ঝুঁকিমুক্ত পোশাক কারখানা নির্মাণে

জাতীয় অর্থনীতিতে পোশাকশিল্প মূলত দুভাবে অবদান রাখছে। এক. কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে; দুই. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে। দেশের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে চালু রয়েছে ৩৬ হাজার পোশাক কারখানা। এখানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৪৪ লাখ। বর্তমানে বিশ্বের ১৩০টি দেশ বাংলাদেশের পোশাকের ক্রেতা। আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে পোশাকশিল্পের এ বাজার হবে দ্বিগুণ আর ২০২০ সালে যার রয়েছে তিনগুণ হওয়ার সম্ভাবনা।

বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের শুরুটা অপার সম্ভাবনা নিয়ে, কিন্তু বর্তমানে এই শিল্প বহুমুখী সংকটে জর্জরিত। ২৪ নভেম্বর ২০১২ তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনে ১১৭ জন, ২৪ এপ্রিল ২০১৩ সাভারের রানা প্লাজাধসে এক হাজার ১৩০ জন নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির বিষয়টি সামনে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের হুমকি দেয়। বিগত দুই বছরে পোশাক খাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ঘুরেফিরে দুটি প্রধান সমস্যাই বারবার আলোচনায় আসে। এক. পোশাক কারখানার ভবনগুলোর সংকটাপন্ন পরিবেশ (অবকাঠামো ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা) দুই. শ্রমিক অসন্তোষ যা মূলত শ্রমিক মজুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমস্যাগুলো দূর করার জন্য দ্রুতই বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্পটি বিকাশের স্বার্থে।

পোশাক কারখানার নিরাপদ পরিবেশ

প্রধান বিবেচ্য

সম্প্রতি ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা ও অবকাঠামো যাচাই এর লক্ষ্যে বুয়েটের স্থাপত্য ও প্রকৌশলবিভাগের সমন্বয়ে দুটি পৃথক টিম কাজ করে। বুয়েটের স্থপতি, পুরকৌশল, যন্ত্রকৌশল, ইন্ডাষ্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ও তড়িৎ প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে গঠিত অগ্নিনিরাপত্তা পরিদর্শনের টিম লিডার ও বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং এন্ড কনসালটেশন (বিআরটিসি) এর কনসালটেন্ট হিসাবে ২৫টি পোশাক কারখানা পরিদর্শণের সময় খুব কাছ থেকে শ্রমিক, মালিক ও ভবনগুলি দেখার সুযোগ হয়। পোশাক কারখানার নিরাপত্তা পরিদর্শনে গিয়ে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ৩টি বিষয় বিবেচনায় নেয়। যার মধ্যে রয়েছে ভবনের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা ও ভবন নির্মাণ। যেসব কারখানা বন্ধ করা হয়েছে সেগুলোর ভবনের অগ্নিনিরাপত্তাজনিত সমস্যা ৩০ থেকে ৩৫টি, বৈদ্যুতিক নিরাপত্তাজনিত সমস্যা ২৮ থেকে ৩০টি আর ভবন নির্মাণজনিত সমস্যা পাঁচ থেকে সাতটি চিহ্নিত করা হয়, যা একটি পোশাক কারখানাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিতে যথেষ্ট বলে মনে করেছে পরিদর্শক দল। পোশাকশিল্পে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ ভবনগুলোর ৯০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ৪০ শতাংশই শেয়ার্ড বিল্ডিং, যা ভাড়া করা কিংবা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলা। রূঢ় বাস্তবতা হলো, অনেক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ পোশাক কারখানা ভবনগুলো চাইলেই রাতারাতি স্থানান্তর করা সম্ভব নয়।

