কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ (loT)-এর আবিষ্কার হয়েছে, যার সঙ্গে এখন সংশ্লিষ্ট সব সহায়ক বিষয়ের সংযোগও ঘটে চলছে। যেমন ক্লাউড কম্পিউটিং, ব্লক চেইন, সাপ্লাই চেইন, আরএফআইডি ইত্যাদি। এভাবে বর্তমানে বিশ্বের অনেক জায়গায় অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাসহ অনেক দৈনন্দিন কাজ এই অত্যাধুনিক বা ‘পাওয়ার ওভার ইথারনেট’ (PoE) পদ্ধতিতেই চলছে। এতে একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা সহজ বা কম্পিউটারভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে, তেমনি আবার আতঙ্কও দেখা দিতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে মানুষ কী তাহলে বেকার হয়ে যাবে, আলস হয়ে মোটা বা অসুস্থ হয়ে যাবে? বিশেষ করে বর্তমানে সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ বিভিন্নভাবে নির্মাণশিল্প বা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, আর এই নির্মাণজগৎ যদি পুরোটাই কম্পিউটারাইজড বা স্মার্ট/ইন্টেলিজেন্ট হয়ে যায় এবং সবকিছুই যদি ‘স্মার্ট বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি’র আওতায় চলে যায়, তাহলে আমাদের মতো দেশের ও অপরাপর জনঘনত্বপূর্ণ দেশের নির্মাণশ্রমিকদের কী অবস্থা হবে?
বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে নির্মাণজগৎকে অটোমেটিভ করার ধারণাটি প্রথম মাথায় আসে ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদ কেভিন অ্যাশটনের, যিনি বিশ্বখ্যাত অটো-আইডি সেন্টারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং আইওটির জনক হিসেবেই পরিচিত। পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হতে থাকেন বিশ্বের আরও অনেক এআই জায়ান্ট। বর্তমানে আইওটিকে অনেকে আইওই (ইন্টারনেট অব এভরিথিংস) বলে থাকেন। অনেকে আবার এটিকে বিল্ডিং এনার্জি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বলেও মনে করেন। এটি আসলে কিছু ওয়েব সাপোর্টেড ডিভাইস ও ক্লাউডের সমন্বয়ে গঠিত একটি এমবেডেড সেন্সর, প্রসেসর ও কমিউনিকেশন হার্ডওয়্যার ডিভাইসেস, যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় তথ্য এক ভিভাইস থেকে আরেক ডিভাইসে পাঠানো যায়। এই ব্যবস্থাপনাকে ‘কানেক্টেড’ বা ‘স্মার্ট ডিভাইস’ও বলা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টরা এখানে নিজের পছন্দ ও সুবিধামতো তাঁদের প্রয়োজনীয় ডেটা এন্ট্রি করতে ও সেটআপ করে নিতে পারেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণাটি একেবারেই নতুন। অনেকে মনে করেন স্বয়ংক্রিয় কিছু সুযোগ-সুবিধাসংবলিত (যেমন সিসিটিভি সমৃদ্ধ বা রিমোট কন্ট্রোল গেট ইত্যাদি) বিল্ডিংই স্মার্ট বিল্ডিং! কিন্তু না, বাস্তবে এটি আরও উন্নত বিষয়। এর সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জড়িত। দেশে এখানে এখনো কোনো সরকারি ইমারত নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে এই পদ্ধতি গৃহীত হয়নি। তবে বিদেশি অর্থায়ণ/ঋণে গৃহীত কতিপয় মেগা প্রকল্পের কাজে কিছু স্মার্ট অ্যাপসের মাধ্যমে তা ধারণাগতভাবে ব্যবহার হচ্ছে! আবার দেশের কিছু বড় রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীও তাঁদের কতিপয় প্রকল্পে এই পদ্ধতিতে কিছুটা কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বা নিজের মতো ব্যবসা করছেনও বলা যায়! যেমন বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং (BIM) প্রযুক্তির সফটওয়্যারের মাধ্যমে তাদের কিছু প্রকল্পের ডিজাইন ও ভবন নির্মাণ করে এবং সেখানে উন্নততর সিসিটিভির মাধ্যমে ভবনগুলোর পরিচালন ব্যবস্থাপনা করে। ডেভেলপাররা এসব ভবনকে ‘স্মার্ট বিল্ডিং’ বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উঁচু মূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন! অথচ সত্যিকারভাবে এসব কোনো একটি বিল্ডিংই স্মার্ট বিল্ডিং নয়! অনুরূপভাবে এখন বিভিন্ন সেক্টরের আরও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও তাঁদের সবকিছুকেই স্মার্ট দাবি করে নানা ঠকবাজি শুরু করে চলেছেন! স্মার্ট প্রোডাক্ট, স্মার্ট টাউন ইত্যাদি।
চীনা কোম্পানি সিআরবিসি ঢাকার দক্ষিণে (ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধারে) এবং উত্তরে (তুরাগ নদের ধারে) রাজউকের সঙ্গে যৌথ উদ্যেগে দুটি বৃহদাকার স্মার্ট সিটি গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে, যা এখনো সরকারের বিবেচনায় আছে! নগর বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই প্রস্তাবটি গোঁজামিলে ভরা!
