সময়টা ২০১১ সালের ২৩ জুন। অনিন্দ্য পন্ডিত ও এস. এম. আমিরুল আরিফিন দিপ্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্যবিদ্যা আর মোহাম্মদ তালেব দ্য ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পাস করার পর তিনজনে মিলে গড়ে তোলেন ‘ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইন’ নামের ইন্টেরিয়র ডিজাইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ‘ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইন’ সাম্প্রতিক সময়ে অফিস স্পেস এবং অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে আধুনিক সব ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। ইনক্রাক্সের প্রতিষ্ঠাতারা এখন তাদের অভিজ্ঞতা নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে বিনিময় করতে চাইছে; আর এতে তাদের মাধ্যমটা ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইন।
শুরুর কথা
শুরুর কথা বলতে গিয়ে স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত জানান, “আমাদের দেশে যে হারে বিল্ডিং গড়ে উঠছে, এতে করে দেখা যায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের এ দেশে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। কিন্তু দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দরকার তার ১০ শতাংশও নেই। তাই এই অভাব পূরণের লক্ষ্যে আর্কিটেক্ট ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের সমন্বয়ে ‘ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইন’ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করি।” তিনি আরো বলেন, স্থাপত্যের সঙ্গে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। কর্পোরেট অফিসগুলো আসলে ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের মূল কর্মক্ষেত্র, অন্য পেশার লোকদের দ্বারা এ কাজ করিয়ে কর্পোরেট অফিসগুলো সন্তুষ্ট হয় না। বাংলাদেশে মূলত এ কারণেই ইন্টেরিয়র ডিজাইন একটি জনপ্রিয় ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এই পেশায় বাংলাদেশের স্থপতি ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করছে। বাংলাদেশের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অফিসগুলোর স্থাপত্যশৈলী ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের অফিসগুলোর চেয়ে অনেক বেশি মানসম্পন্ন বলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ইন্টেরিয়র ডিজাইন কী?
ইন্টেরিয়র ডিজাইন সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত বলেন, ‘Interior Design শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Intro থেকে, যার অর্থ ভেতর, এর সাথে যুক্ত হয়েছে Design শব্দটি, যার অর্থ নকশা। এই দুটি শব্দ একত্র করলে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় অভ্যন্তরীণ নকশা। তবে সাধারণত ইন্টেরিয়র ডিজাইন বলতে ঘর গোছানোকে বুঝে থাকি আমরা, বাস্তবে শুধু ঘর গোছানো নয়, ইন্টেরিয়র ডিজাইন শব্দটি আরো ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।’
ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের চাহিদা ও কর্মক্ষেত্র
ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের এখনকার চাহিদা ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পরিচালক স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত ও আরিফিন দিপ্ত বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকেই মূলত ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের মূল কর্মক্ষেত্র হিসেবে ভাবা হতো। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রয়োজনীয় ওয়ার্ক স্টেশন করার পরও পুরো বিষয়টি যাতে দৃষ্টিনন্দন হয় সে কারণে অফিস স্পেস নেওয়ার শুরুতেই তারা ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের শরণাপন্ন হয়। অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে লে-আউট থেকে শুরু করে রঙ বিন্যাস, লাইটিং এবং যথোপযুক্ত উপকরণ ব্যবহারের জন্য ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের কাছ থেকে শুরু থেকেই পরামর্শ নেওয়া হয়। এই বিশেষ পেশার পেশাজীবীরা একটি স্পেসের ব্যবহারোপযোগিতার পাশাপাশি একে নান্দনিক রূপ দেন।’

ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজের সুযোগ
এ পেশায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজের সুযোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইনের পরিচালক স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত বলেন, ‘এখন দেশে ইন্টেরিয়র ডিজাইন শেখার অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এ সংশ্লিষ্ট কাজের অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে মাসে একজন চাকরিজীবীর চাইতে বেশি আয়ের সুযোগ রয়েছে। এ পেশায় সৃষ্টিশীলতার আনন্দ যেমন আছে তেমনি আছে দারুণ চ্যালেঞ্জ। তাই যারা চাকরি করতে চান না এটি তাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে সৃজনশীল অথচ চ্যালেঞ্জিং একটি পেশা।’
ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হওয়ার যোগ্যতা
এ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন অনেক ইন্টেরিয়র ডিজাইন ইনস্টিটিউট রয়েছে যেখান থেকে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে। ভর্তির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা এসএসসি উত্তীর্ণ। পাশাপাশি থাকতে হবে ধৈর্য ও মনোযোগ। এ যোগ্যতাগুলোকে পুঁজি করে অনেকেই এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে নিজেই চালাচ্ছেন।’
প্রশিক্ষণের কোর্সসমূহ
আর্কিটেক্টদের দ্বারা পরিচালিত ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইনে ইন্টেরিয়র ডিজাইনিংয়ের উপর এক বছরের ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়া হয়। এখানে সাইট ভিজিট থেকে শুরু করে কন্সট্রাকশন বিভিন্ন ধাপে শেখানো হয় এবং পাশাপাশি ইন্টেরিয়র ড্রইংসহ সুপারভিশন, এস্টিমেট, কোয়ালিটি কন্ট্রোল হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যুগোপযোগী এ পেশায় অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন এবং প্রশিক্ষণের পর সফলভাবে তারা তাদের কর্মক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদি কোর্স হিসেবে রয়েছে ৩ মাস মেয়াদি Revit Architecture, ২ মাস মেয়াদি Auto Cad 2D & 3D, ১ মাস মেয়াদি Sketch up এবং ৩ মাস মেয়াদি Max. এ ছাড়াও আছে Exclusive Advance Training.
