মধ্যযুগের পশ্চিমা রীতি
প্রার্থনা করতে আসা লোকের সংখ্যা বাড়ায় ‘বারান্দা চার্চের’ সংখ্যা বাড়তে লাগল। কমতে লাগল কেন্দ্রীয়ভাবে বানানো চার্চের সংখ্যাও। আবাসিক সুবিধাসম্পন্ন চার্চের গঠনও হতে লাগল পরিবর্তিত। ‘দুই রুমের চার্চ’টাই ইউরোপীয় রীতি হয়ে গেল। প্রথম রুমটা হলো চার্চের মূল অংশ, যেটা কি না পাদ্রীসভা কর্তৃক ব্যবহৃত হতো। আর দ্বিতীয় রুমটি ‘দ্য স্যাংচুয়ারি’ যেখানে জনসমাগম হলে প্রার্থনা মন্ত্র পাঠ করা হতো। এই ব্যবস্থার সুবিধা হলো, পাদ্রীরা কিছুটা দূর থেকে আইলের ফাঁক দিয়ে জনসমাগমকে দেখতে পেত, (পরবর্তী সময়ে অবশ্য রুড স্ক্রিন নামের এক প্রকার কাঠের পর্দা ব্যবহার করা হয়েছিল)। তখন আগত দর্শনার্থীরা অর্থাৎ জনগণই ছিল সমাবেশে মুখ্য বিষয়, পাদ্রীসভার অংশগ্রহণ এখানে মূল আলোচ্য ছিল না।
স্তুতিমন্ত্র অবশ্য ল্যাটিন ভাষায় পড়া হতো, যদিও প্রার্থনাকারীরা তাঁদের নিজেদের ভাষায় দেবতাদের কাছে শ্রদ্ধা অর্পণ করে তৃপ্তি বোধ করতেন। দেখার সুবিধার্থে কিছু চার্চের স্কুইন্ট নামের কিছু ফুটো ছিল, হিসাব করেই দেয়াল এবং পর্দার মধ্য দিয়ে কাটা হতো, যেখান দিয়ে চার্চের মধ্যভাগ থেকেও সবকিছু দেখা যেত। আরেকটা কথা, একটা দ্বৈতরীতি ছিল যে প্রত্যেক যাজকই তাঁর অনুসারীদের জন্য একবার করে প্রার্থনা করবেন কিন্তু একটা বেদি একবারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না (প্রতিদিন)। তাই একাধিক বেদি রাখারও ব্যবস্থা করতে হলো, যেটা পরে বিশেষ করে মোনাস্টিক চার্চের একটা রীতি হয়ে দাঁড়াল। স্তুতিমন্ত্রের পরিবর্তন ছাড়াও নিত্যনতুন প্রযুক্তি এবং নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার চার্চ নির্মাণ স্থাপত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে প্রকাশিত হল। উত্তর ইউরোপে প্রায়শই কাঠের তৈরি চার্চ দেখা যেত (প্রথম দিকে) কিন্তু কাঠ দিয়ে বানানোর কারণেই সেই সব চার্চ আর টেকেনি। বেনেডিক্টাইন মংকসমূহে বড় স্থাপনা দাঁড় করিয়ে রাখতে ব্যাপকভাবে পাথরের প্রভাব লক্ষ করা যায় ১০ ও ১১ শতকে।
দুই কক্ষের চার্চে, বিশেষ করে মঠ টাইপের চার্চে; কখনো ট্রান্সেপ্ট থাকত, যেটা ক্রুশাকৃতিতে তৈরি। এখন অবশ্য গ্রাউন্ড প্ল্যানের সঙ্গেই থাকে। এর ফলে ভবনগুলো দেখেই বোঝা যেত এগুলো আসলে চার্চ। কখনো কখনো ক্রুশটা টাওয়ার দিয়ে ঘেরা থাকত, যেটা চার্চের মূল ফোকাস; যার নাম ছিল কলাপস অ্যাট এলি। আবাসিক মঠগুলোতে এখন প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য সাধুদের বা ধর্মীয় রীতি অনুসারে জায়গার অনুমোদন দেওয়া আছে, তার ফলে মঠগুলো লম্বাটে হয়ে চ্যান্সেল হয়ে গেছে, যেটা এখন পর্দা দিয়ে চার্চের মূল অংশ থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। চার্চের সিম্বল এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ, উভয়েরই সমন্বয় ঘটে নির্মাণকাজে।