তবে আশার সংবাদ হলো, বাংলাদেশ সরকার এবং অপরাপর কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। সরকার ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আইওটি/আইওই-এর উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কিছু ল্যাব/ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠা ও প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছে। কিন্তু এসব স্থাপনা পরিচালনার জন্য এখনো উপযুক্ত জনবল বা ম্যানেজমেন্ট তৈরি করা হয়নি, তাই এসব কিছু স্থাপনা নির্মাণের পর তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে! তবে জানামতে, দেশের কিছু সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ডেটাসফট এই বিষয়ে সরকারের সঙ্গে উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে বলে জানা যায়। এই যৌথ প্রচেষ্টায় সুইডেনের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘এরিকসন’ বাংলাদেশের জন্য আইওটি নামে একটি পোর্টাল চালু করেছে বলে প্রকাশ।

বাস্তবে স্মার্ট বিল্ডিং তৈরির মূল লক্ষ্যই হলো একটি ইমারত বা স্থাপনার সব ধরনের তথ্য যথাযথভাবে সংরক্ষিত ও সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা, অপারেটিং ও ম্যানেজমেন্ট খরচ কমানো, ব্যবহারকারীদের সুবিধা, আরাম ও পরিবেশ উন্নত করা, স্বয়ংক্রিয় শক্তি খরচ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এ জন্য অনেক দেশে এখন কৃত্রিম ইন্টেলিজেন্সের আওতায় ‘জিও লোকেশন’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্মার্ট বিল্ডিং বা কমপ্লেক্সের ম্যানেজমেন্টও শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে এসব ভবন/স্থাপনার প্রায় সবকিছুই সংশ্লিষ্টদের নজরদারিতে থাকে। ক্ষেত্রমতো এসব অনেক কার্যক্রম স্মার্ট মুঠোফোনের মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব! তবে অনেকে এই প্রক্রিয়ার (স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট) মাধ্যমে সরকার বা তদীয় লোকজনের একটি স্মার্ট বিল্ডিং বা কমপ্লেক্সে ‘আড়িপাতার’ অভিযোগের সম্ভাবনার কথাও বলছেন!!
স্মার্ট বিল্ডিং আসলে কী? একটি স্মার্ট বিল্ডিং শুরু থেকেই আধুনিক প্রযুক্তিতে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমীক্ষা করে ডিজাইন ও নির্মাণ এবং পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষ করে স্মার্ট সলিউশনস অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং প্রয়োগ করে বিল্ডিংয়ের আলো-বাতাস, অ্যালার্ম, ধোঁয়া, আগুন, নিরাপত্তাব্যবস্থা, এইচভিএসি, পার্কিং স্পেস, লিফট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি যাবতীয় কার্যক্রম সমন্বিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিটা স্মার্ট বিল্ডিংয়ে বৈদ্যুতিক আলোর চেয়ে ন্যাচারাল লাইট অর্থাৎ গ্রিনহাউস অ্যাফেক্টের সুবিধাসংবলিতভাবে নির্মাণ করা হয়। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই প্রতিটা বিল্ডিংয়ের সব পরিষেবা (বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ময়লা-আবর্জনা অপসারণ ইত্যাদি) চলে। এইচভিএসি সিস্টেম বিল্ডিংয়ে বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সিসকো সিস্টেমের স্মার্ট বিল্ডিংস নির্মাণ ও পরিচালনা ব্যবস্থাপনাকে উত্তম সমাধান বলা হয়ে থাকে।

এই পদ্ধতিতে নির্মিত কোনো বিল্ডিং থেকে যদি কেউ ভুল করে কোনো অফিস বা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তাতে এসি, ফ্যান, লাইট ইত্যাদি বন্ধ না করেন, তাহলে সেন্সরের মাধ্যমে বিশেষ করে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য অফিস বা বাসার বিদ্যুৎ-সংযোগ আপনাতেই বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি জিও লোকেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে তা দূর থেকে বন্ধ করে দেওয়াও সম্ভব! আবার এসব বিল্ডিং প্রাঙ্গণে কোনো মানুষের উপস্থিতি পেলে এসব সার্ভিস আপনাতে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালুও হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া স্মার্ট বিল্ডিংসয়ে আরও কিছু সহায়ক প্রযুক্তিও রয়েছে। যেমন একজন ব্যক্তি পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হলে অর্থাৎ তার পক্ষে চলাফেরা প্রায় অসম্ভব হলে সহায়ক টেকনোলজি ব্যবহার করে তিনি বা তাঁকে হুইলচেয়ারের মাধ্যমে অনায়াসেই চলাফেরা করা বা বাসা থেকে তাঁকে বের হতে বা আনতে পারাও সম্ভব!