পোশাক শ্রমিকেরা তাঁদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সুব্যবস্থাসহ একটি নিরাপদ ভবনে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়। নিরাপদ ভবনে কাজের পরিবেশ স্থায়ীভাবে নিশ্চিত করতে ত্রুটিপূর্ণ ভবনে অবস্থিত কারখানাগুলো স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি দিক বিবেচনায় নতুন ভবনটি দুই তলার অধিক না হওয়াই ভাল। দ্রুততম সময়ে নির্মাণের বিষয়টি মাথায় রেখে ইস্পাত বা স্টিলের (প্রি-ফেব্রিকেটেড) ভবন নির্মাণই হবে উপযুক্ত পছন্দ। পোশাক খাতে বর্তমানে নিয়োজিত কারখানার ১৬ শতাংশ ভবন আবাসিক ও অন্যান্য ভবনকে কারখানায় রূপান্তর করে (কনভার্টেড ভবন) ও ৩০ শতাংশ কারখানার অবস্থিত ভবন নির্মিত ভাগাভাগি করে (শেয়ার্ড ভবন)। কনভার্টেড ও শেয়ার্ড ভবনে কারখানা থাকলে সেই ভবনের কারখানা থেকে ভবিষ্যতে পোশাক কেনার বিষয়ে ক্রেতাদের নেতিবাচক মনোভাব আছে। তাই দ্বিতীয় ধাপে, কনভার্টেড ও শেয়ার্ড বিল্ডিং থেকে কারখানা সরিয়ে নিতে হবে।

বিপদ মোকাবেলায় দ্রুত প্রস্থান সিঁড়ির স্কেচ

পোশাক কারখানার বিকেন্দ্রীকরণ

সব ধরনের নতুন কারখানা ঢাকা শহর বা অন্য বিভাগীয় শহরের পরিবর্তে উপশহরে বা গ্রামে শ্রমিকের বসবাস স্থানের কাছে স্থাপন করতে হবে। প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের দেশের শ্রমঘন এই খাতে প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ বা ৩৫ লাখই গ্রাম থেকে আসা হতদরিদ্র নারী শ্রমিক। শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাঁরা তাঁদের পরিবার ও ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে আসেন। এ ক্ষেত্রে শহরে তাঁদের বর্তমান আবাসস্থলও একইভাবে অস্বাস্থ্যকর ও নিরাপত্তাহীন। শুধু কাজের জন্য শহরে বাস করলেও প্রাপ্য মজুরির সিংহভাগ চলে যায় বাসাভাড়া বাবদ। মজুরির বাকি অংশ দিয়ে কোনোভাবে খাওয়া-পরার খরচ মেটানোর পর অতি সামান্যই তাঁরা সঞ্চয় করতে পারেন বা গ্রামে পাঠাতে পারেন। যদি পোশাক কারখানাটি শ্রমিকদের কর্মস্থলের কাছাকাছি হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে কমে যাবে এবং তাঁরা তাঁদের বর্তমান মজুরিতে অনেক বেশি স্বচ্ছল ও সন্তুষ্টি নিয়ে গ্রামে পরিবারের সান্নিধ্যে প্রশান্তি নিয়ে বাস করতে পারবেন। বাসস্থান ও কর্মস্থল নিজেদের পরিচিত গন্ডির মধ্যে হওয়ার যে সামাজিক সুবিধা ও পারিবারিক নিরাপত্তা তাঁরা পাবেন, তার মূল্য অনেক বেশি।

পোশাক কারখানাগুলো গ্রামে হলে গ্রামের মানুষ ও গ্রামকেন্দ্রিক সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। উল্লেখ্য, সব মালিকেরই ঢাকার আশপাশে চার-পাঁচ বিঘা জমি আছে। সেখানে তাঁরা কারখানা ভবনগুলো স্থানান্তর করতে পারেন। কিন্তু সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সুবিধাগুলো থাকতে হবে আগে। প্রস্তাবিত ভবনগুলো দুই তলা ও পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে ভবনের বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জ্বালানি শক্তির চাহিদা তুলনামূলক কম হবে। এ ক্ষেত্রে তিন-চারজন কারখানার মালিক যদি স্ব-উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে তাঁদের কারখানার আশপাশে জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে সম্মত হন; সে ক্ষেত্রে জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে কম খরচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এলাকার বিদ্যুৎ-ঘাটতিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বুয়েটের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মাধ্যমে সমগ্র বুয়েট ক্যাম্পাসে জাতীয় রেটের চেয়ে কম রেটে গত ১০ বছরের অধিক সময় ধরে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের সফলতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

