ঢাকার ভবিষ্যৎ প্রস্তাবনা ও উন্নয়নে যত অসংগতি (পর্ব-২)

এসব কারণে ঢাকার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সাযুজ্য কম, কোনো পরিকল্পনাই ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয়নি। তার সঙ্গে রয়েছে দেশের ‘Top Down Approach’ উন্নয়ন-প্রক্রিয়া। পরিকল্পনায় যা থাকুক না কেন, উপরিওয়ালারা যা চায় তা-ই বাস্তবায়ন হয়। যেমন ১৯৫৯ সালের মহাপরিকল্পনায় ভবিষ্যৎ ঢাকার বিনির্মাণে প্রস্তাব ছিল নর্থ-সাউথ রোডটিকে বুড়িগঙ্গা নদীর ধার পর্যন্ত স¤প্রসারণ করে নদীর ওপারে জিঞ্জিরা এলাকায় বুড়িগঙ্গাকে সম্মুখে রেখে সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পার্লামেন্ট কমপ্লেক্স স্থাপনের। কিন্তু তদস্থলে ষাটের দশকের শুরুতে পাকিস্তানের সামরিক আইয়ুব খানের আগ্রহে তাঁর নামে তেজগাঁওয়ের পশ্চিমে Experimental Farms-এর জন্য সংরক্ষিত জায়গায় ঢাকার Second Capital (আইয়ুব নগর) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন করা হয় (যা বর্তমানে শেরেবাংলা নগর নামে পরিচিত)। অনুরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ নগরীর উত্তর দিকে স্থানান্তর করে সেখানে (ফয়েদাবাদ এলাকায়) একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেটিও হয়নি। অন্যদিকে মহাপরিকল্পনার আলোকে কুর্মিটোলার উত্তরে বিস্তীর্ণ জমিতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্যাটেলাইট সিটি (Satellite City) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিস্তারিত সমীক্ষা হলেও প্রস্তাবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে সেখানে দায়সারা গোছের North Satellite Town নামে একটি আবাসিক শহর পরিকল্পিত হয়, যা আজকের উত্তরা উপশহর। একইভাবে কোনো রকমে গড়ে ওঠে মিরপুর উপশহর, কিন্তু এর কোনোটিই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে পরিকল্পিত ও উন্নয়ন হয়নি। সেখানে নেই কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বা বাণিজ্য কেন্দ্র (CBD). ফলে দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ থেকে উত্তরে সাভার-গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ প্রায় দুই কোটি জন অধ্যুষিত আজকের ঢাকা মহানগরীর সবাই এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পিজি হাসপাতাল (BSMMU) এবং মতিঝিল কিংবা কাওরান বাজার বাণিজ্যিক এলাকার ওপর নির্ভরশীল।

ইউনাইটেড হাসপাতাল, বারিধারা

উদ্ভূত অবস্থায় লক্ষণীয় যে বিভিন্ন সময়ে নগরীর ভেতর-বাইরে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব আবাসন বা নিউ টাউন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, তার একটিও মূল পরিকল্পনা ও কাঠামো অনুযায়ী হয়নি। ষাটের দশকে পরিকল্পিত ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বনানী, গুলশান, বারিধারা থেকে শুরু করে বাস্তবায়নাধীন সব প্রকল্পেই এই বিচ্যুতি লক্ষণীয়। আগেকার এসব প্রকল্পগুলো গৃহীত হয়েছিল Low Density Project হিসেবে। সেখানে বরাদ্দকৃত প্লটে দুই-তিন তলার বেশি ইমারত নির্মাণ করতে অনুমতি দেওয়া হতো না এবং সেই বিবেচনায় প্রকল্পগুলোতে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পয়োনিষ্কাশন লাইন স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু নগরীতে জনস্ফীতিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সেখানে এখন ১০-১২-১৪ তলার ইমারত নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। একটি প্লটে যেখানে আগে একটি পরিবার থাকত, সেখানে ১০-১৫; অনেক ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিবার বসবাস করছে, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। তন্মধ্যে ধানমন্ডি ও বনানীতে অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়েছে। ফলে পরিকল্পনার ব্যত্যয় তথা বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হয়ে বর্তমানে এসব শহর-উপশহরগুলোতে বসবাসের চরিত্র হারিয়ে গেছে। এই অবস্থা এখন রাজধানীজুড়ে। সরকারের উদার নীতির (Liberal Policy) সুযোগ গ্রহণ করে দেশের রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের সিংহভাগ ঢাকা ও এর আশপাশে নির্মিত হয়েছে, যার কারণে রাজধানীর সর্বক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে বাড়তি চাপ।

