আত্মবিশ্বাসই সফলতার হাতিয়ার

শৈশবে ছিলেন প্রচণ্ড ডানপিঠে। স্কুল ও পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খুনসুটি লেগেই থাকত। মারামারিতে ওস্তাদির কারণে বড় ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁকে সমীহ করত। খেলাধুলার প্রতিও ছিল দারুণ ঝোঁক। খেলতেন ক্রিকেট। ছিলেন ফাস্ট বোলার। পড়ালেখায় মন ছিল না তেমন, আর তাই বড় ভাইয়ের হাত ধরে আসা ব্যবসায়। ভাইয়ের নিবিড় তত্ত্বাবধানে দুরন্ত সেই ছেলেটি হয়ে ওঠেন একজন সফল ও দক্ষ ব্যবসায়ী। তিনি হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের স্টেশন রোডের ‘মেসার্স কাশেম ট্রেডার্স’-এর স্বত্বাধিকারী মো. আবুল কাশেম। অবশ্য শিবলু নামেই এলাকায় তিনি সর্বাধিক পরিচিত। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির হবিগঞ্জের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেনের সহায়তায় জানাচ্ছি তাঁরই সফলতার গল্প।

ব্যবসায়ী শিবলুর জন্ম হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জের বড়চর গ্রামে ১৯৭৮ সালের ১৮ আগস্ট। বাবা হাজি আব্দুস সাত্তার মুন্সি ও মা হরফ চান বানু। পাঁচ ভাই দশ বোনের সংসারে তিনি সবার ছোট। শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি এবং শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে যাওয়ায় তা শেষ করতে পারেননি। ব্রিটিশ আমল থেকে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা। বাবা ছিলেন খ্যাতিমান ব্রিটিশ সৈনিক। ব্রিটিশরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁর বাবাকে ব্রিটেনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা গ্রহণ না করে এলাকাতেই শুরু করেন হার্ডওয়্যার ও ক্রোকারিজ সামগ্রীর ব্যবসা। একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ও ভালো মানুষ হিসেবে নিজ এলাকায় তিনি সুপরিচিত। বাল্যকাল থেকেই শিবলুর বড় ভাই মো. আবু জাফর ব্যবসায় বাবাকে সহযোগিতা করতেন এবং তাঁরই বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনায় ক্রমেই বাড়াতে থাকে ব্যবসার পরিসর। ফলে ব্যবসা দেখাশোনার জন্য শিবলুও যুক্ত হন তাঁদের ব্যবসায়। স্কুলজীবনেই ব্যবসায় হাতেখড়ি তাঁর। নিজের অজান্তেই বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় একজন দক্ষ ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। মূলত বড় ভাই-ই তাঁর ব্যবসায়িক আদর্শ। গুরুর মতো করে শিখিয়েছেন ব্যবসার নানা কৌশল। কিন্তু একপর্যায়ে বড় ভাই যখন আমেরিকায় পাড়ি জমান তখন ব্যবসায়ের হাল ধরতে হয় তাঁকেই।

বাবা ও বড় ভাইয়ের সান্নিধ্যে তিনি যে ব্যবসায়িক কৌশল আয়ত্ব করেন তা অনুসরণ করে ব্যবসার পরিধি বাড়ান কয়েকগুণ। সিমেন্ট, রড, স্যানিটারি, ইলেকট্রিকস, ঢেউটিন, রং, হার্ডওয়্যারসহ নির্মাণের প্রায় সব ধরনের পণ্য ব্যবসায় অন্তর্ভুক্ত করেন। বর্তমানে নির্মাণ পণ্য তথা বাড়ি তৈরির যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী নিয়ে তাঁর ব্যবসা। ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবসার পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাঁর ব্যবসায়িক সুনাম। ফলে কোম্পানিগুলোর কাছেও বেড়ে যায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। আর তাই পেয়ে যান ক্রাউন সিমেন্ট, শাহ সিমেন্ট, বিএসআরএম রড, একেএস রড, বার্জার পেইন্টস, এশিয়ান পেইন্টস, পেইলাক পেইন্টস, গরু মার্কা ঢেউটিন, পেডরোলো পাম্প, গাজী পাম্প, লিরা পাইপসহ  অসংখ্য কোম্পানির ডিলারশিপ। এ ছাড়া তিনি আকিজ সিমেন্টের একজন সম্মানিত প্রাইম সেলার। স্থানীয় কিছু পণ্যের ডিলারশিপও রয়েছে তাঁর। ব্যবসায়িক সাফল্যে কোম্পানিগুলোও তাঁর প্রতি দারুণ সন্তুষ্ট। স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে ভ্রমণ করেছেন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ। দেশে ঘুরেছেন কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবন। বিভিন্ন কোম্পানির কনফারেন্সেও তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। ভ্রমণসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব প্রায় সব সময়ই থাকে কিন্তু সময়াভাবে যোগ দিতে পারেন না। টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রো ওভেন, মোবাইল, নগদ টাকাসহ অন্দরসজ্জার নানা উপকরণই পেয়েছেন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। বর্তমানে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ বাজারে রয়েছে তাঁর তিনটা শোরুম ও চারটা গোডাউন।