চিত্র-১: দুই তলাবিশিষ্ট কারখানা ভবনে অগ্নিনিরাপত্তাসহ আলো-বাতাস চলাচলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা

ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ অবকাঠামো

নির্মিতব্য যেকোনো পোশাক কারখানার ভবনগুলো প্রথমত, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের শ্রেণীভুক্ত না হওয়াই ভালো, এর জন্য বিএনবিসি ও এনএফপিএ কোড যথেষ্ট শিথিলযোগ্য। আর তাই খুব সহজেই আন্তর্জাতিক মানের সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট কারখানা ভবন তৈরি করা সম্ভব। ভবনগুলো দুই তলাবিশিষ্ট হওয়ার কারণে নির্মান করা সম্ভব হবে দ্রুতই। এতে অগ্নিনিরাপত্তাসহ আলো-বাতাস চলাচলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সহজ হবে। ভবনের নিচতলা, গ্যারেজ, গুদাম বা এ জাতীয় কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। আর ওপর তলা উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট করা যেতে পারে (চিত্র-১)। এ ছাড়া, ছাদের মধ্যে ছিদ্র করে স্থাপত্যিক ডিজাইনের মাধ্যমে বিল্ডিংয়ের মধ্যে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশের সুব্যবস্থা করে বিদ্যুতের ওপর চাপ বহুলাংশে কমানো সম্ভব। সৌরবিদ্যুৎ বা রিনিউবল এনার্জি ডিজাইনে সমন্বয় করে কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব ও অধিকতর জ্বালানিসাশ্রয়ী করেও নির্মাণ করা যেতে পারে। স্টিল ফ্রেম ব্যবহার করে কলাম ছাড়া বৃহত্তর পরিসরের মেঝেবিশিষ্ট কাজের স্থান আচ্ছাদন করা সম্ভব, যা পোশাক কারখানার কাজের প্রকৃতি ও গতিশীলতা বাড়াতে সহায়ক। এ প্রক্রিয়ায় সহজেই স্থানান্তরযোগ্য ভবন তৈরি করা সম্ভব।

স্টিল ফ্রেম ব্যবহারে কারিগরি সুবিধা

স্টিলের শক্তি কিংবা ওজন অনুপাতে অনেক বেশি আরসিসির তুলনায়। স্টিল ফ্রেম ভবনের নিজস্ব ভার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এ জন্য বহুতল ভবন, বড় মানের স্প্যানের বিল্ডিং, নরম মাটির ওপর তৈরি ভবন কিংবা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় তৈরি কারখানার জন্য স্টিলের ফ্রেমের ভবন বিশেষভাবে উপযোগী।

ভবন কক্ষের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিলে আরসিসি বা ইটের তৈরি ভবনের তুলনায় স্টিল ফ্রেম অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ, স্টিলের ভবন বা ফ্রেম হঠাৎ করে ভেঙে পড়ে না। ভাঙার আগে দুমড়ায় বা মোচড়ায় বা আস্তে আস্তে বেঁকে যায়, যা বাইরে থেকে দেখা যায়। ফলে প্রয়োজনীয় সতর্কতা বা সংস্কারের সুযোগ পাওয়া যায়।

