ঐতিহাসিক পটভূমি বিচারে জাপান শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতো জাপানও ছিল কৃষিভিত্তিক দেশ এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি, যা এখনো দেশটি সযত্নে লালন করে। পৃথিবীর একটি সর্বোচ্চ শিল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্তে¡ও উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করেও তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে তারা অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন। জাপানিদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও ভাষা নয় এ লেখার বিষয় জাপানিদের অভ্যন্তরীণ গৃহবিন্যাসের নান্দনিক বয়ান।
সৌন্দর্যপ্রিয়তা বা রুচিবোধে জাপানিদের তুলনা মেলা ভার। ছোট একটু জায়গা অতি অল্প অনুষঙ্গ দিয়ে ওরা এত দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজায় যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। প্রতিটি বাড়ির অন্দরবিন্যাস অত্যন্ত ছিমছাম ও বাহুল্য বর্জিত। সাধারণত বাড়ির শুরুতে প্রধান প্রবেশপথে যে ছোট্ট জায়গাটুকু থাকে তাতে পাদুকাদানি ছাড়া অন্য কোনো আসবাব নেই।
মেঝেতে বসে জলচৌকিতে খাবার প্রচলন জাপানিদের মধ্যে এখনো রয়েছে। সে কারণে ঘরের মেঝে সব সময় খুবই পরিষ্কার রাখা চাই। মেঝেতে সাধারণত কার্পেট, পিভিসি টাইলস, উডেন টাইলস এবং একটি রুমে অবশ্যই জাপানিদের ঐতিহ্যবাহী তাতামি (বাংলাদেশের মাদুরের মতো) দিয়ে পুরু মেঝে ঢেকে দেওয়া হয়। এই রুমটিতে জাপানিরা তাদের সম্মানিত অতিথিকে আপ্যায়ন করে। এরপর খাবার ও রান্নাঘরে আসা যাক। একটা জায়গা রয়েছে যেখানে কিছু সরঞ্জামাদি সাজিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়, যা খাবার ঘরের পাশেই সংযুক্ত। এই একই জায়গাকে একটু গুছিয়ে অন্য সময় বৈঠকখানা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।

এক রুমের বা একাধিক রুমের ঘর হোক না কেন কোনো বাড়িতে একাধিক শৌচাগার বা স্নানাগার নেই। শৌচাগার, বেসিন, স্নানাগার একটি গুচ্ছে বিন্যস্ত থাকে। যাতে এই তিনটি অতি ব্যবহার্য জায়গা একই সময়ে তিনজন ব্যবহার করতে পারে। এতে এগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাও সহজ হয়। এভাবে স্থানের বহুমাত্রিক ব্যবহারে সমান দক্ষ জাপানিরা। আমাদের জায়গার স্বল্পতা, জমির খুব অভাব কিন্তু জায়গা ব্যবহারের দিকে তাকালে আমরা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশকেই পেছনে ফেলে দিতে পারি। আমরা দুই শয়ন কক্ষ বিশিষ্ট হোক বা ততোধিক শয়ন কক্ষ বিশিষ্ট ঘর হোক আমাদের দুইয়ের অধিক টয়লেট থাকা চাই। আবার এই অতিরিক্ত জায়গার জন্য নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যায়। সবচেয়ে যা বেশি অপচয় হয় তা আমাদের দেশের জমি। একাধিক টয়লেট থাকাতে এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও সহজে নয়।
একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাব, আমাদের পুরনো বাড়িতে সবকিছু উন্মুক্ত করে না দিয়ে সেখানে রান্নাঘর, খাবার ঘর বা বৈঠকখানার সমন্বিত ব্যবহার রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, জাপানিরা এখনো কোনো কোনো অংশে সংরক্ষণশীল কম নয়।
বর্তমানে একটি আবাসন একক ইউনিটে গড়পড়তা যতজন লোক বাস করে আগে এর চেয়ে বেশি সংখ্যক লোক এর চেয়ে কম সংখ্যক টয়লেট দিয়ে তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছি। আমরা এখন সে সব বসতির ভাবনা ছেড়ে এসেছি অগ্রগতি আর ব্যক্তি সত্তার দোহাই দিয়ে কিন্তু জাপানিরা তা ধারণ করছে অগ্রগতি ও উন্নতির সাথে।

জাপানে উঁচু-নিচু সব ধরনের আবাসিক ভবনের সামনে-পেছনে টানা বারান্দা একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, এর কার্যকারিতা হলো ভেজা কাপড় নাড়তে দেওয়ায়। তা ছাড়া স্বল্প দৈর্ঘ্যরে এ বারান্দা গ্রীষ্মে অন্তর্বর্তী স্থান হিসেবে ভালো কাজ করে। ঘরের উচ্চতা একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ঘরের ভেতরের গড় উচ্চতা নয় ফুটের বেশি নয়। এটা হয়তো জাপানিদের গড় উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর তা ছাড়া বৈদ্যুতিক ছাদ পাখারও প্রচলন নেই।
গৃহ অভ্যন্তরে সুইং দরজার (Sewing door) চেয়ে স্লাইডিং দরজার (Sliding door) ব্যবহার বেশি। এতে স্থানের অপচয় কম হয় এবং প্রয়োজন বোধে স্লাইডিং দরজা সরিয়ে দিয়ে দুটি আলাদা রুমকে একটি বড় রুমে বদলে ফেলা যায়।
ফ্ল্যাট বা আবাসনের ক্ষেত্রফল অনুযায়ী শয়ন কক্ষের পরিসরের ভিন্নতা আছে কিন্তু কোনো শয়ন কক্ষই অতিরিক্ত আসবাব দিয়ে ঠাসা নয়। প্রায় প্রতিটি শয়ন কক্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ওয়াল কেবিনেট থাকাতে বাড়তি আলমারি বা ওয়ার্ড্রব রাখার প্রয়োজন পড়ে না। অন্য আসবাব যা-ই থাকুক তার উচ্চতা কম রাখার চেষ্টা করা হয়। এতে কক্ষের পরিসর দৃশ্যত প্রশস্ত দেখায়।

উন্নত জাতিসত্তায় নিজস্বতা বজায় রেখে জাপান তাদের আবাসন শিল্পকে আধুনিকতা দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের চাহিদাকেও মূল্য দিয়ে অপচয়বিহীন একটি উন্নতির ধারার প্রচলিত করেছে; এটি আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে তা অতীব জরুরি এবং যুক্তিযুক্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে জনবহুল ও সীমিত সম্পদের এ দেশের আমরা আমাদের আবাসন চাহিদার প্রয়োজনটুকু সহজেই মেটাতে পারব।
সৌমেন কান্তি বড়ুয়া
স্থপতি, স্থাপত্য পেশায় নিয়োজিত।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩১ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১২