চার্চ আর্কিটেকচারে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানসমূহ
ইউরোপের সর্বত্রই বিভিন্ন এলাকায় নির্মিতব্য চার্চের স্থাপত্যিক গঠনে এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা দেখা যায়। আবার এমনও হয়, একই এলাকায় একই সময়কালে নির্মিত একটা চার্চ আরেকটা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যেসব ফ্যাক্টর চার্চের ডিজাইনে ভূমিকা রাখতে পারে, সেগুলো হলো-এলাকার অবস্থা, শহরের অবস্থান, গ্রাম নাকি মফস্বল শহর, অ্যাবে চার্চ নাকি কলেজিয়েট চার্চ, চার্চটি বিশপের অধীনে থাকবে নাকি কোনো স্থানীয় ধনাঢ্য পরিবারের অধীনে থাকবে, চার্চে কি মূর্তি থাকবে নাকি ছবি থাকবে ইত্যাদি। বিশেষ করে, অ্যাবে চার্চ আর কলেজিয়েট চার্চ, যা কি না খুবই ক্ষুদ্র এক ধর্মীয় উপগোষ্ঠীকে (মাজহাব) সার্ভ করে, সাধারণত অন্যান্য যাজকপল্লী চার্চ থেকে অত্যধিক মাত্রায় ভিন্নতা প্রদর্শন করে, এমনকি একই এলাকায় একই সময়ে নির্মিত হলেও। বিশপের অধীনে থাকা চার্চটি সাধারণত চার্চ আর্কিটেকচারের ওপর পারদর্শী স্থপতি দ্বারাই ডিজাইনকৃত ও নির্মিত, অন্য সাধারণ যাজকদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত চার্চের মতো নয়।
অনেক যাজকপল্লীসমৃদ্ধ চার্চ সাধারণত স্থানীয় ধনী পরিবারের অধীনে নির্মিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। এই ফ্যাক্টরটাই চার্চের গঠন এবং ডিজাইনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এটাই স্বাভাবিক যে স্থানীয় অভিভাবকের আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর চার্চের ডিজাইনে প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে চার্চের অধিকার যে কারও অধীনে আছে সেটা বোঝা যাবে চার্চে আয়তনে, কবরে, মেমোরিলাল বা স্মৃতিস্তম্ভে, ফিটিংসে, কাচের ডিজাইন প্যাটার্ন এবং আরও অন্য সব সাজসজ্জায়। যেসব চার্চে উল্লেখযোগ্য দামি মূর্তি, বিগ্রহ কিংবা ধর্মীয়ভাবে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আছে, যেগুলো একপর্যায়ে তীর্থস্থানের জায়গায় পরিবর্তিত হয়েছে এবং শেষ পর্যায়ে ব্যাসিলিকার মর্যাদা পেয়েছে। আবার, অনেক চার্চে বিভিন্ন ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বা বিখ্যাত সাধুর দেহাবশেষ (বা তার অংশ) রক্ষিত থাকার পরেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তীর্থস্থানের মতো গুরুত্ব বহন করে না, যা থেকে চার্চ পরিচালনার খরচ আসতেও পারে আবার নাও পারে।