স্টিলের নির্মিত ভবনের মান নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ। যেমন- একটি আরসিসি কলামের ডিজাইনে প্রকৌশলী সঠিক মাপের রড, সিমেন্ট, বালু ও পানির অনুপাত উল্লেখ করার পরও কলাম কাটিংয়ের সময় যদি সঠিক মাপের রড দেওয়া না হয় বা পানির অনুপাত কমবেশি হয় বা সিমেন্ট, বালু ও পানির মিশ্রণ সঠিক না হয় বা পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করা হয়, তবে কাক্সিক্ষত স্ট্রেন্থ পাওয়া যায় না। যদিও কোনো কারণে একবার কাটিং হয়ে যাওয়ার পর দুর্বলতা ধরা পড়লেও ত্রুটিপূর্ণ কলামটিকে সরানো বা ত্রুটিমুক্ত করা যথেষ্ট কষ্টকর। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরসিসি কলামের স্ট্রেন্থ বাড়তে বা কমাতে পারে। অপরদিকে স্টিলের একটি আই কলাম যখন নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয়, তখন সুনির্দিষ্টভাবেই এর স্ট্রেন্থসহ অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই চেক করা যায়, যা নির্মাণ-পরবর্তী সময়েও একই থাকে। প্রয়োজনে কোনো ত্রুটি চোখে পড়লে সহজেই তা পরিবর্তন করা যায়।

অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় অগ্নি নি‍র্বাপক যন্ত্রপাতি

স্টিলের ভবন আরসিসি ভবনের তুলনায় খুব তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব। ধরুন, ১০ হাজার স্কয়ার মিটারের একটি আরসিসি ভবন তৈরি করতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে কিন্তু একই আয়তনের স্টিলের ভবন দুই মাসের মধ্যে তৈরি করা সম্ভব।

স্টিলের ভবন অনেক নিখুঁতভাবে তৈরি করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রতিটি কলাম, বিম, স্লাবের ও জয়েন্টের একই স্ট্রেন্থ নিশ্চিত করা যায়। কোনো খুঁত ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা যদি একটি নির্দিষ্ট কলাম বা বিম পরিবর্তনের মতো বিষয় হলেও কারখানার স্বাভাবিক উৎপাদনকে স্বল্প ব্যাহত করে। এটি আবার তুলনামূলকভাবে কম খরচে ঠিক করা যায়। 

বাংলাদেশে পোশাক কারখানা ভবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা প্রসার লাভ করলে এর উৎপাদন বাড়ে। ফলে কারখানাটিকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তনের চাপের মধ্যে পড়তে হয়। স্টিলের ভবনের আশপাশে যদি যথেষ্ট পরিমাণে ভবিষ্যতে বিস্তৃত করার জন্য ফাঁকা জায়গা রেখে দেওয়া হয় (শুধু গ্রামে বা উপশহরে অবস্থিত হলেই সম্ভব) তবে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনমতো ভবনকে পাশে বাড়ানো সম্ভব। অর্থাৎ খুব সহজেই একটি বা দুটি লাইন যোগ করা যায়। আবার কমানোও যায় কিংবা একেবারে পুরো বিল্ডিং খুলে অন্যত্র স্থাপন করাও সম্ভব।

অসুবিধা যত

স্টিলের ভবন তৈরির সময় এর কিছু অসুবিধার বিষয়ও মাথায় রাখা উচিত। প্রথমত, স্টিল বিল্ডিংয়ের নির্মাণখরচ তুলনামূলকভাবে বেশি, আরসিসি কলামের তুলনায় স্টিলের কলামের অগ্নিপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাই আগুন লাগলে কলাম তথা পুরো বিল্ডিং খুব তাড়াতাড়ি গরম হয়ে স্টিলের স্ট্রেন্থ কমে যেতে পারে। তাই ভবনের স্টিলের খোলা অংশগুলোকে যথাযথভাবে অগ্নিপ্রতিরোধক দিয়ে ঢাকতে হবে। আমাদের দেশে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি বলে খোলা স্টিলের ওপর সহজেই মরিচা ধরে। তাই এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

