গ্রামের সেই মেঠো পথের কথা মনে পড়ে? দুপাশে ধানখেত, মাঝে সরু মেঠোপথ। হেঁটে চলা দুপুর। একপাশে চলছে শ্যালো মেশিন। অথবা নদী বা ডোবার পাশে খেতের আইলে বসে থাকা কৃষকের হাতে রাখা রশি ধরে খানিক পরপর টানছেন। সেই টানে একটা নৌকার মতো কাঠের পাটাতন (দোন) উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। সঙ্গে নিয়ে আসছে বেশ কিছু পানি। সেই পানি ছড়িয়ে পড়ছে ফসলের খেতে! দিনবদলের সঙ্গে বদলেছে পটভ‚মি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সংস্থান নিশ্চিত করতে প্রয়োজন হচ্ছে অধিক ফসল উৎপাদনের। বাড়ছে পানির চাহিদা। ফসলের মাঠ ভরে যাচ্ছে শ্যালো মেশিন ও ডিপটিউবয়েল দিয়ে। উত্তোলিত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে ভ‚গর্ভস্থ পানি। এতে ক্রমেই নামছে পানির স্তর। অথচ উন্নত দেশগুলো উদ্ভাবন করেছে আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব নানা সেচপদ্ধতি, যেখানে অনেক কম পানি ব্যবহার করেই ফলানো যায় কাক্স্ক্ষিত ফসল। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব সেচ প্রকল্প ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন স্থপতি রাজীব চৌধুরী
দেশে ভ‚গর্ভস্থ থেকে উত্তোলিত পানির প্রায় ৯৭ শতাংশ ব্যবহার হয় সেচ কাজে। ভূগর্ভস্থ পানির তুলনায় উপরিভাগের পানি সেচের জন্য অধিক উপযোগী হলেও শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা না থাকায় ৭৮ শতাংশ সেচ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। প্রচলিত সেচ ব্যবস্থাপনায় দেশে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে প্রায় ৩-৪ হাজার লিটার সেচ পানি প্রয়োজন। তাই প্রতিবছর গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে সহজ ও সস্তা বলে এ পদ্ধতিটি খুবই জনপ্রিয়। তবে এ পদ্ধতিতে সেচের পানির সমবণ্টন হয় না। উঁচু-নিচু জমিতে সেচ দেওয়া অসুবিধাজনক এবং পানির অপচয়ও বেশি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ পদ্ধতিতে সেচকৃত পানির ৮০ শতাংশ হয় অপচয়।
অন্যদিকে সাধারণ নিয়মানুসারে ৫০০ মিটারের রেডিয়াসের বৃত্তের মধ্যে একের অধিক ডিপটিউবওয়েল বসানো নিষিদ্ধ হলেও বিভিন্ন স্থানে একাধিক টিউবওয়েল বসিয়ে উত্তোলিত হচ্ছে পানি। এতে ওই সব এলাকার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে অনেক গ্রামে এখন টিউবওয়েল দিয়ে পানি তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক, কমে যাচ্ছে মাটির জৈব উপাদান ও পুষ্টি এবং মাটি হারাচ্ছে গুণগতমান। আবার শক্তিশালী মেশিন দিয়ে পানির পাম্প চালানোয় অনেক অঞ্চলে লোডশেডিং বেড়েই চলেছে। ফলে ফসলের জন্য সেচ ব্যবস্থাপনা পরিবেশবিজ্ঞানীদের জন্য শঙ্কার কারণ। অথচ ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ অপরিহার্য। এসব সমস্যা মোকাবিলায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, মাটির গুণগত মান রক্ষা, ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, উৎপাদন ব্যয় কমাতে বিজ্ঞানীরা গবেষণার সেচ পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন, প্রযুক্তি সংযোজন ও কৌশল অবলম্বন করে দেখেছেন। এতে যেমন ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত পানি সাশ্রয় সম্ভব, অন্যদিকে বাড়ানো যাবে ফসলের উৎপাদন।
প্রচলিত সেচব্যবস্থা
প্রাচীনকাল থেকেই ফসল ফলাতে এ দেশে নদী, খাল, বিল, হাওর, পুকুর এসব জলাশয় থেকে হাতে হাতে, সেঁউতি, দোন ইত্যাদি মাধ্যমে জমি সেচ হয়ে আসছে। পরে যুক্ত হয় শ্যালো পাম্প ও ডিপটিউবয়েল। এ ছাড়া দেশে নানা রকম সেচপদ্ধতি প্রচলিত আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
ভূপৃষ্ঠ সেচপদ্ধতি
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় এই পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পানি ওপর থেকে ঢালু নালা দিয়ে আবাদি জমিতে নেওয়া হয়। এ ধরনের সেচপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে-