সাধু ব্যক্তির জনপ্রিয়তা, নিদর্শনটির ধর্মীয় মূল্য, চার্চের আকার এবং গুরুত্ব, যে ব্যক্তির স্মৃতিতে চার্চটি নির্মাণ করা হয়েছে তার ধর্মীয় গুরুত্ব, এগুলো সবই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে চার্চের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে আবার নাও পারে। দুজন আপাত দৃষ্টিতে অপরিচিত সাধু, স্যান গিওভানি এবং সান পাওলোভেনিসে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ চার্চের নামকরণের মাধ্যমে সম্মানিত হয়ে আছেন, যা Dominican Friars কর্তৃক নির্মাণ করা হয়েছিল সমসাময়িক আরেকটি চার্চ ফ্রারি চার্চের সঙ্গে পাল্লা দিতে। ১৯ শতকের শেষদিকে ভেনিসে রেলস্টেশন নির্মাণের জন্য একটি চার্চ ভেঙে ফেলা হয়, আকৃতিতে অনেক ছোট ছিল চার্চটি, এখানে সেন্ট লুসির দেহাবশেষ সংরক্ষিত ছিল, যে ছিল একজন শহীদ। এ রকম অনেক চার্চই আছে, যেগুলো সারা পৃথিবীর ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট কর্তৃক সম্মানিত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নরওয়েতে চার্চ স্থাপত্যে আধুনিক নির্মাণসামগ্রীর যেমন: কংক্রিট বা ধাতব পাতের ব্যবহার শুরু হয়। বদো ক্যাথেড্রাল বানানো হয়েছিল কংক্রিট ব্যবহার করে বিশাল ব্যাসিলিকা বানানোর কথা মাথায় রেখে। ১৯৬০-এ মোটামুটি ঘোষণা দিয়েই ট্র্যাডিশনাল আর্কটিক ক্যাথেড্রল বানানো বন্ধ হয়, সেগুলো বানানো হতো হালকা কংক্রিট আর অ্যালুমিনিয়াম পাতে।
কাঠের চার্চ
নরওয়েতে একটা সময় কাঠের তৈরি চার্চ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, হয়তো-বা কাঠের সহজলভ্যতার কারণেই। এগুলো সাধারণত জনবিরল বা অতটা ঘনবসতিপূর্ণ না এমন জায়গায়ই নির্মিত হতো। শুধু মধ্যযুগীয় আমলে নির্মিত চার্চগুলো বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত নির্মিত চার্চের অধিকাংশই (প্রায় ৯০%) ছিল কাঠনির্মিত। মধ্যযুগে নরওয়েতে প্রায় হাজার খানেক কাঠের তৈরি চার্চের বেশির ভাগই ছিল ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করানো টেকনিকে বানানো। আর বাকি ২৭১টি চার্চ ছিল রাজমিস্ত্রি দিয়ে পাকা করে বানানো। প্রোটেস্ট্যান্টদের পুনর্গঠনের পরে নতুন চার্চের নির্মাণ এবং পুরোনো চার্চের নতুন নির্মাণ শুরু হয়। কাঠই ছিল মূল নির্মাণ উপকরন কিন্তু গাছের গুঁড়িও প্রাধান্য পেতে লাগল। গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো চার্চগুলো ছিল ঠেকনা দিয়ে লম্বাভাবে দাঁড় করানো চার্চের চেয়ে কম শক্তপোক্ত। গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো চার্চগুলো ছিল গাঠনিকভাবেই লম্বা দেয়াল নির্মাণের জন্য অনুপযোগী, বিশেষ করে যদি কাঠ কেটে জানালা বানানো লাগত তবে ট্রান্সেপ্ট জুড়ে দেওয়ার পরে কাঠের গুঁড়ির স্থায়িত্ব খানিকটা বাড়ল, যেটা ছিল ১৬০০ এবং ১৭০০ সালে বহুল ব্যবহৃত টেকনিক। ১৭৫৯ সালে একটি হারিকেনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে ওল্ড ওল্ডেন চার্চের পুরোটাই একটা বিল্ডিং বানিয়ে ফেলা হয়। পরে চার্চটাকে এমনভাবে ক্রুশাকৃতি দিয়ে বানানো হলো, যাতে এটা সর্বোচ্চ বাতাসেও টিকতে পারে। গাছের গুঁড়ির দৈর্ঘ্যই চার্চের দেয়ালের দৈর্ঘ্য হয়। উদাহরণস্বরূপ শ্যামনগর চার্চে কাঠের গুঁড়ি জোড়া লাগানোর অসুবিধা দূর করতে কোনাগুলো কেটে ফেলা হতো। ফলস্বরূপ চার্চটি আয়তাকার না হয়ে অষ্টভুজাকৃতির হতো।