গা‍র্মেন্টস কারখানার সত‍র্কীকরণ চিহ্নসমূহ

ভবনের ডিজাইন যেমন হবে

পোশাক কারখানা ভবনে আগুন লাগলে শ্রমিক যেন স্বল্পতম সময়ে ভবন থেকে বের হতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। কারখানায় ঢোকা ও বের হওয়ার দরজায় পৌঁছানোর পথ হতে হবে সহজ ও সঠিকভাবে নির্দেশিত। দরজাগুলো বাইরে যাওয়ার দিকে খুলতে হবে এবং হতে হবে পর্যাপ্তসংখ্যক, প্রশস্ত, অগ্নি ও ধোঁয়া প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, শ্রমিকের অবস্থানের নির্দিষ্ট সীমার ভেতর, কারখানার ভেতর ও বাইরে থেকে সহজে দৃশ্যমান। আর সার্বক্ষণিকভাবে আলোকিত ও তালাবদ্ধ রাখা যাবে না। কারখানা ভবনে নিচতলার দরজাগুলোর অবস্থান এমন হতে হবে যেন সহজেই সাইট থেকে রাস্তায় বা খোলা জায়গায় বের হওয়া যায় এবং কখনোই যেন বেরোনোর পথটি অন্য ভবনের বা সাইটের মধ্য দিয়ে না হয়। খেয়াল রাখতে হবে, কারখানার মেঝে ও করিডর, যেসব জায়গা দিয়ে প্রচুর শ্রমিক চলাচল করেন, সেসব স্থান যেন সমতল ও অমসৃণ হয়। ভবনে আগুন লাগলে এই সব জায়গায় হোঁচট খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অগ্নিনির্গমন পথগুলোতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এমন  নির্মাণ উপাদান ডিজাইনে পরিহার করা উচিত। কারখানা ডিজাইনে অন্ধগলি পরিহার করতে হবে। কারখানার প্রতিতলা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য থাকতে হবে একাধিক বিকল্প সিঁড়ি ও পথ। সিঁড়িগুলো বাধামুক্ত ও অমসৃণ হতে হবে। পরিকল্পিতভাবে মেশিনবিন্যাস ও অনান্য আসবাব সাজাতে হবে যেন এগুলোর মধ্য দিয়ে যথাযথ নিয়মে পর্যাপ্ত পরিমাণে চওড়া পথ থাকে। এখানকার কারখানাগুলোতে যত্রতত্র কাপড় ও কার্টন স্তূপ করে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমায়; বাড়ায় কাজের গতি। আগুন লাগলে স্বল্পতম সময়ে সতর্কীকরণ ও নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি থাকতে হবে। কারখানায় সর্বক্ষণ প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

কারখানার ভেতর থাকতে হবে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য হাতে বা কাঁধে করে না নিয়ে উপযুক্ত ট্রলি ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শ্রমিকদের গ্লাভস, এপ্রোন ও কেডস পরে কাজ করতে হবে। কারখানার মধ্যে শব্দদূষণের মাত্রা যতটা সম্ভব কমাতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, দাহ্য বস্তু, বাষ্প ইত্যাদি সংক্রান্ত সরজ্ঞামাদি ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ভবনের বেইজমেন্টে অতিরিক্ত মানুষ ও দাহ্য বস্তুর উপস্থিতি পরিহার করতে হবে। ভবনে যেন ডেম্পনেস না হয়, বিশেষ করে ইলেকট্রিক্যাল লাইন ও বক্সের আশপাশে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হঠাৎ করে যেন কোনো মেশিন চালু না হয়, বিশেষ করে বিদ্যুৎচালিত মেশিন ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সর্বোপরি, শ্রমিকদের কাজের দক্ষতা ও নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, কারখানায় বয়লারের অবস্থান হতে হবে বিল্ডিংয়ের কিনারা বা বাইরে। বয়লার রুমটি আগুন ও ধোঁয়া প্রতিরোধক শক্ত দেয়াল ও দরজা দিয়ে মূল কারখানা থেকে আলাদা রাখতে হবে, যেন যেকোনো দুর্ঘটনায় মূল কারখানা বা শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। একই নিয়ম প্রযোজ্য জেনারেটর রুম, ট্রান্সফরমার রুম ও সাবস্টেশন রুমের ক্ষেত্রে। আরেকটি বহুল প্রচলিত আগুন লাগার কারণ হলো ইলেকট্রিক্যাল শর্টসার্কিট। কারখানা বিল্ডিংয়ের ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল লোড ডিস্ট্রিবিউশনের কাজটি যথাযথ দক্ষ প্রফেশনাল দিয়ে করানো উচিত।