প্লাবন পদ্ধতি
নালা পদ্ধতি
বাঁধ সেচপদ্ধতি
বাঁধ ও নালা পদ্ধতি
করোগেশন সেচপদ্ধতি
বৃত্তাকার সেচপদ্ধতি ইত্যাদি
সনাতন সেচপদ্ধতি
সনাতন পদ্ধতিতে নদী, পুকুর বা খাল থেকে মানুষের মাধ্যমে পানি পরিবহন করে জমিতে প্রদান করা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সামান্যই সেচ দেওয়া সম্ভব। আবার অনেক মানুষের শ্রমের প্রয়োজন। বর্তমানে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে এই পদ্ধতি চালু আছে।
জোয়ার-ভাটা পদ্ধতি
এই সেচ পদ্ধতিতে কোনো পাম্প প্রয়োজন হয় না। এখানে জমির থেকে উঁচু নদীর পানি জমিতে স্বাভাবিক অভিকর্ষজ বলের নিয়মে প্রবাহিত হয়। সাধারণত নদীতে জোয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পানি প্রবেশ করানো হয়। উঁচু জমি থেকে এই পানি ধীরে ধীরে নিচু জমিতে নেমে আসে। এই পদ্ধতিতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সেচ হয়।
সাব-ইরিগেশন
নদী বা খালে বাঁধ দিয়ে জলস্থর উঁচু করে এই সেচ দেওয়া হয়। পানি ওপরের জমি থেকে নিচের জমিতে নেমে আসে। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ বা টিপাইমুখ বাঁধ এ ধরনের সেচ প্রকল্পের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই সেচপদ্ধতিতে নদীতে বাঁধ দিয়ে নতুন একটা চ্যানেল খুলে পানিকে নিয়ে আসা হয় এমন জমিতে, যেখানে পানি ঠিকমতো পৌঁছায় না। সেই পানিকে জমিতে নিয়ে গিয়ে সেচ দিয়ে পানি আবারও নদীতে ফিরিয়ে আনা হয় অথবা পানিকে অন্য চ্যানেলের মাধ্যমে আবার সেই নদীতে ফেলা হয়। এভাবে একটা বিরাট এলাকা সেচের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এভাবে সেচ দেওয়া হয়। যদিও নদী মরে যাওয়ার জন্য এই সেচপদ্ধতি অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু এই পদ্ধতি বেশ প্রচলিত।
হস্তচালিত সেচ
এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর সেচপদ্ধতি। জলাধার থেকে মানুষের সাহায্যে পানি শারীরিক কসরতের মাধ্যমে জমিতে নিয়ে আসার এই প্রক্রিয়া বেশ প্রাচীন। তবে এখনো বিভিন্ন স্থানে এটির মাধ্যমে জমিতে সেচ দেওয়া হয়।
প্রযুক্তিবান্ধব আধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা
আধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনায় শুধু জমিতে পানির প্রবাহই নিশ্চিত করা হয় না, বরং মাটির প্রকৃতি, পরিবেশ, ফসলের প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। পানির উৎসের ওপর নির্ভর করে সেচ প্রকল্পগুলোর নকশা এমনভাবে করা হয়, যেন পরিমিত পানির ব্যবহার নিশ্চিত করে খুব কম পরিশ্রমে অধিক ফলন পাওয়া যায়। প্রযুক্তিবান্ধব আধুনিক সেচপদ্ধতির মধ্যে বহুল ব্যবহৃত কিছু সেচ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ফোয়ারা বা স্প্রিংক্লার সেচপদ্ধতি
এ পদ্ধতি প্রাকৃতিক বৃষ্টির মতোই গাছের ওপরে বা জমির ওপরে পানি বর্ষণ বা সিঞ্চন করা হয়। নলের মুখে নজল লাগানো থাকে, তাই পানি ফোয়ারার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একে ওভারহেড বা বর্ষণ সেচও বলা হয়। উঁচু-নিচু জমির জন্য এ পদ্ধতি খবুই উপযোগী। পানি একটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে নিয়মিত একটি বা একাধিক নির্দিষ্ট স্থান দিয়ে পাইপের মাধ্যমে স্প্রিংক্লারের মধ্য দিয়ে পানি বিভিন্নভাবে ছিটিয়ে সেচ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এই ধরনের সেচ খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু বিদেশে অনেক আগে থেকে এ পদ্ধতিতে সেচকাজ চলছে। এই পদ্ধতির সেচ অনেক বেশি জলসাশ্রয়ী। এই সেচ আবার দুই প্রকার। যেমন-
ঘূর্ণমান নজল পদ্ধতি
ছিদ্রযুক্ত নজল পদ্ধতি