স্বাধীনতার পর থেকে রাজধানী ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন ও স¤প্রসারণে এ পর্যন্ত অনেক বেসামরিক-সামরিক অধ্যাদেশ ও আইন জারি এবং বিভিন্ন ধরনের Action Plans, Strategic Reports ও মহাপরিকল্পনা প্রণীত হলেও তার একটিরও কাঙ্খিত বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নগরীর সমন্বিত পরিকল্পনা ও উন্নয়নে Dhaka Metropolitan Development Authority প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালে তাঁর হত্যার মাধ্যমে ওই উদ্যোগটির কবর রচিত হয়। এরপর দেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে ‘আবেগ’ ও ‘জেদাজেদি’র উন্নয়ন। যেমন জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর যেখানে ইন্দিরা মঞ্চ নির্মিত হয়, সেখানে নির্মিত হয় শিশু পার্ক। আর অবশিষ্ট অংশে আওয়ামী লীগ সরকার নির্মাণ করে বসে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’। এভাবে ঢাকার অভ্যন্তরে প্রধান উন্মুক্ত স্থানটি প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। যেভাবে পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি অব্যবস্থাপনায় তথা দখলবাজদের দৌরাত্ম্যে নগরীর ভেতর-বাইরে আরও অনেক খোলা জায়গা, খাল-নালা, পার্ক-খেলার মাঠ এমনকি সরকারিভাবে অধিগ্রহণকৃত ও উন্নয়ন জমি ও বন্যা প্রবাহিত এলাকা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যত এভাবেই একাকার হয়ে গেছে ঢাকার পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকা।

ডিঙ্গী রেস্টুরেন্ট, ধানমন্ডি লেক, ধানমন্ডি

আশির দশকে বন্যায় ঢাকাসহ প্রায় পুরো দেশ তলিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক সহায়তায় প্রণীত হয় Flood Action Plan (FAP). তন্মধ্যে ঢাকার জন্য প্রণীত FAP-৮-এর আওতায় নগরীর বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে অনেক সুপারিশ গৃহীত হয়। কিন্তু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে এই পরিকল্পনাটিরও তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। নগরীর পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্তাবিত Retention Point-এর একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি, বরং নদী চতুষ্টয়ের ধারে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও দেয়াল নির্মাণের মাধ্যমে বাঁধের ভেতরের জায়গায় ভ‚মিদস্যুদের আগ্রাসনে দখল ও ভরাট হয়ে ঢাকার সার্বিক পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে মরুময়তার। আগে ঢাকায় বৃষ্টি বা বন্যা হলে নদীপথে পানি চলে যেত, কিন্তু অনেক খাল ভরাট হয়ে যাওয়া বা করে ফেলা এবং প্রবাহমান খালগুলোর ওপর বক্স কালভার্ট ও সড়ক নির্মাণ করে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা ও যানজট সমস্যা নিরসনে প্রকটতা আরও বেড়েছে। উদ্ভূত অবস্থায় ১৯৯৫ সালে Dhaka Metropolitan Development Plan (DMDP; 1995-2015) শীর্ষক যে নতুন মহাপরিকল্পনাটি প্রণীত হয়, সেটিরও তেমন কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। Three-tier পদ্ধতির এই নতুন মহাপরিকল্পনায় Metro Dhaka Structure Plan এবং Urban Area Plan অন্তর্ভুক্ত ছিল। কথা ছিল একই সঙ্গে Detailed Area Plan (DAP) বা ড্যাপ প্রণয়নের, কিন্তু প্রণীত হয়নি। দীর্ঘদিন পর ২০১০ সালে ড্যাপ প্রণয়ন সম্পন্ন ও অনুমোদন হলেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে সেটিরও কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। বরং প্রশ্ন ওঠে নগর উন্নয়ন আইনের সংশোধন ব্যতিরেকে কীভাবে এই নতুন পদ্ধতির প্ল্যানগুলোর অনুমোদন হলো? এতদ্ভিন্ন রাজউকের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ানাধীন পূর্বাচল প্রকল্প এলাকায় Structure Plan-এ কীভাবে নতুন ক্যান্টনমেন্ট বা বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য প্রস্তাব করা হলো, তাও মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে আছে বৈকি! এভাবে ওই পরিকল্পনায় সাভারে ‘ধামসোনা নতুন শহর’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটিও আজ অবধি শুধু নকশায় শোভা পাচ্ছে। এই অবস্থায় ২০১৫ সালের শেষ দিকে প্রণীত CRDP প্রকল্পের আওতায় ঢাকার জন্য নতুন Dhaka Structure Plan-এর ওপর অক্টোবর ২০১৫ মাসে রাজউক ভবনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় পূর্তমন্ত্রী ও ঢাকার নবনির্বাচিত মেয়রদ্বয়সহ উপস্থিত সকলেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। নতুন Structure Plan-এর অনেক প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে নীতিনির্ধারকেরা মত দেন। কাজেই ঢাকার নতুন মহাপরিকল্পনা যে কী ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়!

