প্রকৃতিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের আকরিক থেকে বিগলন পদ্ধতিতে আলাদা করার পর প্রাপ্ত আংশিক ধাতু উপাদানই স্ল্যাগ। প্রকৃতিতে সুপ্ত অবস্থায় বিভিন্ন যৌগের সাথে এটি যুক্ত অবস্থায় থাকে। এটাকে কাজে লাগাতে প্রকৃতি থেকে যৌগের সংমিশ্রণ নিয়ে বিগলন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধাতু তৈরি করা হয়। বিগলন পদ্ধতিতে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আলাদা করে খুব সামান্য ধাতু পাওয়া যায়। স্ল্যাগের মিশ্রণে মেটাল অক্সাইড এবং সিলিকন ডাই-অক্সাইড থাকে। স্ল্যাগ সাধারণত ব্যবহৃত হয় পরিত্যক্ত স্ল্যাগ থেকে সঠিক স্ল্যাগ পেতে এবং এটা বিগলন মাধ্যমেই সম্ভব। স্ল্যাগের ব্যবহার রয়েছে অন্যান্য কাজেও। যেমন- বিগলনের সময় স্ল্যাগ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। স্ল্যাগ বিগলনের সময় বর্জ্য অপসারক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং কোনো চূড়ান্ত তরল স্ল্যাগ পণ্যে অক্সিডেশন কমিয়ে চুল্লি থেকে গলিত স্ল্যাগ মুছে ফেলে যাতে দৃঢ় কোনো স্ল্যাগ তৈরি করা যায় এমন কাজেও এর ব্যবহার রয়েছে।
স্ল্যাগ আকরিক ধাতু থেকে
প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধাতুর আকরিক যেমন- লৌহ, তামা, লেড, নিকেল, স্টিল ও অন্যান্য ধাতু সাধারণত বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। এটা প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধাতুর সাথে মিশ্রিত অবস্থায় আকরিক হিসেবে থাকে। এই সমস্ত আকরিক উচ্চ তাপমাত্রায় যখন গলানো হয় তখন গলিত অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ধাতু পৃথক করা হয়। স্ল্যাগ মূলত অনেকগুলো ধাতুর সংমিশ্রণ, যা গলিত অবস্থায় আকরিক হতে পৃথক করা যায়। ধাতু গলানোর প্রক্রিয়াতে অক্সাইড ব্যবহার করা হয় প্রধানত তিনটি কারণে। প্রথমত এটা রাসায়নিক স্ল্যাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। দ্বিতীয়ত স্ল্যাগ হতে দূষিত দ্রব্যাদি সরাতে সহায়তা করতে। তৃতীয়ত ফার্নেসে রিফ্রেকটরির লাইনিং যাতে অতিরিক্ত ক্ষয় হতে রক্ষা পায়। স্ল্যাগ হতে ধাতুর যৌগ সরানোর প্রক্রিয়াকে সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বলা হয়। এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে স্ল্যাগ থেকে স্টিল আলাদা করা যেখানে কুইকলাইম ও ম্যাগনেসাইট ব্যবহার করা হয় রিফ্রেকটরি সুরক্ষার জন্য। অ্যালুমিনা এবং সিলিকা ধাতুকে নিষ্ক্রিয় করা হয় স্টিল থেকে সালফার ও ফসফরাস পৃথক করার জন্য।
লৌহজাত এবং অলৌহজাত ধাতু বিগলনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্ল্যাগ উৎপাদন করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ কপার এবং লেড ধাতু অলৌহজাত ধাতু বিগলনের সময় ব্যবহার করা হয় যাতে লৌহ এবং সিলিকা সরানো যায় এবং পরিশেষে আলাদা করা হয় লৌহ-সিলিকা স্ল্যাগ হিসেবে। অন্যদিকে স্টিল মিলের লৌহের স্ল্যাগ গলানো হয় লৌহজাতীয় উপাদান পাওয়ার জন্য এবং যাতে খুব কম পরিমাণ লৌহের ক্ষতি হয়। এতে ক্যালসিয়াম অক্সাইড, সিলিকন, ম্যাগনেশিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়াম থাকে। কোনো বালুকাময় আকরিকের মূল উপাদান বা স্ফটিক উপাদান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিলিকন ডাই-অক্সাইড হিসেবে ধাতু বিগলন প্রক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

যেহেতু গরম স্ল্যাগ ফার্নেসে থাকতে থাকতে ফার্নেসের একাংশ সরু নালির মতো হয়ে যায় তাই এটার উপর পানি ঢালা হয়। খুব দ্রুত ঠান্ডা হওয়ার জন্য (তাপমাত্রা ২৬০০০ ফা.) স্ল্যাগ দানাদার হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঞ্চালিত বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটায় এবং সর্বশেষে স্ল্যাগ একটি কঠিন শক্ত ধাতুতে পরিণত হয়।
