বিশ্বের বড় বড় শহরে বায়ুদূষণ এক প্রকার অভিশাপ আর এটি কোনো অস্থায়ী সমস্যা নয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা যায়, বায়ুদূষণ স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি যারা স্বল্প সময়ের জন্যও এই দূষিত পরিবেশে থাকে, তারাও এর ভুক্তভোগী। এই সমস্যা থেকে বাঁচার সবচেয়ে সহজ উপায় বায়ুদূষণের জন্য দায়ী জ্বালানির ব্যবহার কমানো। কিন্তু এর বাস্তবায়ন এক দিনের কথা নয় আর হয়তো বা সবার কাছে তা গ্রহণযোগ্যতাও হবে না। তাই যা করা উচিত তা হলো দূষিত বায়ুকে পরিষ্কার ও সুষ্ঠু বসবাসের উপযোগী করে তোলা।
আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে দূষণ। বিভিন্ন ধরনের দূষণের মধ্যে ধোঁয়াশা অন্যতম। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ধোঁয়াশা কী? উনিশ শতকের শুরুর দিকে সর্বপ্রথম ধোঁয়াশা (Smog) শব্দটি লন্ডনে ব্যবহার করা হয়, যা এসেছে ধোঁয়া (Smoke) ও কুয়াশা (Fog)-এর সংমিশ্রণে। এটি যদিও বিভিন্ন ধরনের দূষণকারী উপাদানের সংযোগে তৈরি, কিন্তু মাটির নিকটবর্তী ওজোন (Ground Level Ozone) স্তরের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। ধোঁয়াশা সাধারণত সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে উদ্বায়ী জৈব পদার্থ (Volatile Organic Matter) ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের মধ্যে কিছু জটিল ফটোকেমিক্যাল বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়; যার ফলে উৎপন্ন হয় ওজোনের।
ধোঁয়াশার জন্য দায়ী দূষণ উপাদানগুলোর প্রাথমিক ও প্রধান উৎস- যানবাহনের ধোঁয়া, পাওয়ার প্লান্ট, কারখানাসহ অনেক ভোক্তাপণ্য যেমন রং, চুলের, কাঠকয়লা, স্টার্টার তরল (Charcoal Starter Fluid), দ্রাবক (Solvents), এমনকি প্লাস্টিকের প্যাকেজিং। শহরে অর্ধেকেরও বেশি দূষণকারী উপাদানের উৎস গাড়ি, বাস, ট্রাক। বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ধোঁয়াশা সৃষ্টির জন্য ভারী মোটর গাড়ির পাশাপাশি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে উচ্চ তাপমাত্রা, রোদ ও শীতল বাতাস।

ধোঁয়াশা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা যেমন শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডার সমস্যা, ফুসফুসের সংক্রমণ, চোখের জ্বালাপোড়া, শিশুদের মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া ইত্যাদির জন্য দায়ী। এ ছাড়া ধোঁয়াশার মধ্যে উপস্থিত ওজোন গ্যাসের বৃদ্ধি হ্রাস আবাদি ফসলের ক্ষতি করে এর উৎপাদন কমায়।
বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি আর ছাদ হচ্ছে বাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছাদ তৈরিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে টাইল অন্যতম। টাইল একই সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যময়, আরামদায়ক ও স্থায়ী ছাদের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে। কিছু ক্ষেত্রে এই টাইল আবার নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব ও দীর্ঘস্থায়ী জীবন।
বর্তমানে ছাদ তৈরিতে বাড়ির মালিক, স্থপতি ও ঠিকাদার সবারই উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে একে টেকসই ও বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। আর যখন পরিবেশবান্ধব উপাদানে ছাদ তৈরি করা হয়, তখন স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরিতে এর উপযোগিতা লক্ষণীয়। গাছপালা ও স্বল্প পরিসরের কৃষিকাজের মাধ্যমে বাড়ির ছাদ সবুজায়ন ও পরিবেশবান্ধব করার প্রথা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। কিন্তু কেমন হয় যদি বলা হয় কোনো প্রকার গাছ ছাড়াই বাড়ির ছাদ এমনভাবে তৈরি করা সম্ভব, যা নাকি নিজেই বাতাসকে বিশুদ্ধ করে তুলবে? সবাই হয়তো ভাবছেন এও কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। ‘বোরাল রুফিং’ (Boral Roofing) নামক কোম্পানি এই বিস্ময়কেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। তারা এমন এক প্রকার ছাদ তৈরি করছে, যা কি না নিজ থেকেই বাতাসকে অনেকটাই ধোঁয়াশা মুক্ত করবে। প্রতিষ্ঠানটি কাদামাটি ও টাইলের সমন্বয়ে এমন এক স্থায়ী ছাদের সমাধান দিয়েছে, যাকে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধোঁয়াশা শোষকে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
দীর্ঘ এক বছরের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এই ছাদ বাতাস থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড শোষণ করে নেয়। উল্লেখ্য, নাইট্রোজেন অক্সাইড ধোঁয়াশা তৈরির জন্য দায়ী। ‘বোরাল পিওর সমগ-ইটিং টাইলস’ (Boral Pure Smog-Eating Tile) ধোঁয়াশা তৈরি হ্রাস করে আর এটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় বিল্ডিংয়ের ছাদে ব্যবহার করা যায়।

