বিম-কলামের সামগ্রিক বিন্যাসকেই ভবনের ফ্রেম-ব্যবস্থা বলা হয়। বহুতল ভবন ডিজাইনে সঠিক ও সাশ্রয়ী ফ্রেম-ব্যবস্থা বাছাই একটি অত্যাবশ্যক কাজ। প্রকৌশলবিদ্যায় বহুতল ভবনের কাঠামোগত বিন্যাসের ধরণ নির্ভর করে গাঠনিক উপাদান (Structural Element)-এর বাছাই ও বিন্যাসের ওপর, যাতে সেগুলো অধিকতর কার্যকর উপায়ে ভবনের ওপর-নিম্নমুখী আরোপিত Dead ও Live লোডের পাশাপাশি আনুভূমিকভাবে আগত ভূমিকম্প ও বাতাসের প্রভাবকে প্রতিহত করতে পারে। বাস্তবিক পক্ষে, ভবনের কাঠামো বা ফ্রেম-সিস্টেম নির্ধারণে গাঠনিক দিক ছাড়াও অন্যান্য দিক প্রাধান্য পায়। ভবনের অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা, নির্মাণপ্রক্রিয়া ও উপাদান (কংক্রিট ও স্টিল), বাহ্যিক আর্কিটেকচারাল পরিকল্পনা, আনুভূমিকভাবে ক্রিয়ারত বলের মান ও প্রকৃতি, ভবনের উচ্চতা ও অনুপাত, ভবনের বিভিন্ন সার্ভিসের গমনপথ ইত্যাদি বিষয় ভবনের ফ্রেম-সিস্টেম বাছাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানে রইল ভবন নির্মাণের বহুল প্রচলিত কয়েকটি ফ্রেম-ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধা।
১. ব্রেইসড ফ্রেম কাঠামো
ব্রেইসড কাঠামোতে ভূমিকম্প বা বাতাসের বলকে প্রতিহত করতে বিম-কলামের সংযোগস্থল থেকে তির্যকভাবে কর্ণ বরাবর ব্রেইসিং দেওয়া হয়। বহুতল ভবনের উচ্চমাত্রার আনুভূমিক ভূমিকম্প বা বাতাসের প্রভাবকে রোধ করতে এ ধরনের ফ্রেম-ব্যবস্থা দারুণ উপযোগী।

সুবিধা
ব্রেইসিংয়ের সবচেয়ে বড় কার্যকারিতা হলো ভবনকে পার্শ্বীয়ভাবে যথেষ্ট দৃঢ় করে।
বিম বা গার্ডার আনুভূমিকভাবে আগত ভূমিকম্প বা বাতাসজনিত বলকে প্রতিহত করে না বা খুব অল্প পরিমাণে করে থাকে, শুধু নিম্নমুখী অভিকর্ষ ভার বহন করে। যেহেতু প্রতি তলায় বিম বা গার্ডারের ওপর অভিকর্ষ ভারের তেমন কোনো পার্থক্য নেই, সেহেতু প্রতি তলায় বিম বা গার্ডার ডিজাইনেও তেমন কোনো পার্থক্য হয় না। ডিজাইন পদ্ধতি হয় সহজ, সাশ্রয়ী ও পুনরাবৃত্তি সাপেক্ষ।
অসুবিধা
এই ফ্রেম-ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে ব্রেইসিং দেওয়ার ফলে ভবনের অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। ব্রেইসড মেম্বারের কারণে দরজা, জানালা প্রভৃতির যথাযথ অবস্থান নির্ধারণ কষ্টসাধ্য হয়।
তির্যক কর্ণ বরাবর মেম্বার স্থাপন আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী নয়।
২. রিজিড ফ্রেম কাঠামো
রিজিড ফ্রেম কাঠামো বিম কলাম এবং সেগুলোর সংযোগস্থলের মোমেন্ট প্রতিহতকারী (Fixed Joint) সংযোগ বিন্দু দিয়ে গঠিত। এই ফ্রেম কাঠামোর আনুভূমিক বলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মাত্রা নির্ভর করে বিম, কলাম ও তাদের সংযোগস্থলের দৃঢ়তার ওপর।
সুবিধা
রিজিড ফ্রেম-কাঠামোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর খোলা আয়তাকার বিন্যাস, যার ফলে দরজা, জানালা স্থাপন করা সহজসাধ্য হয়।
R.C.C ভবনের জন্য এ ধরনের ফ্রেম খুবই উপযোগী।