শুধু তা-ই নয়, যথাযথ আইওটি ডিভাইস ব্যবহার করে একটি স্মার্ট হোমে বসবাসরতরা বাসায় সংযোজিত মেডিক্যাল ডিভাইস (সেন্সর) ব্যবহার করে ওয়াশিং মেশিন, ফ্যান, লাইট, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, প্লাম্বিং সিস্টেমস এমনকি ঘরের গেট/দরজা খোলা-বন্ধ করা ইত্যাদিও অন-অফ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এই পদ্ধতিতে একটি সংযুক্ত গাড়ি গ্যারেজে বায়োমেট্রিক অ্যাকসেসও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অনুরূপ স্মার্ট বাণিজি্যক ভবনে অত্যাধুনিক সেন্সরের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও সূ² ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমস গড়ে তোলা যেতে পারে, যার মাধ্যমে অফিস/শপিংমলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাজিরা, মালামালের স্টক, দর্শনার্থী বা ক্রেতার সংখ্যা ইত্যাদি সবকিছুসহ অফিস/শপিংমলের আলো, বাতাস, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি বিষয়েও সুস্পষ্ট এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্যগুলোর পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করা সম্ভবপর!

তবে এসব সুযোগ-সুবিধাসংবলিত স্মার্ট বিল্ডিংয়ে বিশেষ করে প্রযুক্তি-নির্ভর কার্যক্রমের জন্য যথেষ্ট মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন। কারণ, একটি বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা বিল্ডিং অটোমেশন সিস্টেম, যা বিল্ডিংটি নিয়ন্ত্রণ করে এমন বহুবিধ ডিভাইস এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো পরিচালনার জন্য একটি ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এ জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ইন্টারনেট-ব্যবস্থার প্রয়োজন। আবার মানুষজনের মধ্যে এই স্মার্ট প্রযুক্তি নিয়ে ভীতিও কাজ করছে! তবে এটা সত্য যে প্রতিটি স্মার্ট বিল্ডিংয়ের উল্লেখিত সলিউশন ও উপাদেয়গুলো সম্পূর্ণভাবে অবিরাম বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের ওপর নির্ভরশীল, যা কিন্তু এখনো আমাদের দেশে পুরোপুরি (অবিরাম ইন্টারনেট-ব্যবস্থা) নিশ্চিত হয়নি!
এই অবস্থায় বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার দেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি প্রতিশ্রুতি ও স্লোগান ঘোষণা করেছে। আগামী ২০৪১ সালকে টার্গেট করে এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠনসহ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার নিমিত্ত স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ করার একটি কর্মপরিকল্পনাও ঘোষণা করেছে। সে সঙ্গে প্রতিবছরের ১২ ডিসেম্বর তারিখকে স্মার্ট দিবস হিসেবে পালনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের উন্নয়নে দেশের ইন্টারনেট ও ডেটাবেইস পদ্ধতি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নকে অধিকতর উন্নয়ন, সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি শ্রমনির্ভর বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পে শ্রমিকেরা যাতে কোনোভাবে কর্মবিহীন না হয়ে পড়ে বা বঞ্চিত না হয়, তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬১ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২৪