ঢাকার নগরায়ণ ও নগর পরিকল্পনার

পটভূমি 

ঢাকা প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। একসময় ঢাকা জগদ্বিখ্যাত ছিল এর মসলিন কাপড়, মসজিদ আর বাণিজ্যের জন্য। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এই রূপরেখার পরিবর্তন ঘটেছে।

পৃথিবীর অনেক বড় শহরের মতো ঢাকা শহরও গড়ে উঠেছে অনেকটা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অপরিকল্পিত উপায়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়েছে, যা এই শহরকে পরিণত করেছে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল ও বৃহৎ মেগাসিটিতে। 

১৯৭০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩.৩৬ লাখ, যা ২০১২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১.৫ কোটিতে। ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ, উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসাব্যবস্থা এবং অন্যান্য আধুনিক সুবিধার কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ঢাকার দিকে ছুটে আসছে হাজারও মানুষ। এর ফলে ঢাকা শহর পরিণত হচ্ছে আধুনিক যুগের বস্তিতে। ঢাকা এখন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মাত্রাতিরিক্ত নগর দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক পানি (নর্দমার) নিষ্কাশনে অচলাবস্থা, অবৈধ বসতি ও বস্তি স্থাপন, যানজট, পরিবেশদূষণ এবং অন্যান্য আর্থসামাজিক সমস্যায় ব্যাপকভাবে জর্জরিত।

জলাধার সংবলিত নগরের একাংশ

তা ছাড়া এই বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার চাপে ঢাকা শহরের আনুভূমিক এবং ঊর্ধ্বমুখী উভয় ধরনের প্রসারণ ঘটছে। এর ফলে ঢাকা ও এর আশপাশের যাবতীয় জলাধার, মুক্তস্থান, খেলার মাঠ, জলাভূমি, কৃষিজমি, বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল, বন-জঙ্গল, গাছপালা, গ্রামীণ বসতি এবং রাস্তাঘাট দখল হয়ে সেখানে নির্মিত হচ্ছে কংক্রিটের ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো।

এসব সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ঢাকা এখন পরিণত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বসবাসের অযোগ্য শহরে।

সমস্যা চিহ্নিতকরণ

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে বৃহত্তর ঢাকা শহরের নগরায়ণের (রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, অবকাঠামো ইত্যাদি) পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩.৪%, যা ২০০৯ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬%-এ। অন্যদিকে এই দুই দশকে (১৯৮৯-২০০৯) পতিত জমি, নিম্নভূমি, কৃষিজমি, গাছপালা এবং জলাভূমির পরিমাণ কমেছে লক্ষণীয়ভাবে (মানচিত্র-১)।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা নগর

এ ধরনের মানচিত্র আধুনিক জিআইএস এবং রিমোট সেনসিং প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রস্তুত করা সম্ভব। সামগ্রিক ধারণা অর্জনের জন্য এসব সময়গত মানচিত্র খুবই কার্যকর।

বিগত দুই দশকের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৯ সালে ঢাকায় নগরায়ণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৬৯%-এ। এ রকম দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ যেকোনো শহরের জন্য হুমকিস্বরূপ।

মানচিত্র ১

মানচিত্র-১ : ঢাকার নগরায়ণের ক্রমবিকাশ (১৯৮৯-২০০৯)

ঋণাত্মক প্রভাব

দ্রুতগতির নগরায়ণের ফলে ঢাকা শহর বিভিন্ন রকম মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘টৎনধহ ঐবধঃ ওংষধহফ (টঐও)’-এর প্রভাব। ইউএইচআই-এর ফলে শহর অঞ্চলের তাপমাত্রা অধিক থাকে এর আশপাশের গ্রাম-এলাকা থেকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে অধিক নগরায়ণের ফলে ইউএইচআইয়ের প্রভাব বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকার গড় তাপমাত্রা এর আশপাশের কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার চেয়ে বেশি থাকে। ইউএইচআই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ বলে আধুনিক যুগে বিবেচিত।

ঘরবাড়ি, কংক্রিট, রাস্তার অ্যাসফাল্ট/ অ্যাসফল্ট এবং শিল্পসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড ইউএইচআইয়ে প্রভাব সৃষ্টির প্রধান কারণ। প্রাকৃতিক ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের আবরণকে নষ্ট করে গড়ে ওঠা দালানকোঠা, ফুটপাথ এবং অন্যান্য অবকাঠামো; প্রাকৃতিকভাবে বায়ুমণ্ডলকে ঠান্ডা করা থেকে বিরত রাখে। এ ছাড়া সুউচ্চ ভবন এবং অপ্রশস্ত রাস্তা, গরম বাতাস আটকে রাখে এবং স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। সর্বোপরি যানবহন, কলকারখানা এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে নির্গত তাপ এই ইউএইচআই প্রভাবকে আরও ত্বরান্বিত করে।