অসুবিধা
২৫ তলা উঁচু ভবনের জন্য এই ফ্রেম কাঠামো উপযুক্ত নয়।
এ ধরনের ফ্রেম কাঠামোতে বিম-কলামের আকার পার্শ্বীয় বলের সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে নিচের দিকে ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে একই ডিজাইন পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব হয় না। ডিজাইন হয় সময়সাপেক্ষ ও আর্থিকভাবে অলাভজনক।
৩. শিয়ার ওয়াল কাঠামো
শিয়ার ওয়াল কাঠামোতে কংক্রিট বা ইটের উলম্ব দেয়াল ভবনের অভিকর্ষ (Gravity) ও পার্শ্বীয় (Lateral) উভয় ধরনের বলকে প্রতিহত করে। এ ধরনের কাঠামোতে শিয়ার ওয়াল একাই সম্পূর্ণ পার্শ্বীয় চাপকে রোধ করে।
সুবিধা
ভূমিকম্প ও বাতাসজনিত পার্শ্বীয় বল প্রতিরোধে শিয়ার ওয়াল যথেষ্ট দৃঢ় হওয়ায় এ ধরনের ফ্রেম-সিস্টেম ৩৫ তলা উঁচু ভবন পর্যন্ত সাশ্রয়ী উপায়ে ব্যবহার করা যায়।
অসুবিধা
শিয়ার ওয়ালের শক্ত অবয়বের কারণে দরজা-জানালা স্থাপন কষ্টসাধ্য হয়।
৪. ওয়াল ফ্রেম কাঠামো
ওয়াল ফ্রেম কাঠামো রিজিড ফ্রেম ও শিয়ার ওয়াল ফ্রেমের সমন্বিত রূপ। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, যখন শিয়ার ওয়াল মোট আনুভূমিক বলের ৮০ শতাংশ প্রতিহত করে, তখন ওই ধরনের ফ্রেম কাঠামোকে ওয়াল ফ্রেম কাঠামো বা ডুয়াল ফ্রেম কাঠামো বলে।
সুবিধা
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ফ্রেম কাঠামো ও ওয়াল কাঠামো একত্রে পার্শ্বীয় বলের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ মিথোস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অধিকতর দৃঢ় ও শক্তিশালী স্থাপনা গঠন করে। এ কারণে এ ধরনের ফ্রেম কাঠামো ৪০-৬০ তলা উঁচু ভবন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
শিয়ার ওয়াল অনেকাংশে পার্শ্বীয় বল রোধ করে। ফলে বিম-কলাম ডিজাইন প্রতিটি তলায় পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব হয়।

অসুবিধা
অন্যান্য ব্যবস্থার চেয়ে অপেক্ষাকৃত খরচ বেশি।
৫. টিউব ফ্রেম কাঠামো
টিউব ফ্রেম কাঠামো নামে আরও একটি ফ্রেম কাঠামো বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি ৪০-১০০ তলা পর্যন্ত উঁচু ভবন নির্মাণে ব্যবহার করা যায়। সাধারণত এ ধরনের ফ্রেম-সিস্টেমে কলামগুলো খুব কাছাকাছি সজ্জিত হয়ে ভবনের পরিসীমা বরাবর টিউবের মতো কাঠামো গঠন করে।
সঠিক ফ্রেম সিস্টেম নির্বাচন বহুতল ভবন নির্মাণের পূর্বশর্ত। এলাকাভেদে, ভবনের কার্যকারিতাভেদে ও উচ্চতার ওপর ভিত্তি করে ফ্রেম কাঠামো নির্বাচন করে আমাদের দেশের বহুতল ভবনের ডিজাইনকে যুগোপযোগী করা সম্ভব।
তন্ময় দাস
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