যা দিয়ে তৈরি
শুনে হয়তো বা মনে হচ্ছে বাতাসকে ধোঁয়াশা হতে বিশুদ্ধ করবে? এটা না জানি কী দিয়ে তৈরি! মজার ব্যাপার হচ্ছে এই টাইলস তৈরিতে তেমন কোনো বিশেষ প্রযুক্তি বা উপাদান লাগে না। কেবল সাধারণ কংক্রিটের টাইলসের ওপর টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইডের (Titanium Dioxide) প্রলেপ দিয়ে খুব সহজে এই টাইলস তৈরি করা যায়।
কীভাবে কাজ করে?
ছাদ তৈরির উপাদানের ওপর খুব পাতলা টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইডের প্রলেপ দেওয়া হয়। টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইড রয়েছে অনেক ভোক্তা এবং শিল্পপণ্যতে।
টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইড যখন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসে তখন এটি নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx)-এর জারনকে ত্বরান্বিত করে, যা ধোঁয়াশা এর অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ শহরতলির বাতাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পাওয়া যায়। ধোঁয়াশা শোষক টাইল যানবাহন থেকে নির্গত ক্ষতিকারক নাইট্রোজেন অক্সাইডকে জারিত করে এবং বাতাসকে পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত করে তোলে। ছাদের প্রলেপের মধ্যে থাকে এক প্রকার আলোক অনুঘটক (Photo Catalyst), যা সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে সক্রিয় হয় ও ক্ষতিকারক নাইট্রোজেন অক্সাইডকে ক্যালসিয়াম নাইট্রেটে (Calcium Nitrate) পরিণত করে। এরপর যখন বৃষ্টি হয় তখন ছাদে উৎপন্ন এই ক্যালসিয়াম নাইট্রেট বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায়।
জ্বালানি তেল পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন নাইট্রোজেন অক্সাইড কিছু গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক সমস্যার জন্য সরাসরি দায়ী। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ২০০০ বর্গফুট ছাদে এই টাইল ব্যবহার করলে এক বছরে তা যে পরিমাণ নাইট্রোজেন অক্সাইডকে জারিত করে, তা একটি গাড়ি ১০৮০০ মাইল (প্রায় ১৭৫০০ কিলোমিটার) চললে যে পরিমাণ নাইট্রোজেন অক্সাইড উৎপন্ন হয়, তার সমান। সুতরাং এই টাইল ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়ির মালিকেরা বাতাসে ধোঁয়াশা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন, যা একই সঙ্গে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যাকে অনেকাংশে দূর করে।

প্রয়োজন যে কারণে
ধোঁয়াশা অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের আকাশকে কলুষিত করে এবং এর ফলে সুন্দর নীল আকাশে ধূসর বাদামি আবছায়ার সৃষ্টি হয়। দৃষ্টিকটু হওয়ার পাশাপাশি এর ক্ষতিকর প্রভাব অতীব ভয়াবহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, বায়ুদূষণের ফলে সারা বিশ্বে প্রতিবছর কমপক্ষে ২৪ লাখ মানুষ মারা যায়। মার্কিন ফুসফুস সমিতির (American Lung Association) করা ‘বাতাসের অবস্থা’ (State of the Air) নামক সমীক্ষায় দেখা গেছে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ১৫ কোটি ৪০ লাখ লোক বায়ুদূষণজনিত সমস্যায় ভুগছে, কিছু ক্ষেত্রে এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শ্বাস নেওয়াও সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সমস্যা গ্রামের থেকে শহরে বেশি দেখা যায়। কারণ, শহরে গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি যানবাহন চলাচল করে। আর যানজটের ফলে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় বায়ুদূষণ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
মার্কিন ফুসফুস সমিতি ধোঁয়াশার ফলে সৃষ্ট কিছু স্বাস্থ্য সমস্যাকে চিহ্নিত করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অকাল জন্ম, শিশুমৃত্যু, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, অ্যালার্জি, হাঁপানি, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস, অকালমৃত্যু, ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাক। এই সমস্যাগুলো অনেক সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে পৃথিবীতে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে ভুগছে। সব কথার শেষ কথা, বাতাসে ধোঁয়াশার পরিমাণ হ্রাস করে নিশ্চিত করা সম্ভব মানুষের দীর্ঘায়ু।

টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইড ব্যবহার কি নিরাপদ?
টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইড এক প্রকারের আলোক অনুঘটক, যা বাতাসের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশবান্ধব ও মানুষের জন্য দারুণ নিরাপদ হিসেবে প্রমাণিত। এই যৌগটি আমাদের প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত অনেক পণ্যে পাওয়া যায়, যেমন- রং, কসমেটিকস, এসপিরিন, টুথপেস্ট ইত্যাদি। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালের অপারেশন রুমের দেয়াল জীবাণুমুক্ত করতে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইডের পরিবেশবান্ধবতা বিভিন্ন গবেষণায় বিশেষভাবে প্রমাণিত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে ইউরোপিয়ান পিআইসিএডিএ (PICADA)-এর এক প্রজেক্টে টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইডের প্রলেপের ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এটি খুবই উপকারী এবং তা নাইট্রোজেন অক্সাইড ও উদ্বায়ী জৈব যৌগ, যা ধোঁয়াশার জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী, এদের জারণে সার্থক ভূমিকা রাখে। সুতরাং বলা যায় যে টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং মানুষ ও পরিবেশের ওপর এর কোনো বিরূপ প্রভাব নেই।
টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইডের বিশেষ কিছু সুবিধা
ধোঁয়াশার অণু গঠন হ্রাস করার ক্ষমতা ছাড়াও টিটেনিয়ম ডাই-অক্সাইড আরও কিছু বিশেষ সুবিধা বাড়ির মালিকদের উপহার দিয়ে থাকে। এটি এক প্রকার সদা সবুজায়ন প্রযুক্তি যা জৈব পদার্থকে ভেঙে ছাদের ওপরে জমিয়ে রাখে, যা আবার সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে পুনরায় ভেঙে স্বচ্ছ উপাদানে পরিণত হওয়ায় ছাদের সৌন্দর্য থাকে অটুট ও আকর্ষণীয়। এ ছাড়া নাইট্রোজেন অক্সাইডের জারণের ফলে উৎপন্ন ক্যালসিয়াম নাইট্রেট খুবই উপকারী পদার্থ, যা কি না বাগানে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বৃষ্টির পানিতে যখন এই পদার্থ ধুয়ে মাটিতে পড়ে ও মিশে যায়, কে জানে তখন হয়তো বা মাটিতে থাকা গাছপালা ধন্যবাদ জানায় অজান্তেই।

পরিশেষ
ছাদ তৈরিতে আমরা অনেকেই বিভিন্ন রকম উপাদান ব্যবহার করি। আর বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনে কারও কোনো কার্পণ্য থাকে না বললেই চলে। সৌন্দর্যবর্ধনের কথা চিন্তা করলে ধোঁয়াশা শোষক টাইল কোনো অংশেই পিছিয়ে থাকবে না। তার ওপর এর পরিবেশবান্ধবতার কথা চিন্তা করলে এর তুলনা হয় না। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে বাতাস যে হারে দূষিত হচ্ছে তা শোধনের দায়িত্ব কারও একার নয়। সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রতিটি ছোট ছোট পদক্ষেপ নিলে একসময় তার ফলাফল হবে বিস্ময়কর ও অকল্পনীয়। তেমনি বায়ু বিশুদ্ধকরণের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস ধোঁয়াশা শোষক টাইলের ব্যবহার। খরচা না-হয় হলোই একটু বেশি, তাতে কী! কে না চায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর আবাসস্থল রেখে যেতে!
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
মো. নূর বাসিত জামান
প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪১ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