অ্যাপার্টমেন্ট যখন সবুজ উদ্যান

পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। সেই স্থলভাগের বেশ কিছু জায়গায় রয়েছে বন। আর সভ্যতা বাঁচাতে সবুজ বন খুবই দরকার, কিন্তু এর মধ্যে নতুন কোনো তথ্য নেই। নতুন তথ্য হলো, খুব শিগগিরই আকাশ ছুবে সবুজ উদ্যান আর এর নেপথ্য কারিগর স্থপতি স্টিফানো বোয়েরি। ইতালির মিলান শহরে ২৭ তলার বস্কো ভার্টিক্যাল বিল্ডিং এর দুটি টাওয়ারের প্রতিটি তলায় থাকবে অবারিত সবুজের ছোঁয়া।

সবুজের আলিঙ্গনে বেষ্টিত ইতালির মিলানের এই অভিনব বিল্ডিংয়ের টাওয়ার দুটি ৩৬৫ ফুট ও ২৬০ ফুট লম্বা। ৭৩০ রকমের গাছ রয়েছে এখানে। এর মধ্যে থাকছে ওক এবং অ্যামেল্যানচিয়ারের সম্ভারও। পাঁচ হাজার রকমের বিশেষ ধরনের গাছ ও ১১ হাজার ছোট গাছও পোঁতা হয়েছে এখানে আর এর নেপথ্যে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের বক্তব্য, এর ফলে আরও এক হেক্টর বন তৈরি হবে পৃথিবীর বুকে। শুষে নেবে বিষাক্ত গ্যাস। আর এই টাওয়ারের অ্যাপার্টমেন্টগুলো পাবে যথেষ্ট পরিমাণ বিশুদ্ধ বাতাস।

বৃক্ষবাড়ীর মডেল

ইতালির মিলান পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল নগরী। অধিক নগরায়ণের ফলে মিলান শহরে সৃষ্ট বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয় প্রশমনের লক্ষ্যে এই ঝুলন্ত বন সৃষ্টির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই ঝুলন্ত বন সৃষ্টির লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয় দুটি সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণের, যার সম্মুখপার্শ্বগুলোতে ফটোভোলাটিক এনার্জি সিস্টেম দ্বারা গাছগুলোর সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতি চালু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই গাছগুলো প্রকৃতপক্ষে বায়ুতে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং ধুলা শোষণ করবে, যা যেকোনো ভবনের যান্ত্রিক হিটিং এবং কুলিংয়ের প্রয়োজন কমিয়ে দেবে এবং সে এলাকার শহুরে হিট আইল্যান্ড এফেক্টকে প্রশমিত করবে; বিশেষত গ্রীষ্মে যেখানে তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রিরও বেশি থাকে।

দুটি টাওয়ারের উচ্চতা যথাক্রমে ২৬০ ফুট এবং ৩৬৭ ফুট এবং উভয় ভবন একত্রে ধারণ করতে পারে ৪৮০টি বড় এবং মাঝারি আকারের গাছ, ২৫০টি ছোট আকারের গাছ, ১১ হাজার ভূমি আচ্ছাদনকারী ছোট গাছ এবং ৫ হাজার লতাগুল্ম (যা প্রায় ২ দশমিক ৫ একর বনভূমির সমান)। এই গাছগুলো নির্বাচন করা হয়েছে ভবনের কোন স্থানে সেগুলো স্থাপন করা হবে এর ওপর ভিত্তি করে। উপযুক্ত গাছ নির্বাচন করতে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করা হয়েছে; কোন ধরনের গাছ এ পরিবেশে টিকে থাকবে তা খুঁজে বের করতে। এই প্রজেক্টে ব্যবহৃত গাছগুলো বিশেষভাবে এই ভবনে রোপণের জন্যই তৈরি করা যাতে বিল্ডিংয়ের পরিবেশের সঙ্গে এরা সহজে মানিয়ে নিতে পারে।

২০১১ সালে যখন বস্কো ভার্টিক্যাল নির্মাণের কথা আলোচনায় আসে, জানাজানি হয় ঝুলন্ত বন নির্মাণের কথা; তখন অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন আদৌ এটার বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা। কেউ কেউ বলেছিল, এটা কল্পনার বাইরে অথচ বাস্তবে এর নির্মাণ প্রায় শেষের দিকে। টাওয়ার দুটির নির্মাণকাজ শেষে কর্তৃপক্ষ এ বছরেই তা উদ্বোধন করবেন, ২০১২ সালের এপ্রিল মাস থেকে টাওয়ার দুটিতে বৃক্ষরোপণের কাজ শুরু হয়। যদিও এর মধ্যে তুষারপাত ও বৃষ্টির জন্য কয়েক মাস নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল তবুও এখন পুরোদমে চলছে এর নির্মাণকাজ এবং নির্মাতারা ২০১৩ সাল তথা এ বছরের মধ্যেই এটি চালু করবেন।

মিলান শহরে সবুজের স্বল্পতা থাকায় এমন পরিবেশে জীববৈচিত্র্য উৎসাহিত হয় না। পাখি এবং গাছে সৃষ্ট নানা কীটপতঙ্গের সমন্বয়ে এই নতুন বনায়ন-প্রক্রিয়া সৃষ্টি করবে একটি শহুরে বাস্তুসংস্থান। বস্কো ভার্টিক্যাল নগরের সম্ভাব্য পরিবেশগত বিপর্যয় কমিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থান তৈরিতে সহায়ক হবে।

ভবনটির প্রতিটি ব্যালকনি এবং বিভিন্ন পার্শ্বস্থ খোলা জায়গায় গাছ থাকলেও ভেতরের দিকে সেগুলো ধারণ করবে একেকটি অ্যাপার্টমেন্ট, গাছগুলো শহরের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালে ছায়া দেবে, গাছগুলোতে সেচ দেওয়ার জন্য ভবনটির নিজস্ব পানি উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে। অধিকন্তু এর ফটোভোলাটিক এনার্জি সিস্টেম টাওয়ারটিকে দিয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।

ভবনে বৃক্ষের আচ্ছাদন

বস্কো ভার্টিক্যালের নির্মাণশৈলী উৎসাহিত করে একাধারে নগরায়ণ এবং বনায়ন উভয়কেই। এর নির্মাতারা হিসাব কষে বের করেছেন উল্লম্ব বর্ধনের ফলে যে জায়গায় এত গাছ এবং আবাসনের সংকুলান হয়েছে তা আনুভূমিক তলে করতে গেলে খরচ হতো ৫০ হাজার বর্গফুট আবাদি জমি এবং ১০ হাজার বর্গফুট বনভূমি। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এর নির্মাতাদের মতানুসারে, এ রকম পরিবেশবান্ধব অ্যাপার্টমেন্ট বানাতে মাত্র ৫ শতাংশ খরচ বেশি হয় সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টের চেয়ে।

মেহেদী হাসান

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top