নগরের অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ

অন্যদিকে নগরীর ভয়াবহ যানজট সমস্যা নিরসনে বিস্তারিত সমীক্ষার মাধ্যমে ২০০৮ সালে একটি সমন্বিত পরিবহন পরিকল্পনা (STP) অনুমোদিত হলে সেটিরও বাস্তবায়ন হচ্ছে অসমন্বিতভাবে। যে যার মতো করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। ফলে এসটিপিতে প্রস্তাবিত তিনটি MRT ও ৩টি BRT রুটের বাস্তবায়ন ও কার্যকর হওয়া নিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন পর্যায়ে আলেচনা-সমালোচনা চলছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো, এসটিপি প্রণয়নাধীন ও কার্যকর থাকা অবস্থায় ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক নিজস্ব পরিকল্পনায় যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান-পলাশী পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ, অনুরূপ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক আরেক পরিকল্পনায় তেজগাঁও-মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণসহ বিচ্ছিন্নভাবে নগরীর বিভিন্ন মোড় ও জংশনে স্ব-স্ব পরিকল্পনায় ফ্লাইওভার, ওভারপাশ ইত্যাদি নির্মাণ করা। অথচ এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কারোরই এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের এখতিয়ার নেই। এসটিপি-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই দুটি প্রকল্পের কারণে এসটিপি-তে প্রস্তাবিত MRT & BRT-এর আদৌ বাস্তবায়ন হয় কি না সন্দেহ এবং জোড়াতালি দিয়ে করা হলেও তা নগরীর পরিবহন সমস্যার কোনো উন্নতি হবে না। এই অবস্থায় DTCA-এর আওতায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রস্তাবিত MRT-৩ প্রকল্পের কাজে কোনো গতি নেই। অনুরূপ BBA-এর আওতায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে রেললাইনের পাশ দিয়ে নির্মাণাধীন এলিভেটেড রোডটির কাজেও আজ অবধি দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