ক্রুশাকৃতি দেওয়ার ফলে চার্চগুলো আরও বেশি দৃঢ় হতো কিন্তু ট্রান্সেপ্টের কোনায় আসনবিন্যাসের কারণে মূল বেদি এবং তাতে আসনগ্রহণকারী যাজকদের আর দেখতে পাওয়া যেত না, দেখার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করত। অষ্টভুজাকৃতির ফ্লোর লেভেল হওয়ার কারণে বেদি দেখতেও সুবিধা হতো আবার শক্তপোক্ত স্ট্রাকচারও হতো, মোটকথা চার্চের মধ্যভাগ তুলনামূলকভাবে বেশ বড় হতো। ঐভ্রশড়হ ঈযৎরংঃরব-এর বিশ্বাস অনুসারে, এটাই ছিল ১৭০০ সালের দিকে অষ্টভুজাকৃতির চার্চের জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ। ঠৎবরস বিশ্বাস করতেন যে গাছের গুঁড়ি দিয়ে চার্চ বানানোর কৌশল আবিষ্কৃত হওয়ার পরপরই নরওয়েতে চার্চের ডিজাইনে একপ্রকার নতুন সমাহার আসতে শুরু করে। ইউক্রেনে কাঠ নির্মিত চার্চের নির্মাণ আসে মূলত ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকেই এবং সেটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যখন কিনা পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত চার্চই শহরে ছিল দারুন জনপ্রিয়।

ইথিওপিয়ান চার্চ আর্কিটেকচার
যদিও এর মূল ছিল পূর্বীয় খ্রিষ্ট মতবাদ, বিশেষ করে সিরিয়ান চার্চগুলোতে, তারপরেও পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ধাঁচের ছোঁয়া লাগায়; ইথিওপিয়ার মূলধারার চার্চগুলো কিন্তু তাদের নিজস্ব রীতি বজায় রেখেছিল। ওখানকার সবচেয়ে প্রাচীন চার্চে ব্যাসিলিকার মতো গঠন দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ ডেব্রে ডেমোকে সজ্জিত করা হয়েছিল পুনর্ব্যবহৃত চারটি মনোলিথিক কলাম দিয়ে চার্চের মধ্যভাগকে আলাদা করে। এটার পশ্চিম দিক ছিল নিচু ছাদের নার্থেক্স দেওয়া। কিন্তু পূর্বপাশে এটার ছিল মাকদাস বা হলি অব হলিস, যা ভবনটিকে একমাত্র আর্কটি দিয়ে আলাদা করেছিল।
পরবর্তীতে, অর্থাৎ খ্রিষ্ট-পরবর্তী সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম দিকে শুরু হয়ে ১৬০০ শতক পর্যন্ত ছিল প্রচলিত মাধ্যম এবং পাথের কুঁদে বানানো উভয় মাধ্যমের ব্যবহার। যদিও এখন পর্যন্ত টিকে থাকা উদাহরণের নিদর্শন কেবল গুহাতেই পাওয়া যায়, থমাস পাকেনহ্যাম ওয়ালোতে একটা চার্চ খুঁজে পান, যার বৃত্তাকার দেয়ালের ভেতর দিকে পরবর্তী আমলের প্রযুক্তি দ্বারা বাঁধাই করা হয়েছে। আবার এ রকম বিল্টআপ বা জোড়াতালি দেওয়া চার্চের আরেকটা উদাহরণ হলো Yemrehana Krestos, যার সঙ্গে Debre Damo-এর প্ল্যান এবং নির্মাণকৌশলের অনেক মিল রয়েছে।