পোশাক কারখানা নি‍র্মাণে স্টিল স্ট্রাকচার

ভবনধস যে কারণে

কারখানার ভবনধসের কারণগুলো কমবেশি একই রকম। যেমন- ভবনের ফাউন্ডেশনের ক্ষমতার তুলনায় অতিরিক্ত ভার চাপিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ চারতলার ফাউন্ডেশনের ওপর আটতলা আর ছয়তলা ফাউন্ডেশনের ওপর দশতলা ভবন নির্মাণ। এ ছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ ফাউন্ডেশন ডিজাইন বা কাস্টিং (যা স্পেকটার্ম সোয়েটার ফ্যাক্টরির ক্ষেত্রে ঘটেছিল), নরম মাটি বা খাল-বিল ভরাট করে যথাযথ নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ করলে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটে। ভবন নির্মাণ পূর্ব স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও নির্মাণকালীন  ডিজাইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সুপারভিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণের আগে ও পরে কনস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালের স্ট্রেন্থ টেস্ট ও সার্টিফিকেট সংরক্ষণ জরুরি, যা ভবনধসের আশঙ্কা অনেক কমিয়ে দেয় ও ধস পরবর্তী কারণ নির্নয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

নির্মাণকালীন নিম্নমানের কনস্ট্রাকশন মেটারিয়াল ব্যবহার; যেমন- নিম্নমানের রড, সিমেন্ট, ইট, বালুর ব্যবহার ভবনধসের অন্যতম কারণ। ভবন ধসের আরেকটি কারণ দুর্বল কলাম ও মূল কলাম ছাদের দুর্বল জয়েন্ট। ভবনের একটি বা দুটি বিম ভেঙে পড়লে ভবনটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কিন্তু একটি কলাম ভেঙে পড়লে চেইন রিয়াকশনের মতো পুরো ভববনটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে। আরেকটি বিষয় সব ভবনধসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত অধিকাংশ ভবনগুলি ছিল অপরিকল্পিত ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনহীন।

মানতে হবে যা কিছু

মানতে হবে বিধিবিধান

বিধি মেনে চলতে হবে সর্বক্ষেত্রে; যেমন- কারখানা ডিজাইন করার সময়, নির্মাণকাজের সময়, নির্মাণ-পরবর্তী সংস্কারকাজের সময়, এ সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যবহারের সময়। 

মান বজায় রাখতে হবে

আমাদের এখানে প্রথমে ছোট পরিসরে কারখানাগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকলে ছোট এই কারখানাতেই অনেক মেশিন ও শ্রমিক ঢোকানো হয়। এরপর কারখানাটিকে পাশে বাড়ানোর কোনো সুযোগ না থাকায় ওপরে বাড়ানো শুরু হয়, একই সঙ্গে ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা ও ধসের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। এখন যেসব ভবন নতুন তৈরি হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রে ডিজাইনগতভাবে প্রশংসার যোগ্য না হলেও ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেক নিরাপদ। অন্যদিকে অনেক পুরোনো কারখানা, যা পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করে ডিজাইন করা হয়েছিল। বর্তমানে অধিকতর শ্রমিক ও উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং নির্মাণ-পরবর্তী ভবনের নিরাপত্তা ও অবকাঠামোর মান ধরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপত্তার খাতিরে কারখানার বৃদ্ধি স্থগিত রাখতে হবে অথবা কারখানা স্থানান্তর করতে হবে। 

পোশাক কারখানায় তৈরিকৃত পোশাক প্রদ‍র্শনী

নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে

আমাদের দেশে দেখা যায় কোনো একটি ভবন নির্মাণের সময় বা ব্যবহারের আগে অনেক সংস্থার পক্ষ থেকে পরিদর্শন, অনুমোদন ও সনদপত্রের দরকার হয়। এরপর ভবনটি যেভাবে অনুমোদিত হয়েছে সেভাবে কাজ করছে কি না তা দেখার আর প্রয়োজন মনে করা হয় না। এর ফলে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউটিলিটির ব্যবহার বাড়তে থাকে। যদি তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে, তবে সমস্যা নেই কিন্তু লাগামহীন হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই নির্দিষ্ট সময় পর নিরাপত্তার স্বার্থে মালিকপক্ষের উচিত নিজস্ব বা বাইরের অভিজ্ঞ পরিদর্শক দ্বারা কারখানা নিরাপত্তা মূল্যায়ন ও নিশ্চিত করা। 