একই অবস্থা বিরাজ করছে অন্যান্য সেবা ক্ষেত্রেও। ষাটের দশক থেকে ঢাকা ওয়াসার Water Supply & Sewerage-এর মহাপরিকল্পনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা পরিকল্পনা মোতাবেক বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৮৮ সালের বন্যা-উত্তর নগরীর অনেক খাল-নালা ভরাট করে সেখানে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও এখন বলা হচ্ছে তা ভুলে করা হয়েছে। অনুরূপ বিশাল জনসংখ্যার এই দেশটিতে ঘরে ঘরে বিশেষ করে নগর এলাকায় পাইপযোগে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করে এখন বলা হচ্ছে, এটিও ভুল হয়েছে। এ জন্য বর্তমানে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে, এরপরও পাশাপাশি বাড়িতে কেউ ব্যবহার করছে গ্যাসলাইনের সংযোগ, কেউ বা সিলিন্ডারে রান্না করছেন। আরও অবাক করার মত নিয়ম হলো বিদ্যুতের নতুন সংযোগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। নগর এলাকায়ও নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক প্রতিটা স্থাপনায় আবেদনকারীকে নিজস্ব অর্থায়নে Solar Power- প্যানেল থাকতে হবে, তারপর তা উপযুক্ত বিবেচিত হলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। এ ধরনের যতসব অদ্ভুত নিয়মকানুনের মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নগরায়ণ ও শিল্পায়ন চলছে। ঢাকার আকাশে তাকালে দেখা যায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত অবস্থায় পড়ে আছে, যা পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ থাকায় চালু করা যাচ্ছে না। এ ধরনের বিভিন্ন অসামঞ্জস্য পরিকল্পনা, উদ্ভট কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে ঢাকার জীবনব্যবস্থা দিনে দিনে জটিল হয়ে উঠছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এখন

তাই ইদানীং ঢাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বমহলে চলছে জোরালো আলোচনা। কথা হচ্ছে-কোম্পানি আমল থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনামলের মতো একটি স্বাধীন দেশের রাজধানীর উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ এমন হতে পারে কি না! স্বাধীনতার পর অনেক বিলম্বে হলেও দ্বিতীয় মহাপরিকল্পনা (DMDP 1995-2015) প্রণয়নের প্রেক্ষাপট ছিল একটি স্বাধীন দেশের রাজধানীকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজধানী ঢাকাকে প্রস্তুত করা। আর ২০১৫ সালে প্রণীত নতুন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের অন্যতম প্রেক্ষাপট ছিল MDG থেকে SDG-তে উত্তরণসহ বাংলাদেশকে বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত ও প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বিদেশি সাহায্য ও কারিগরি সহযোগিতায় প্রণীত দুটি মহাপরিকল্পনার মুখ্য প্রস্তাবনাসমূহ শুরুতেই বিতর্কের সৃষ্টি করে। ফলে DMDP মহাপরিকল্পনার যেমন কাঙ্খিত বাস্তবায়ন হয়নি, তেমনি সদ্য প্রণীত দ্বিতীয় মহাপরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পূর্বেকার মতো এখনো নগরীর অভ্যন্তরে বিশাল জায়গাজুড়ে ঢাকা-মিরপুর ও সাভার সেনানিবাস, পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ইত্যাদি যথাস্থানে রেখে দেওয়া নগর পরিকল্পনা ও নগরায়ণের দৃষ্টিতে কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়েও কথা হচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এসব Walled City-এর কারণে নগরীর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্তাবিত অনেক সড়ক ও অন্যান্য পরিবহন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। STP-তে প্রস্তাবিত উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রস্তাবিত MRT-৩ প্রকল্পের এলাইনমেন্টে মিরপুর ও ঢাকা সেনানিবাসের নিরাপত্তার প্রশ্নে কয়েক দফায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। তাছাড়া, একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তেজগাঁও পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটিকে রক্ষা করার নামে জাতীয় সংসদ ভবন প্লাজার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল নেওয়ার প্রস্তাবের কারণে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চয়তার দোলাচলে। উদ্ভূত অবস্থা থেকে উত্তরণে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে যেসব বিকল্প প্রস্তাব (প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, বিকল্প রাজধানী প্রতিষ্ঠা) দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর গ্রহণ ও বাস্তবায়নেরই কোনো সম্ভাবনা আছে কি? ঢাকার নতুন মহাপরিকল্পনাটি কি একইভাবে শুধু দেয়ালেই শোভা পাবে? ঢাকায় কি আর নগর সরকার প্রতিষ্ঠা বা সমন্বিত উন্নয়নব্যবস্থা চালু করা যাবে না? এমতাবস্থায় ঢাকার ভবিষ্যৎ-বা কী?

মো. এমদাদুল ইসলাম, নগর ও উন্নয়ন বিশ্লেষক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৩ তম সংখ্যা, মে ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top