাক্ত করা স্থান খুব ভালোভাবে গরম পানি দিয়ে স্পঞ্জের সাহায্যে পরিষ্কার করতে হবে।
একটি বোতলে ভিনেগার এবং গরম পানি ভর্তি করে ছত্রাক স্থানে স্প্রে করতে হবে। যে স্থানে বেশি পরিমাণ ছত্রাকের উপস্থিতি আছে বা ছত্রাক ভবিষ্যতে হতে পারে, এমন স্থান অধিক পরিমাণ ভিনেগার মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হবে।

১৫ থেকে ৩০ মিনিট ভিনেগার দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং শুকিয়ে গেলে আবার দিতে হবে। এমনভাবে বেশ কয়েকবার করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ছত্রাক সমূলে ধ্বংস না হয়।
যেখানে ছত্রাক বেশি হয় মাঝে মাঝে সেখানে ভিনেগার দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে সেখানে ছত্রাক জন্মাতে না পারে।
কার্পেট থেকে ছত্রাক সরানোর উপায়
বেকিং সোডা কার্পেটের ছত্রাক অংশে ছিটানো যেতে পারে।
১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। তারপর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে ছত্রাক জন্মানোর স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। পুনরায় ছত্রাক জন্মানোর স্থানে বেকিং সোডা ছিটাতে হবে এবং ১২-১৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত ছত্রাক নির্মূল না হয়।
ছত্রাক শনাক্ত স্থানে ধুলাবালি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৫ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