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

মালিক-শ্রমিকের সচেতনতা, দক্ষতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। অগ্নি মহড়া থেকে শুরু করে সঠিকভাবে মেশিন পরিচালনা পর্যন্ত সবকিছুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। আমেরিকার Occupational Safety and Health Administration (OSHA)-এর তথ্যমতে, বিপজ্জনক পরিবেশের কারণে ৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে, ৯৫ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ শ্রমিকের অনিরাপদ বা ভুল কাজের কারণে। শুধু ২ শতাংশ দুর্ঘটনা অনিয়ন্ত্রিত কারণে ঘটে থাকে আর ৯৮ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। সুতরাং ব্যবস্থাপনার যথাযথ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ জরুরি। শ্রমিককে উদ্বুদ্ধ করতে হবে নিরাপদে ও যথাযথ নিয়মে কাজ করতে। এতে কারখানার উৎপাদনশীলতাও বাড়বে।

গবেষণা

এ ক্ষেত্রে গবেষণা যেমন হতে হবে ভবনের কারিগরি দিক নিয়ে একইভাবে কারখানার পরিবেশ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, মনস্তত্ত¡, দুর্ঘটনার কারণ ও পরিসংখ্যান বিষয়েও গবেষণা হতে হবে; যদি আমরা এই  পোশাক খাতটিকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাই।

বিমাকরণ

দুর্ঘটনা এমনই একটি বিষয়, যা শতভাগ এড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলোতেও ভবন, কারখানা ও শ্রমিকসংক্রান্ত দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান একেবারে কম নয়। সুতরাং দুর্ঘটনা-পরবর্তী মালিক ও শ্রমিকের ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য বিমাকরণ জরুরি।

রানা প্লাজার ধ্বংসযজ্ঞ

শেষের আগে

রাজউকসহ অন্যান্য ভবন অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সজাগ থাকতে হবে যেন অনুমোদনহীন কোনো  পোশাক কারখানা ভবনের নির্মাণকাজ চলতে না পারে। অনুমোদন ছাড়া নির্মাণের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে যেন অন্যরা এ বিষয়ে সতর্ক হয়। তবে এ ক্ষেত্রে, আইনের কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। যেমন- বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট ১৯৫২তে ভবনের নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন রেগুলেশনে ২০০৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভবনের কাঠামোগত ডিজাইনে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের সম্পৃক্ততা বাধ্যতামূলক ছিল না। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) সরকার অনুমোদিত ও আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত হয় ২০০৬ সালে। ফলে, ২০০৬ সালের আগে নির্মিত অধিকাংশ কারখানা ভবনকে আইনের আওতায় আনা প্রশ্নসাপেক্ষ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে, সব নির্মাণ যেন পরিকল্পিত ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত হয়। সব ধরনের পোশাক কারখানা ভবন যেন বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়।       

ড. মো. আশিকুর রহমান জোয়ার্দ্দার

সহকারী অধ্যাপক ও টিম লিডার

স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

কনসাল্টিং আর্কিটেক্ট টিচারস ফোরাম-বিআরটিসি, বুয়েট

আইএলও- ফায়ার অ্যান্ড ইলেকট্রিকাল সেফটি এসেসমেন্ট ইন এক্সজিস্টিং আর এম জি ফ্যাক্টরী বিল্ডিং প্রজেক্ট, বুয়েট।

ashikj2000@gmail.com
তথ্যসূত্র: বিভিন্ন জার্নাল ও জাতীয় দৈনিক ।

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫১ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top