আর এই সময়কালের আরেকটা স্টাইল হলো, হতে পারে এটাই ইথিওপিয়ার আর্কিটেকচার ঐতিহ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় দিক; আর সেটা হলো মনোলিথিক বা পাথরের চার্চ। এগুলোর মধ্যে পড়ে পাহাড়ের পাশ কেটে প্রার্থনার জন্য বানানো ঘরবাড়িও। Abreha we Atsbeha, যেটার মধ্যভাগ আনুমানিক বর্গাকার এবং ট্রান্সেপ্ট দিয়ে ক্রুশাকৃতি বানানো হয়েছে, এটাই এক্সপার্টদের প্রলুব্ধ করেছে এই চার্চটাকে ক্রস-ইন-স্কয়ার চার্চের ক্যাটাগরিতে ফেলতে। তারপর আসে চার্চেস অব লালিবেলার কথা, যেগুলো তৈরিই করা হয়েছিল তুলনামূলকভাবে নরম লাল চুনাপাথরের পাহাড়ে কমবেশি খোদাই করে। কিছু কিছু চার্চ তো যেমন, Bete Ammanuel আর ক্রস শেপ Bete Giyorgis দাঁড়িয়ে ছিল চারপাশ থেকে আগ্নেয় চুনাপাথর সরিয়ে ফেলার পরেও, যেখানে কিনা Bete Gabriel-Rufael আর Bete Abba Libanos-এর মতো অন্যান্য চার্চ ছিল কেবল একপাশ বা দুপাশ থেকে পাথর সরানো। আর মজার ব্যাপার হলো এ রকম সব চার্চেই ঢুকতে হয় একপ্রকার গোলকধাঁধার মতো পাথুরে সুড়ঙ্গপথ পেরিয়ে।
ইথিওপিয়ান চার্চ আর্কিটেকচারের শেষ সময়কালে (যেটা এখনো পর্যন্ত চলছে) এর বিশেষত্বই হলো কৌণিক ছাদবিশিষ্ট গোলাকার চার্চ। দেখে মনে হবে ইথিওপিয়ান সাধারণ বসতবাড়িই, যেগুলোতে পাহাড়ি লোকের বাস। সবকিছুতে মিল থাকা সত্ত্বেও ইন্টেরিওর এবং কক্ষের লে-আউট কিন্তু একদমই আলাদা। কক্ষের বিন্যাসকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে: ১. মাসডাক: যেখানে কিনা পবিত্র ধর্মবাণী লিপিবদ্ধ ট্যাবলেটই কেবল থাকে আর সেখানে শুধু দায়িত্ব প্রাপ্ত পুরোহিতরাই প্রবেশ করতে পারে, সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ২. কিদিষ্ট নামের একটি ভ্রাম্যমাণ টেবিল, যেটা লোকজনের মাঝে চলাচল করে থাকে আর ৩. qene mehle নামক আরেকটা ভ্রাম্যমাণ টেবিল, যেটা বাইরে থাকে, বিশেষ নৃত্যশিল্পী বা dabtaras কর্তৃক ব্যবহৃত হয় তবে বাকি সবাইও ব্যবহার করতে পারে।

খ্রিষ্টধর্মের সংস্কার এবং চার্চ গঠনে এর প্রভাব
১৬০০ শতকের শুরুর দিকেই মার্টিন লুথার আর খ্রিষ্টধর্মের সংস্কারায়ণ এই দুইয়ে মিলিত প্রচেষ্ঠায় চার্চ আর্কিটেকচারের ত্বরিত পরিবর্তন আসতে থাকে। প্রোটেস্ট্যান্টদের সংস্কাররীতি অনুযায়ী, ধর্মীয় বক্তৃতাকে চার্চের অন্যতম বৈশিষ্ট্য করা হয়। এর ফলে যাজকেরাই চার্চের ভেতরের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয় আর তাই চার্চের ভেতরের ডিজাইন এমনভাবে করা হলো, যাতে বক্তব্য দেওয়ার সময় সবাই সুস্পষ্টভাবে চার্চের প্রতিনিধিকে দেখতে ও শুনতে পায়। আর পশ্চিমা চার্চের মূল ফিচারের মধ্যে যাজকেরা তো ছিল সব সময়ই। প্রোটেস্ট্যান্টিজমের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই খ্রিষ্টধর্ম চর্চার রীতিনীতি আর চার্চের ডিজাইনেও এল ব্যাপক পরিবর্তন।