শিক্ষার্থীরা এ প্রতিষ্ঠানে যা পাচ্ছে
ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে ল্যাপটপ এবং এসি ক্লাস রুম, লাইব্রেরি, শিক্ষার্থীদের কাজ নিয়ে এক্সজিবিশন, সেমিনার। বুয়েট পড়ুয়া স্থপতিদের দ্বারা পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে যথাযথ ইন্টেরিয়র শিক্ষার ব্যবস্থা। বুয়েট স্থাপত্য বিভাগের জুরি (Jurry) পদ্ধতি এখানে ব্যবহার করা হয়, যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইনে রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীভেদে শতভাগ পর্যন্ত বৃত্তি দেওয়া হয়। কাজ পাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা দেওয়া ছাড়াও কেউ যদি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান খুলতে চায় তাহলে তাকে সর্বাত্মক সহায়তা করা হয়।
Building in a Nutshell শীর্ষক প্রদর্শনী
গত ১১-১২ নভেম্বর ২০১২ ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইন, ঢাকা আর্ট সেন্টারে Building in a Nutshell শীর্ষক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। আধুনিক বিশ্বে বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্র্রিতে BIM (Building Information Modeling) এখন অত্যাবশ্যকীয় একটি শব্দ। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত একটি বিল্ডিং মডেল থেকে এর সব ধরনের ইনফরমেশন বের করা সম্ভব। বিল্ডিংয়ের Construction system and Management, Electrical drawing, Plumbing drawing, Cost-estimation, Schedule, Energy efficiency, Green Performance সকল কিছুই একটি মাত্র মডেলে Integrated থাকে। এটাই BIM-এর কনসেপ্ট। এই প্রদর্শনীতে BIM-এর কনসেপ্টে কাজ করে এমন একটি সফটওয়্যার ‘Revit Architecture’-এর কাজ প্রদর্শিত হয়।
২১শে নকশার প্রদর্শনী
ইনক্রাক্স স্কুল অব ডিজাইনের শিক্ষার্থীদের নকশা নিয়ে ‘২১শে নকশা’ নামে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত স্থপতি সাইফ-উল-হক। বিশেষ অতিথি ছিলেন মনিরুজ্জামান শিপু। অনুষ্ঠান শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
স্কুলের অন্যতম পরিচালক স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগামীতে বিল্ডিং রিলেটেড আরো কিছু প্রোগ্রাম চালু করব, যা এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম হিসেবে গণ্য হবে।’

শেষ কথা
স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি অনিন্দ্য পন্ডিত তাদের স্কুলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানান, তাদের ইন্টেরিয়র প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য একদল দক্ষতাসম্পন্ন কারিগরি জনবল তৈরি করা, যারা বর্তমান স্থপতি ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের কাজের সঙ্গে দ্রুত নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আর তাদের স্বপ্নের স্কুলটি একদিন অনেক বড় হবে। আর এখান থেকেই দেশের স্বনামধন্য সব ইন্টেরিয়র ডিজাইনার বেরুবে, যারা এ দেশটাকে সাজাবে নতুন করে।
যোগাযোগের ঠিকানা
১৫২/২/কে গ্রীন রোড, ঢাকা-১২০৫
ফোন : ০১৭১৫-৯৯১৬৭৮৭
ই-মেইল : [email protected]
ওয়েব সাইট : www.incrux.com
ফেসবুক : www.facebook.com/incrux
- মেহেদী হাসান
ই-মেইল: [email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩২ তম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০১২