স্ল্যাগের ইতিহাস
যদিও নিত্যনতুন উন্নয়ন কাজে স্ল্যাগের ব্যাপক ব্যবহার হয় কিন্তু স্ল্যাগ নিজেই বিগলন প্রক্রিয়ায় উৎপাদক হিসেবে পুরনো। ইতিহাস মতে, ১৫৮৯ সালে জার্মানরা ঢালাই লোহা থেকে স্ল্যাগ কমানোর জন্য লোহার বল তৈরি করত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে ঢালাইকৃত লৌহ স্ল্যাগ রাজমিস্ত্রির কাজে ব্যবহৃত হতো।
রাস্তা নির্মাণের জন্য স্ল্যাগের ব্যবহার ছিল রোমান সাম্রাজ্যে। ২০০০ বছর পূর্বে রাস্তার ভিত্তি তৈরি করার জন্য অশোধিত লোহার তৈরি ফরগেজ ব্যবহার করা হতো। যুক্তরাজ্যে স্ল্যাগ দ্বারা প্রথম রাস্তা তৈরি হয়েছিল ১৮১৩ সালে এবং মাত্র ১৭ বছর পর স্ল্যাগ দ্বারা তৈরি প্রথম রাস্তা বঙ্গ দেশে তৈরি করা হয়। ১৮৮০ সালে স্ল্যাগ দ্বারা ঢালাইকৃত ব্লকে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছিল ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম স্ল্যাগ থেকে রাস্তা তৈরি করা হয়। তখন স্ল্যাগ সাধারণত ব্যবহার করা হতো জাহাজের পাদদেশে অতিরিক্ত ওজন বাড়ানোর জন্য, যাতে জাহাজটি পানিতে স্থির থাকতে পারে। এটাতে দূর থেকে মনে হতো মে মাসে প্রস্ফুটিত মে ফ্লাওয়ার জাহাজ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে।
তখন যদিও বিংশ শতাব্দীর পূর্বে স্ল্যাগের দীর্ঘকাল সর্বোচ্চ ব্যবহার ছিল। কিন্তু এটির প্রধান ব্যবহারকারী উপাদান হিসেবে সে দেশের ট্রেন চলাচলের জন্য রেলওয়ের পাত হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ক্রমেই স্ল্যাগের উৎপাদন বাড়ছিল। নতুনভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাদের জন্য স্ল্যাগের সাহায্যে রাস্তা নির্মিত হয়।
প্রাচীন যুগে স্ল্যাগের ব্যবহার
তাম্রযুগে ভূমধ্যসাগরের আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ধাতু প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ ছিল। পুরনো তামার ফাউন্ডিশপ থেকে বিভিন্ন ধরনের স্ল্যাগের নমুনা পাওয়া যায় এবং এদের পৃষ্ঠদেশ ছিল মসৃণ এবং বিভিন্ন রঙের স্বচ্ছ কাচের মতো। প্রাথমিকভাবে সেটি ছিল নীল এবং সবুজ রঙের। উচ্চচাপ প্রয়োগ করে স্ল্যাগ গলানো হতো, যাতে স্ল্যাসওয়ের বা স্বর্ণের কোনো কিছু তৈরি করা যায়। তখন পাউডারের সাহায্যে স্ল্যাগের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে সিরামিক ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য। প্রাচীন মিসরে উপজাত হিসেবে স্ল্যাগের ব্যবহার ছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, লৌহ জাতীয় আকরিকের পুনঃবিগলন পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত হতো। উন্নয়ন প্রযুক্তির মাধ্যমে স্ল্যাগ হতে আরো অধিক পরিমাণ লৌহ উৎপাদন করা সম্ভব। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে লৌহের স্ল্যাগ পাউডার দ্বারা ঘর্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে আরো উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে গ্লাস তৈরি করা হতো এবং এটা স্লেগ গ্লাস নামে পরিচিত ছিল।
আধুনিক স্ল্যাগের ব্যবহার
পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের সাথে প্রকৃতিতে দানাদার স্ল্যাগ প্রায় কংক্রিটে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটাতে মনে হয় স্ল্যাগটি যেন ব্লেন্ডেড সিমেন্টের অংশ। প্রকৃতির দানাদার স্ল্যাগ পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে সিমেন্টের মতো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। যে কংক্রিটে প্রকৃতির দানাদার স্ল্যাগ মিশ্রিত থাকে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। সিমেন্টের জমাটবদ্ধতা কম হয় যদি দ্রবণে ক্ষার জাতীয় সিলিকা ও সালফেটের তীব্রতা থাকে। সে জন্য পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের প্রতি ইউনিটের আয়তন কমে যায়।
উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কংক্রিট তৈরিতে রিসাইকেল পদ্ধতির স্ল্যাগ ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে সেতু নির্মাণে এবং সমুদ্রতীরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণে। যেখানে কম স্থায়িত্ব ও দীর্ঘ সময় ক্লোরাইড এবং সালফেট জাতীয় রাসায়নিক ক্ষয় জাতীয় সমস্যা থেকে রোধ করে অবকাঠামো নির্মাণের সহায়তা করতে পারে।
ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে সৃষ্ট স্ল্যাগ এবং সিমেন্টে এর ব্যবহার
ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে সৃষ্ট স্ল্যাগ একটি অধাতুজাত উপাদান, যা লৌহ তৈরি করার সময় ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে তৈরি হয়। এটাতে প্রাথমিকভাবে সিলিকা এবং অ্যালুমিনা লৌহের আকরিকের সাথে যুক্ত থাকে এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইডের সমন্বয়ে ফ্লুর স্ল্যাগ থেকে তৈরি হয়। ফার্নেসে যখন ১৫০০০ সে. তাপমাত্রা থাকে তখন এটা পাওয়া যায়। অর্থাৎ ঠান্ডা করার প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে প্রধান তিনটি স্ল্যাগের উপাদানকে পৃথক করা হয়।
(ক) স্বাভাবিক বায়ু দ্বারা ঠান্ডা করা স্ল্যাগ
এই ধরনের স্ল্যাগ ঠান্ডা করা হয় প্রকৃতিতে যে স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে সে তাপমাত্রায়। পিট থেকে স্ল্যাগ ঠান্ডা করে শক্ত স্ল্যাগে পরিণত করা হয়। ঠান্ডা হওয়ার পর এটা পেটানো হয় এবং যেভাবে প্রয়োজন সেই সাইজে তৈরি করা হয়। স্বাভাবিক বায়ু দ্বারা ঠান্ডাকৃত স্ল্যাগে সিমেন্টের খুব কম গুণাগুণ বিদ্যমান থাকে।
(খ) দানাদার স্ল্যাগ
দানাদার স্ল্যাগ ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে বের করার পর গলিত স্ল্যাগকে কুইনচিং (হঠাৎ ঠান্ডা করা) করে ঠান্ডা করা হয়। অনেক সময় সাধারণত বায়ু এবং পানি উভয় দ্বারাই কুইনচিং করে স্ল্যাগ তৈরি করে পরবর্তীতে সিমেন্টে ব্যবহার করা হয়। স্ল্যাগের উপাদান কীভাবে কত দ্রুত কুইনচিং হচ্ছে ইত্যাদির উপর নির্ভর করে দানাদার স্ল্যাগ তৈরি হয়। এটাকে স্লেগ গ্লাসও বলা হয়, যার গুণাগুণ অনেকটা পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের মতো।

(গ) সম্প্রসারিত স্ল্যাগ
ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে গলিত স্ল্যাগকে ঠান্ডা করার জন্য পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঠান্ডা করে স্ল্যাগ তৈরি করা হয় যাতে ভালো এবং উচ্চমানের হয়। এই জাতীয় স্ল্যাগ বর্তমানে অধিক ব্যবহৃত হচ্ছে এর গোলকার দানা বিশিষ্ট স্ল্যাগের গুণাগুণের জন্য।
ব্লাস্ট ফার্নেস হতে নির্গত স্ল্যাগ সিমেন্টে ব্যবহার হয় দুটি প্রধান উপায়ে। (ক) কাঁচামাল হিসেবে পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট উৎপাদনে। (খ) চকচকে স্ল্যাগের সাথে হাইড্রোটেট লাইম, জিপসাম অথবা এনহাইড্রেট জিপসাম, পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ইত্যাদির সংমিশ্রণে তৈরি প্রকৃতির স্ল্যাগ ব্যবহার করা হয় যেখানে এই ধরনের সিমেন্টের গুণাগুণ প্রয়োজন।
ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগের প্রচলিত ব্যবহার
- সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে।
- কংক্রিটের গাঁথুনি তৈরিতে।
- ছাদের ঢালাইয়ে।
- রাস্তার ভিত্তি তৈরিতে।
- রেলপথের নুড়ি হিসেবে।
- গ্লাস প্রস্তুতকরণে।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২