শতরঞ্জি। অনেকে বলেন কার্পেট। দেশীয় উপাদান ব্যবহার করে দেশে তৈরিকৃত গেরস্থালি অনুষঙ্গ এটি, যা আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। শতরঞ্জিকে এখনো এ দেশে গৃহসজ্জায় সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের প্রতীক মনে করা হয়।
বর্তমানে এটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে ইউরোপের বাজারে। দেশীয় যেসব প্রাচীন বুননশিল্প এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে শতরঞ্জি অন্যতম। নানা রং আর অপূর্ব নকশার সমন্বয়ে তৈরি হয় গৃহসজ্জার নান্দনিক এই পণ্যটি।
শতরঞ্জি সাধারণত ঝুট কাপড়, পুরোনো সোয়েটার, শ্যাগী, শ্যানেল, উল, অ্যাক্রিলিক, কটন, র্যাগ, রিপ ইত্যাদি সমন্বয়ে তৈরি। আর এগুলো সাধারণত তৈরি করে থাকে মুসলিন কারিগরেরা। এর নির্দিষ্ট কোনো ডিজাইনার নেই।
তবে যাঁরা এর কারিগর তাঁরাই এর ডিজাইনার। মনের নিজস্ব মাধুরী মিশিয়ে এই শতরঞ্জিগুলো তৈরি করা হয়। মোগল আমল থেকে রাজা-বাদশাহরা ফ্লোরে বসার জন্য এই শতরঞ্জি ব্যবহার করতেন। ১৯৯০ সালের দিকে ঢাকায় শতরঞ্জির বাণিজ্যিক বিপণন শুরু হয়।
শতরঞ্জিতে বাঙালিয়ানা
শতরঞ্জি কেবল আমাদের দেশীয় পণ্য তা কিন্তু নয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যও। কিছুদিন আগেও শতরঞ্জির বাজার ভালো ছিল না, জানালেন শুক্রাবাদের ব্যবসায়ী হামিদুর রহমান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এর গুণগত মান বেড়েছে। বেড়েছে চাহিদাও। জোগান দিতে এখন কারখানায় উৎপাদিত হচ্ছে শতরঞ্জি।
শিল্প হিসেবে যেমন গড়ে উঠেছে তেমনি গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যও দূর হচ্ছে শতরঞ্জিতে। আর এ কারণেই রংপুরের একটি গ্রামের নামই বদলে হয়েছে শতরঞ্জিপল্লী। বাজার ভালো হওয়ায় এখন কেবল রংপুরে নয়, উত্তরের ঠাকুরগাঁও আর কুড়িগ্রামেও গড়ে উঠছে শতরঞ্জি শিল্প-কারখানা।

শতরঞ্জি সম্পর্কে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজ রহমান জানালেন, শতরঞ্জি আগে শুধু পাট দিয়ে তৈরি হতো। এখন পাটের সুতা পাওয়া যায় না বলে বিভিন্ন বর্জ্য, কচুরিপানা, পোশাকশিল্পের ঝুট, ভুট্টার খোসা, গমগাছের খোসা, কলাগাছের বাকল, পুরোনো সোয়েটার ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। এই পণ্যে কোনো প্রকার রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার নেই বলে এটা স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব।
শতরঞ্জির ব্যবহার
মিরপুরে নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছেন রফিক-সুমনা দম্পতি। ঘরের সবকিছু সাজিয়েছেন দেশীয় সব তৈজসপত্র দিয়ে। জানালার পর্দা, দেয়ালের পেইন্টিং, সোফা ও অন্যান্য ঘরের সামগ্রী দেখে মনে হবে এ যেন পুরোটাই বাঙালিয়ানা। বিড়ম্বনায় পড়েছেন বসার ঘরের মেঝেকে কীভাবে সাজাবেন তা নিয়ে। পরামর্শ নিলেন, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার গুলশান নাসরিন চৌধুরীর কাছে।
তিনি বললেন শতরঞ্জি কিনতে। তাই সোজা চলে এসেছেন নিউমার্কেটে। এখানেই কথা হলো এই দম্পতির সঙ্গে। পছন্দের শতরঞ্জি কিনেছেন। কম মূল্যে পছন্দের উপকরণ পেয়ে বেজাই খুশি। শুধু মেঝেতেই নয়, বরং দেয়ালকে সাজাতে ব্যবহার করা যায় শতরঞ্জি। দেয়ালের আয়তন অনুযায়ী বড়, মাঝারি বা ছোট যেকোনো আকৃতির শতরঞ্জি ঝুলিয়ে দেওয়া যায়। বহুগুণে বেড়ে যাবে ঘরের দেয়ালের সৌন্দর্য।
গৃহসজ্জায় সব সময় মেঝের সৌন্দর্যে শতরঞ্জি ব্যবহার করতে পারেন। আর শীতের সময় ফার্নিচার বাদ দিয়ে মেঝেজুড়েই ব্যবহার করা যায় শতরঞ্জি। বসার ঘর যদি বড় হয় এবং দুই সেট সোফা থাকে, তবে সেন্টার টেবিলের দুই পাশে বিছিয়ে দেওয়া যায় দুটি শতরঞ্জি। বললেন, ফারজানাস ব্লিসের পরিচালক ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ফারজানা গাজী। ।
বসার ঘর, ফ্যামিলি লিভিং বা প্যাসেজ, যেখানেই ডিভান থাকুক তার সামনে বিছিয়ে দিন একটি শতরঞ্জি। শতরঞ্জি সাধারণত একটু কালারফুল হয়। দেয়াল, ফার্নিচার ও পর্দার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে শতরঞ্জি নির্বাচন করলে ভালো।

রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও
তাঁত শ্রমিকদের ধরে রেখে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আবারও ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠান দেশীয় পণ্য শতরঞ্জির ব্র্যান্ডিং করে বিদেশে বাজারজাত ও রপ্তানি করছে। আর এখন আমাদের দেশে মূল উৎপাদনের ৯০ শতাংশ শতরঞ্জি চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আর রপ্তানির এই কাজটি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকা বৈদেশিক মুদ্রাও আসে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
দরদাম
উলের শতরঞ্জি ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা, শ্যানেলের কার্পেট ২৫০ থেকে তিন হাজার, ঝুট ও পাটের তৈরি শতরঞ্জি ২০০ থেকে দুই হাজার, আর শুধু ঝুটের শতরঞ্জি রয়েছে ১৫০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। শতরঞ্জির পাপোস পাওয়া যাচ্ছে ৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়।

কোথায় পাবেন
রাজধানীর মিরপুর, কাকরাইল, শুক্রাবাদ, মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে পাবেন শতরঞ্জি। এ ছাড়া বড় বড় ও পুরোনো মার্কেটগুলোতে শতরঞ্জি বিক্রি হয়। এ ছাড়া রংপুর গেলে কারুপণ্যের শোরুম থেকে সংগ্রহ করতে পারেন এই ঐতিহ্যবাহী অভিজাত গৃহসামগ্রীটি।
- শামস্ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৭ তম সংখ্যা, মে ২০১৩