ওজনে হালকা, যথেষ্ট টেকসই। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হওয়ায় সবুজ শহর তৈরিতে কাঠের স্থাপনার জুড়ি মেলাভার। বলাবাহুল্য, কাঠ স্টিলের চেয়ে বেশি অগ্নিরোধক। পরিকল্পনাতেই হোক আর বাস্তবায়নেই হোক, কাঠের বহুতল ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা গত পাঁচ বছরে যেভাবে বেড়েছে, তা নিশ্চিতভাবে চোখে পড়ার মতো। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রকৌশলী লন্ডন শহরে কংক্রিট আর স্টিলের বদলে কাঠের ১ হাজার ফুট উঁচু ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। শহরটির মেয়র বরিস জনসনের কাছে উপস্থাপিত এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে বারবিকান স্টাইলের ৮০ তলা কাঠের এই ভবনটি হবে লন্ডন শহরে ‘দ্য সার্ড’-এর পর দ্বিতীয় উচ্চতম স্থাপনা। আর সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ কাঠ নির্মিত স্থাপনা। ‘ওকউড’ নামের এ টাওয়ারটিতে ১ হাজার পরিবারের আবাসনব্যবস্থার সংস্থান হবে বলে প্রকৌশলীদের বিশ্বাস। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি ৯৩ হাজার বর্গমিটারের এ ভবনের বাড়িগুলোতে থাকবে বারান্দাসহ যথেষ্ট পরিমাণে খোলা পরিসর। ওকউড টাওয়ার হচ্ছে পিএলপি আর্কিটেকচার ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের যৌথ পরিকল্পনার ফসল। কাঠের ভবনের প্রতি আগ্রহী করতে এটিকে একটি গবেষণামূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের ভিক্টরিয়া হারবারে তৈরি হয় ১০৪ ফুট উচ্চতার ১০ তলা কাঠের ভবন ‘ফোর্ট লিভিং’। ৩৪টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে এ ভবনে। সে সময় এটিই ছিল সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি উঁ”ু ভবন। এর পর নরওয়ের বারগেন শহরের ‘দ্য ট্রিট’ তৈরি হওয়ার পর ফোর্ট লিভিং তার কৃতিত্ব হারায়। ২০১৪ সালের শেষ দিকে ৫০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ১৪ তলা এই কাঠের ভবনের কাজ শেষ হয়। কাচ দিয়ে ঢাকা ভবনটির নকশা করে আরটেক প্রজেক্ট টিম।
যদিও ২০১০ সালে ‘রউলফ রামস্টেড আর্কিটেক্ট’ নামে একটি কোম্পানি নরওয়ের আর্কটিক সিটি কার্কনায় (Kirkenes) বারেনথাস (Barentshus) কালচারাল সেন্টারের জন্য ২০ তলা ভবনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার টানাপোড়েনের কারণে এটি বাস্তব রূপ দেখেনি।

দুইটি টাওয়ারবিশিষ্ট ৮৪ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ‘হোহো ভিয়েনা’ তৈরি হচ্ছে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। ৬৮ মিলিয়ন ডলার নির্মাণব্যয় ধরে শুরু করা এ ভবনটি ২০১৭ সালে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রজেক্ট ডেভেলপার ক্যারোলিন পালাফি মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ায় এখন যে পরিমাণে কাঠ উৎপাদনকারী গাছ রয়েছে, তাতে এটাই উপযুক্ত সময় কাঠের স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করার। এদিকে ডেনিস আর্কিটেক্ট সি এফ মুলার সুইডেনের স্টকহোম শহরের জন্য ৩৪ তলাবিশিষ্ট কাঠের স্থাপনার পরিকল্পনা করছেন, যা আগামী ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর পিলার এবং বিম তৈরি হবে সলিড কাঠ দিয়ে। স্থাপনাটির কাঠের দেয়াল, ছাদ ও জানালার ফ্রেম বাইরে থেকে বেশ ভালোভাবে বোঝা যাবে।
গত বছর লন্ডনের সোরডিচের ১০৯ ফুট উচ্চতার ‘দ্য কিউব’-কে ইউরোপের সর্বোচ্চ ‘ক্রস ল্যামিনেটেড টিম্বার’ বা সিএলপি স্থাপনা বলে দাবি করে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তবে ১৮ তলাবিশিষ্ট কানাডার ‘টল উড বিল্ডিং’ বর্তমানে উচ্চতার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে। যত দিন পর্যন্ত ‘ওকউড’ টাওয়ার বাস্তবায়িত না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত ১৭৪ ফুট উচ্চতার এই ভবনটিই সম্ভবত বিশ্বের সর্বোচ্চ কাঠের ভবন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