সংস্কারায়ণের সময়ে, রিচুয়ালে প্রত্যেকের সাবলীল এবং পূর্ণ অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলোর ফোকাস হলো, যাতে সহজ-সরল ভাষায় মানুষের কাছে ধর্মীয় বাণী পৌঁছানো যায়, আগের দিনের মতো কেবল ভাবগম্ভীরসর্বস্ব যাজকদের বাণী নয়। হলি কমিউনের টেবিলটি কাঠে বানানো, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে যিশুখ্রিষ্টের আত্মোৎসর্গ ছিল সবার মুক্তিরই নিমিত্তে আর ধর্মসভার সঙ্গে সবার যোগাযোগ আরও সাবলীল করা হলো, যাতে সবাই খ্রিষ্টধর্মের সাধনার মাধ্যমে সহজেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পেতে পারে।
নেদারল্যান্ডের প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলোকে চতুর্ভুজাকৃতির শেপ দেওয়া হয়েছিল, যাতে পূর্ববিধানবাদের ধর্মোপদেশের ওপর প্রাধান্য থাকে। এ রকম চার্চগুলোর মধ্য ছিল: Willemstad, North Brabant এবং ১৬০৭ সালে নির্মিত ডোমযুক্ত চার্চ কড়বঢ়বষশবৎশ। ১৭০০ ও ১৮০০ শতাব্দীতে ব্রিটেনে অ্যাংলিকান চার্চগুলোতে রয়্যাল আর্মস বাইরের পরিবর্তে ভেতরে বসানোর নীতি চালু হয়ে গেল। ‘কেবল সম্রাটই সকল চার্চের অভিভাবক’- এই ধারণাটা মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো এমনটি করা হয়েছিল।

আধুনিক যুগ
ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনাও যে একটা করপোরেট অ্যাকটিভিটি এবং মন্ত্রপাঠের সময়ে যাজকদের আগত দর্শনার্থীদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকা যাবে না, এটা আধুনিক সময়ে এসে অনুভূত হয়। আধুনিক সময়ে চার্চ আর্কিটেকচারে শৈল্পিকতার ছোঁয়া বলতে কেবল একটা মাত্র বড় হলরুম থাকাই বোঝায়। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসে ফ্রান্স ও জার্মানিতে। প্যারিসের নিকটবর্তী খব জধরহপু নামক চার্চ, যা কিনা ডিজাইন করা হয়েছিল সুবিখ্যাত ফেঞ্চ আর্কিটেক্ট Auguste Perret দ্বারা, সেটাকেই পরিবর্তনের প্রথম মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেবল এর প্ল্যানের জন্যই না, এটা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিল এর নির্মাণসামগ্রীর জন্য, যা কিনা ছিল শক্ত কংক্রিটের তৈরি। আর জার্মানির Schloss Rothenfels-am-Main ও আলোচনায় আসে যখন একে ১৯২৮ সালে পুনঃসংস্কার করা হয়। এর আর্কিটেক্ট Rudolf Schwartz পরে কেবল ইউরোপেই না বরং আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে এ রকম চার্চের অনুরূপ চার্চের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। পাথরের মেঝের ওপর স্থাপিত Schloss Rothenfels ছিল আয়তাকার, সাদা দেয়ালে গভীর জানালাসমৃদ্ধ। এতে কোনো সাজসজ্জাই ছিল না। একমাত্র আসবাবপত্র বলতে কেবল ছিল হাজার খানেক চারকোনা আলগা টুল, যেগুলো চাইলেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া যেত। প্রার্থনার জন্য অবশ্য একটা বেদি বসানো হয়েছিল, যেটার তিন পাশে পাদ্রীরা দাঁড়াতে পারত।