বড় পরিসরের ব্যবসা সামলানো যে কারও পক্ষে কঠিন হলেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই তা পরিচালনা করছেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক তাঁর আত্মবিশ্বাস। চেষ্টা করেন সততার সঙ্গে ব্যবসা করতে। তাঁর ব্যবসা পরিচালনার মূলে রয়েছে চারজন ম্যানেজার ও প্রায় ৫০ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মচারীর সহযোগিতা। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁর আস্থাভাজন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। তবে ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ ক্রেতা। তাঁদের কখনোই অসম্মান করেন না। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি প্রায় ১০ বছর যাবৎ ঠিকাদারি করেছেন। কাজটি অত্যন্ত লাভজনক হলেও সততার সঙ্গে কাজ করা কঠিন, তাই কাজটি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সদস্য। এ ছাড়া বিগত প্রায় আট বছর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চলমান ব্যবসার পাশাপাশি ১০-১২ জন সমমনা বন্ধুকে নিয়ে করছেন ভূমির ব্যবসাও।

একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হলেও ব্যবসায়ী শিবলুকে প্রতিনিয়ত ব্যবসায়িক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদিও ব্যবসা প্রতিযোগিতাপূর্ণ, তারপরও কারও ব্যবসায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তিনি পছন্দ করেন না। কিন্তু প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী অসৎ এমনকি জঘন্য পন্থা বেছে নেন অপর ব্যবসায়িকে ঘায়েল করতে, যা তিনি কখনোই করেন না। বাকি বিক্রি ব্যবসার অংশ হলেও তা বেশ ক্ষতির কারণ বলে মনে করেন তিনি। নবীন ব্যবসায়ীদের প্রতি তাই তাঁর পরামর্শ, বাকি বিক্রয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। কারণ, ব্যবসায়িক ক্ষতির প্রথম ধাপই বাকি বিক্রয়। পণ্যের বাজার দর ওঠানামাও পণ্য বিক্রিতে ছন্দপতন ঘটায়।

সপরিবারে ব্যবসায়ী আবুল কাশেম শিবলু

ব্যবসায়িক ব্যস্ততাকে পিছু রেখে ২০০৬ সালে শামীমা আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সফল এ ব্যবসায়ী। তাঁর স্ত্রী শায়েস্তাগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন। তাঁদের দুটি সন্তান। বড় ছেলে আবু আহনাফ ইশতির বয়স সাড়ে চার বছর ও ছোট ছেলে আবু আরাহাম আইয়ানের বয়স মাত্র দুই মাস। ব্যবসা ও সামাজিক নানা কাজে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবুও তিনি পরিবারকে সময় দিতে চেষ্টা করেন। ভালোবাসেন আড্ডা দিতে। অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে ওঠেন আড্ডায়। তাঁদের নিয়ে গাড়িতে করে ঘুরতে বের হন। নিজের ভাইপো ও ভাগনেদের অনেকেই তাঁর সমবয়সী। তারাও অনেকটা ছায়ার মতো তাঁকে সঙ্গ দেয়। একা কোথাও বেড়াতে ভালো লাগে না, তাই তাদের কাউকে না কাউকে সঙ্গী করে নেন।

ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক কাজেও জড়িত ব্যবসায়ী শিবলু। বর্তমানে তিনি তাঁর গ্রাম পঞ্চায়েত ও শায়েস্তাগঞ্জ শ্যামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি। এলাকার দরিদ্র মানুষদের নানাভাবে সহায়তা করেন। বিবাহ, চিকিৎসায় সহায়তা, তাঁদের শাড়ি-লুঙ্গি দান করেন, মসজিদের নির্মাণে সহায়তাসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে প্রতিনিয়তই জড়িয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া প্রতিবছর আয়কর দেন তিনি।

তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসাকে আরও সমৃদ্ধ করতে চান ব্যবসায়ী শিবলু। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাচুর্যতার কারণে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান শায়েস্তাগঞ্জে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী হওয়ায় এলাকাটি শিল্পাঞ্চল হয়ে উঠতে পারে। সেখানে একটি ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করাই তাঁর এখনকার স্বপ্ন।   

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪০ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top