কেন আর্কিটেক্টরা কংক্রিট আর স্টিল স্কাইক্র্যপার্সের পাশাপাশি কাঠের দিকে আলাদাভাবে নজর দিতে শুরু করলেন? বহু বছর ধরে কাঠ নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাঠের ওজন অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী যেমন কংক্রিট বা স্টিলের চেয়ে অনেক কম কিন্তু ভারবহন ক্ষমতা অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। আসলে কাঠের নতুন ধরনের ট্রিটমেন্ট ‘ক্রস ল্যামিনেশন’-এর মতো অতি শক্তিশালী পদ্ধতিই উৎসাহিত করছে তাদের আলাদাভাবে ভাবতে, বলে মনে করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যায়ের সেন্টার ফর ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়াল ইনোভেশনের বিশেষজ্ঞ ড. মাইকেল র্যামেজ। ‘ক্রস ল্যামিনেটেড টিম্বার’ হচ্ছে কাঠের পাতলা পাতলা টুকরোকে একটির সঙ্গে আরেকটিকে সঠিক কোণে জুড়ে দিয়ে আগুন প্রতিরোধক আঠা ও আবরণ দিয়ে জুড়া, যাতে এ ধরনের কাঠ অন্যান্য সাধারণ কাঠের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত ও শক্তিশালী হয়।
ড. র্যামেজের মতে, একই ভাবে কাঠের পরিবর্তে বাঁশকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বহু বছর ধরে এশিয়ায় বাঁশ ব্যবহার হচ্ছে নির্মাণকাজে। আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর তথ্য অনুযায়ী বাঁশ এবং কাঠের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা কাছাকাছি কিন্তু এর বৃদ্ধি কাঠের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি, সারা বিশ্বে প্রায় সাড়ে একত্রিশ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বাঁশ জন্মায়। ড. র্যামেজ বলেন, ‘আমরা বাঁশকেও এভাবে ব্যবহার করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বাঁশের বাইরের শক্ত আবরণকে চার কোণ করে কেটে নিয়ে একই ভাবে আঠা দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটিকে জুড়ে দিয়ে বড় একটি টুকরো তৈরি করা যেতে পারে।’ এভাবে বাঁশ থেকে যে টুকরো পাওয়া যাবে, তা কাঠের তুলনায় অনেক শক্ত ও মজবুত হবে বলে মনে করেন পিএলপি আর্কিটেক্টের পার্টনার কেভিন ফ্লেনাগেন। একসময় জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে উঁচু ভবন তৈরির উপযুক্ত কাঠ উৎপাদন সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

কাঠের তৈরি আকাশচুম্বী এসব অট্টালিকা আগুন থেকে কতটা নিরাপদ? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন, বিশেষ করে এখানে যখন অনেক মানুষের বাস। ‘ওকউড’ টাওয়ার লন্ডন শহরের সাধারণ কংক্রিট ও স্টিলের অন্যান্য বহুতল ভবনের চেয়ে নিরাপত্তায় খানিকটা এগিয়ে। কারণ, যুক্তরাজ্যের ফিজিক্যাল সায়েন্সেস রিসার্চ কাউন্সিল আড়াই লাখ পাউন্ড খরচ করেছে এর পেছনে বিশেষ করে আগুন থেকে নিরাপদ থাকতে। এ প্রসঙ্গে ড. র্যামেজ বলেন, ‘একটা বড় ধারণাগত সমস্যা রয়েছে। মানুষ যেভাবে ধারণা করে কাঠ কিন্তু সেভাবে পোড়ে না। লন্ডন এবং শিকাগো শহরের বড় বড় অগ্নিকান্ডে কাঠের ছোট টুকরোগুলোই বেশি পুড়েছিল। বড় কাঠে সহজে আগুন ধরে না। কারণ এগুলো ততটা দাহ্য নয়।’
কাঠে সাধারণত শতকরা ১৫ ভাগ পর্যন্ত পানি থাকতে পারে। কাঠ নিজে জ্বলে ওঠার আগে এই পানিকে বাষ্পায়িত হতে হয়, তাই কাঠের আগুনের মাত্রা অনেকটাই ধারণা করা যায়। ভবনটি আগুনে যাতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টিকতে পারে তার জন্য ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারদের কত বড় কাঠের বøক তৈরি করতে হবে তার একটা হিসাব দেন তিনি। তদুপরি এটি আগুন থেকে অনেকটাই নিরাপদ। তা ছাড়া চলতি বছরে দুবাইয়ের অগ্নিকান্ড প্রমাণ করে যে শুধু কাঠের ভবনই আগুনের ঝুঁকিতে নেই; কংক্রিট বা স্টিলের ভবনও এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সব ভবনেরই একটা অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা থাকা চাই, তা সে কাঠ, কংক্রিট বা স্টিল যা-ই হোক না কেন।
আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও রয়েছে কাঠের বিশেষ ভূমিকা। এটা ঘরের পরিবেশ বিশেষ করে শব্দ বা তাপ খুব সহজে নিয়ন্ত্রণ করে। যে কারণে ঘরে একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেভিন ফ্লেনাগেন মনে করেন, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কাঠের ভবনের একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। মানুষ কাঠের ঘরে তুলনামূলক অনেক স্বস্তিবোধ করে। তারা কাঠ ও সবুজ স্থান খুব পছন্দ করে, এর সঙ্গে রয়েছে তাদের আত্মিক সম্পর্ক। ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ান জোনেয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউট চারটি শ্রেণিকক্ষের ওপর একটা তুলনামূলক গবেষণা করে। যেখানে দুটি শ্রেণিকক্ষের মেঝে, ছাদ ও আলমারি ছিল কাঠের আর অপর দুটির মেঝে ছিল লাইনলিয়ামের, দেয়াল প্লাস্টার বোর্ডের এবং আলমারি চিপবোর্ডের তৈরি। গবেষকেরা দেখতে পান যে কাঠের শ্রেণিকক্ষের ছাত্ররা অনেক শান্ত এবং তাদের হৃদস্পন্দনও অন্যদের চেয়ে স্বাভাবিক।

কাঠের ভবন তৈরির প্রধান উপকরণ কাঠ। একটা ভবন তৈরি করতে যে পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন হবে, তা যদি আমাদের প্রাকৃতিক উৎস বন থেকে সংগ্রহ করতে হয় তবে বন রক্ষা পাবে কি? আর কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি কীভাবে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে? এ দুটি বিষয় এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে নতুন কিছু চিন্তা করার সময় প্রথমেই এটি মাথায় রাখতে হয়। প্রকৃতি রক্ষা আর কার্বন নিঃসরণকে বর্তমান দিনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সারা পৃথিবী। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, প্রতিবছর ৫৮ হাজার বর্গমাইল বন উজাড় হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে ৪৮টি ফুটবল মাঠের সমান বনজ বৃক্ষ।
এ অবস্থায় ওকউড টাওয়ারের মতো স্থাপনা তৈরিতে যে পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন হবে, তা সংগ্রহ করতে কতগুলো গাছ কাটতে হবে সেটি একটা বড় প্রশ্ন। এর ব্যাখ্যায় ড. র্যামেজের ভাষ্য, ওকউড টাওয়ার তৈরি হবে ‘সাদা কাঠ’ (white wood) দিয়ে, যা ৪০ বছর ধরে শুধু নির্মাণকাজের জন্য উৎপাদন করা হয়েছে। আমরা এখন কাগজ কম ব্যবহার করছি, ফলে রাশিয়ার কাছে এ ধরনের কাঠের বিশাল মজুত রয়েছে। কানাডাও প্রায় ৭০ বছর ধরে তৈরি করছে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য এ ধরনের ‘সাদা কাঠ’।
কংক্রিটের তুলনায় কাঠের ব্যবহার অনেক যুক্তিযুক্ত। কেননা, কাঠ কংক্রিটের তুলনায় অন্তত চার গুণ হালকা, তাই এর পরিবহন খরচ অনেক কম। এ ছাড়া ভবনের বড় বড় অংশ কারখানায় তৈরি হবে এবং পরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন অংশ জুড়ে দেওয়া হবে। তাই এসব ভবন নির্মাণে অর্থ ও সময়ের অনেক সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন কেভিন ফ্লেনাগেন। ‘হোহো ভিয়েনা’ প্রকল্পের প্রকৌশলীরা মনে করেন, ‘হোহো ভিয়েনা’র মতো একটা কংক্রিটের ভবন তৈরি করতে গেলে অন্তত ২ হাজার ৮০০ টন বেশি কার্বন নির্গত হবে। একটা কার প্রতিদিন ২৫ মাইল করে ১ হাজার ৩০০ বছর চললে যে কার্বন নিঃসরণ করবে, এটি তার সমান।

কাঠের ভবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর স্থায়িত্ব। বাড়ি তৈরির কাজে ২ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে কাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর তুলনায় সহজলভ্য, ওজনে হালকা এবং যথেষ্ট টেকসই হওয়ার কারণে বাড়ি তৈরিতে কাঠের ব্যবহার অনেক বেশি। লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টার হল থেকে শুরু করে বেইজিং পর্যন্ত বহু ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিনন্দন কাঠের স্থাপনা টিকে আছে শত শত বছর ধরে। ৬০০-৭০০ বছরের বেশি পুরোনো কাঠের ভবন এখনো সুন্দরভাবে মানুষ ব্যবহার করছে পৃথিবীর বুকে। কাজেই এর স্থায়িত্ব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
আবু সুফিয়ান
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