আচেন শহরে কর্পাস ক্রিশ্চি ছিল Schwartz-এর প্রথম আবাসিক চার্চ, যা সেই সব পুরোনো নিয়মই মেনে চলে আর বাহাউসের শিল্প বিপ্লবের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এর বাইরের দিকটা ছিল চতুষ্কার। ইন্টেরিয়র করা হয়েছিল সাদা দেয়ালে স্বচ্ছ কাচ দিয়ে। একটা ল্যাংবাউ ছিল, যেটা ছিল আসলে বেদির বর্ধিত রূপ। একে ক্রিস্টোসেন্টিক না বলে বরং থিওসেন্ট্রিক বলাই ভালো। বেদির সামনে ছিল সাধারণ বেঞ্চ। বেদির পেছনেই ছিল সাদা দেয়াল, যেটা আসলে ‘হলি ফাদার’-এর ধারণাকে সিম্বোলাইজ করত। এই চার্চটির প্রভাব পরে সুইজারল্যান্ডেও পড়ে, যার উদাহরণ হলো Fritz Metzger এবং Dominikus Böhm.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, গবঃুমবৎ তার চার্চ আর্কিটেকচার-সংক্রান্ত ধারণাকে আরও বিকশিত করার চেষ্টা করেন, যার ছায়া আমরা দেখতে পাই ব্যাসেল রিচেনের সেন্ট ফ্রানকাস চার্চে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিল্ডিং হলো ১৯৫৪ সালে স্থপতি করবুশ্যিয়ার নির্মিত রনচ্যাম্পের নটর ডেম দ্য হট চার্চ। একই ধাঁচের অতি সরল ডিজাইন আর একই রকম স্টাইলের চার্চ দেখতে পাওয়া যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৭১ সালে শিকাগোর কাছাকাছি লিসলেতে নির্মিত রোমান ক্যাথলিক অ্যাবে চার্চ অব সেন্ট প্রকোপিয়াসে।
১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় ভাটিক্যান কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত একটি ধর্মীয় ধারণা Sacrosanctum কাউন্সিলের একটি ঘোষণায় পরিবর্তন আনে। এই নিয়মে চার্চের পবিত্র পাদ্রী এবং ধর্ম রক্ষায় নিয়োজিত অন্যান্য অফিশিয়াল বর্গের সঙ্গে সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক ও সাবলীল যোগাযোগ নিশ্চিত করতে পারে এ রকম ডিজাইনে চার্চ তৈরি করতে বলা হয়। আরও বলা হয় যে ধর্মবিধি এবং নির্দেশনা অনুসারে বেদির অবস্থান এমনভাবে করতে হবে, যাতে বেদিতে বসা অবস্থায় পুরোহিত সবার চেহারা দেখতে পারে। এই নীতির প্রভাব দেখা যায় লিভারপুলের রোমান ক্যাথলিক মেট্রোপলিটন ক্যাথেড্রলে এবং ব্রাসিলিয়তেও। দুটো চার্চই ছিল কিছুটা গোলাকার শেপের যাতে ছিল উন্মুক্ত বেদি।
বিভিন্ন নীতির প্রয়োগের ফলে আরও কিছু পরিবর্তনও আসতে থাকল। যাজকপল্লী সমৃদ্ধ চার্চসমূহও অতি অবশ্যই আরও সুন্দর ও গোছানোভাবে বানানো শুরু হতে লাগল। অর্থনৈতিক কারণে এবং অন্যান্য করপোরেট চাহিদা পূরণের স্বার্থে ‘সেক্যুলার ধর্মীয় মতবাদ’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মীয় আচরণ’ শুরু হতে লাগল। সোজাভাবে বললে, এমনভাবে চার্চের বিল্ডিং বানানো হতে লাগল, প্রার্থনার সময়টুকু বাদে অন্য সময় জায়গাটা যাতে অন্য কাজে লাগানো