নগরীর ঘিঞ্জি পরিবেশ

ইউএইচআই স্থানীয় আবহাওয়া এবং জলবায়ুকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া ইউএইচআইয়ের প্রভাব যে শহরে বেশি থাকে, সেই শহরের বায়ুদূষণের মাত্রাও বেশি থাকে। এর ফলে এ ধরনের ইউএইচআই আক্রান্ত নগরবাসী নানাবিধ বায়ুদূষণ এবং শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয়। সুতরাং ঢাকার ইউএইচআই নিয়ে গবেষণা করা খুবই জরুরি এবং সময়োপযোগী, যা ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে সহায়তা করতে পারে।

বিশ্লেষণ এবং ফলাফল

মানচিত্র ২

ঢাকার ইউএইচআইয়ের প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য, ‘জিআইএস’ এবং ‘রিমোট সেনসিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে, বিগত দুই দশকের (১৯৮৯-২০০৯) তাপমাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অঞ্চলের ক্রমবিকাশের মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়েছে (মানচিত্র-২)।

মানচিত্র-২ : ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অঞ্চলের ক্রমবিকাশ (১৯৮৯-২০০৯)

গবেষণার জন্য সমগ্র ঢাকা শহরকে ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ছয়টি তাপ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। নিম্ন তাপমাত্রা ‘সবুজ’ রং, মধ্যম তাপমাত্রা ‘কমলা’ রং এবং উচ্চ তাপমাত্রা অঞ্চল নির্দেশক হলো ‘লাল’ রং। এভাবে মানচিত্র প্রস্তুত করার পর আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি যে ১৯৮৯ সালে ঢাকার বেশির ভাগ অঞ্চল ছিল ‘নিম্ন তাপমাত্রা’ অঞ্চলভুক্ত। ১৯৯৯ সালে যা মধ্যম তাপমাত্রা অঞ্চলে এবং ২০০৯ সালে উচ্চ তাপমাত্রা অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (মানচিত্র-২)।

অর্থাৎ বিগত দুই দশকে (১৯৮৯-২০০৯) ঢাকায় আরবান হিট আইল্যান্ড (ইউএইচআই)-এর প্রভাব প্রকট হয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। মানচিত্র ১ এবং ২ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে ঢাকায় ‘নগরায়ণ’ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ‘উচ্চ-তাপ অঞ্চলের’ পরিমাণও বেড়েছে।

পরামর্শ

এমতাবস্থায় ঢাকার ইউএইচআইয়ের প্রভাব কমানোর এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ খুবই জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উচিতÑ

১. ঢাকার জন্য একটি সময়োপযোগী ও আধুনিক মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত এবং প্রণয়ন করা।

২. ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় আনা।

৩. ঢাকায় বৃক্ষরোপণ, বনায়ন এবং সবুজায়নকে গুরুত্ব দেওয়া।

৪. ঢাকার প্রাকৃতিক খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, হ্রদ এবং জলাধারগুলোকে রক্ষা করা।

উপসংহার

ঢাকাকে একটি আধুনিক এবং বসবাসযোগ্য নগরে পরিণত করার জন্য ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ’ এককভাবে চরম হুমকিস্বরূপ। এর সঙ্গে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড (ইউএইচআই)’; প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে ঢাকাকে নিকট ভবিষ্যতে একটি ‘পরিত্যক্ত নগর’ ঘোষণা করতে হতে পারে।

এমতাবস্থায় আরবান হিট আইল্যান্ড (ইউএইচআই)-এর প্রভাব কমানোর জন্য ঢাকার নগরায়ণের ধারাকে করতে হবে সুসংহত। একমাত্র পরিকল্পিত নগরায়ণই হতে পারে এর সুষ্ঠু সমাধান। তাই সময় এসেছে, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার বর্তমান মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা এবং নিকট ভবিষ্যতের জন্য একটি আধুনিক মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করা।

বায়েস আহমেদ

নগর পরিকল্পনাবিদ এবং নগর গবেষক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৬ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top