যায়। আবার ধর্ম প্রচারের মাধ্যম বিভিন্ন রকম ভিন্ন ধারণার দ্বারাও প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে লাগল। তিনটা আলাদা কাজের জন্য তিন রকম আলাদা জায়গা বানানো হলো। একটা হলো ব্যাপ্টিজমের জন্য, অপরটি ধর্মীয় পবিত্র মন্ত্রাদি পাঠ করার জন্য আর আরেকটা হলো বেদির চারপাশে উপবিষ্ট যাজকদের নৈশভোজের জন্য-এই তিন রকমের কাজই রিচার্ড জাইলস কর্তৃক ইংল্যান্ডে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্টে প্রচলিত হলো। যাজকসভাকে শুধু প্রয়োজনের সময় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলাফেরা করতে হতো। তবে এই বুদ্ধিটা ছোট যাজকসভার জায়গায় একটু বড় হলেই আর ফলপ্রদ হতো না। এমন ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযোগী ছিল, সেটা হলো বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটার আর আর্চের মধ্যবর্তী বসার জায়গা যেমনটা করা হয়েছিল শিকাগোর উইলো ক্রিক কমিউনিটি চার্চে, আগের প্ল্যানে ছিল যেটা।

উত্তরাধুনিক যুগ
অন্যান্য উত্তরাধুনিক নিদর্শনের মতো, চার্চের আর্কিটেকচারেও আধুনিক যুগের আদর্শ অনুকরণে কোমলতা, শত্রুতা এবং ইউটোপিয়ানিজম বা কল্পনাদৃষ্টির প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। চার্চ আর্কিটেকচার ডিজাইনে (যদিও খুব কমই আছে তবুও) বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আছে, যেখানে চার্চ নির্মাণে আবারও সেই পুরাণ এবং প্রাচীন স্টাইলেই আবার ফিরে যাওয়া হচ্ছে। এসব নিয়ে কাজ করছেন যেসব আর্কিটেক্ট, তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম সবার আগে আসে তাঁরা হলেন ডক্টর স্টিভেন স্ক্লোয়ডার, ডানকান স্ট্রইক, থমাস গর্ডন স্মিথ, রিচার্ড মেয়ের, ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট প্রমুখ।
কার্যকরী গ্রহণযোগ্য আধুনিক স্টাইলকে ‘ক্ষমার অযোগ্যভাবে’ বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হলো। পুরোনো স্টাইলটা ভেঙে পড়ল, দরকারমতো ফর্ম দেওয়া হলো এবং পরিচিত স্টাইলগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবর্তনের জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। হয়তো-বা অতি অবশ্যই, আর্কিটেক্টরা নতুন করে দেখা শুরু করল সেই সুপ্রাচীন স্থাপত্যরীতিকে, যা কিনা হাজার বছর সময় নিয়েছিল বিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হতে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে চার্চ আর্কিটেকচারে দেখা যাবে অন্য কোনো ডাইমেনশন। তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে আমাদেরকে।
– স্থপতি রাজীব চৌধুরী
তথ্য ও গবেষণা সহকারী: কাজী মৈত্রী
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭০ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