প্রথম পদ্ধতিতে সেচ নলের মাথায় একটা ঘূর্ণমান নজল বসানো থাকে এবং নির্দিষ্ট সময় পর ঘুরে ঘুরে পানি সিঞ্চন হতে থাকে। আনারসের জন্য এ পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো। ঢালু, খাড়া, পাহাড়ি, বেলে মাটিতে এবং অসমতল জমিতে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর। এটি নতুন ফসলের চারার জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়। গরম আওহাওয়ায় এটি বেশ কার্যকর, বিশেষ করে জমির মাটি কম্প্যাকশনের জন্য (বিশেষত রোপণের আগে বেলে দো-আঁশ মাটির জন্য) এবং বিশেষ করে ধুলোযুক্ত এলাকায় গাছের পাতা ধুয়ে ফেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জমিতে সেচের জন্য শ্রম খরচ কম হওয়ায় স্প্রিংকলার সেচের প্রতি সবাই আকৃষ্ট হচ্ছে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে আমেরিকার ৩৬-৪৫ মিলিয়ন একর জমি স্প্রিংক্লার সেচের আওতায় এসেছিল। ৩ দশমিক ৭ থেকে ৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন একর জমিতে স্প্রিংক্লারের ব্যবহার বেড়েছে, যা প্রায় ১৩০ শতাংশের বেশি।
সুবিধা
পাহাড়ি বা অসমতল জমিতে এ পদ্ধতি উপযোগী
পানির অপচয় কম হয়
ভূমিক্ষয় হয় না, জমি সমতল করার প্রয়োজন নেই
কম পরিশ্রমে সবখানে সুন্দরভাবে পানির প্রবাহ তৈরি করা যায়
অসুবিধা
ফোয়ারা সেচপদ্ধতিতে খরচ বেশি
অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের দরকার
কাÐ ও পাতা ভিজে যায় বলে উদ্ভিদের রোগের প্রকোপ হতে পারে
অপরিষ্কার পানি নজলের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করলে নজল বন্ধ হয়ে যেতে পারে
ড্রিপ সেচপদ্ধতি
এটি সেচের আধুনিকতম পদ্ধতি। এই সেচপদ্ধতিতে প্লাস্টিকের নলের সাহায্যে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গাছের গোড়ায় সরবরাহ করা হয়। জমি সব সময় সিক্ত থাকে বলে গাছে কখনো পানির অভাব হয় না। যেসব অঞ্চলে পানির অভাব; যেমন মরুভূমি, পাহাড়ি এলাকা এবং মাটি লবণাক্ত সেসব অঞ্চলে এ সেচপদ্ধতি খুবই কার্যকর। এ পদ্ধতিতে ফলগাছ ও শাকসবজিতে সেচ দেওয়া হয়।
সুবিধা
পানির অপচয় কম হয়
সেচের পানির সঙ্গে সারও প্রয়োগ করা যায়
পানির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়
শিকড় অঞ্চলের লবণের ঘনমাত্রা হ্রাস পায়
অসমতল বা ঢালু যেকোনো জমিতেই সেচ দেওয়া যায়
অসুবিধা
প্রাথমিক খরচ বেশি
মাঠ ফসলের জন্য উপযোগী নয়
দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
সেন্টার পিভট সেচপদ্ধতি
এটা অনেকটা স্প্রিংক্লার সিস্টেমের মতোই। তবে এতে স্প্রিংক্লারগুলোকে নানা দিকে ঘুরিয়ে সেচ দেওয়া হয়। এতে জমির সবখানে সমানভাবে পানি সেচ দেওয়া যায়।
অণু-সেচ প্রকল্প
অণু বা মাইক্রো-সেচ হলো মাটির উপরিভাগে ওপর এবং নিচে ঘন ঘন অল্প পরিমাণ পানির প্রয়োগ, হালকা পানি সেচের মাধ্যমে অবিরাম পানি প্রয়োগ।
বেসিন সেচ প্রকল্প
বেসিন সেচ প্রকল্পে জমি দুইভাগে ভাগ করা হয়। সহজ নকশার মাধ্যমে দুই অংশে আলাদাভাবে সেচ প্রদান করা এই পদ্ধতিকে বলা হয় বেসিন সেচ প্রকল্প।
গ্রাভিটি ইরিগেশন
গ্রাভিটি ইরিগেশন বা মধ্যাকর্ষজ বল ব্যবহার করে সেচ প্রকল্পগুলোতে খালের মাধ্যমে সেচের পানি জমিতে নিয়ে আসা হয়। এখানে কোনো বল প্রয়োগ হয় না। এই সেচ প্রকল্প তেমন খরচের ব্যাপারও নয়। কিন্তু অনেক অভিজ্ঞ কর্মী ও তাঁদের দক্ষতা প্রয়োজন হয়। আর এই পদ্ধতি কাজে লাগানোর জন্য একদিকে ঢালু আছে এমন জমির প্রয়োজন হয়। এটা না হলে জমির উচ্চতা নির্ণয়, কেটে ঢালু করা ও এটি কর্মক্ষম করে রাখার জন্য অনেক খরচ হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রাভিটি ইরিগেশনের নানা রকম ভাগ আছে। যেমন, ফারো ইরিগেশন, বর্ডার ইরিগেশন, বেসিন ইরিগেশন ইত্যাদি।
ফারো ইরিগেশন
এটা সাধারণত সারিবদ্ধ ধানি জমিতে প্রয়োগ করা হয়। দুই সারি ফসলের মাঝে খাদকেই ফারো বলা হয়। সারফেস ইরিগেশনের এই পদ্ধতিতে, খেতের মাধ্যমে সেচ প্রয়োগ করা হয়, যেগুলো ছোট খালের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এগুলো থেকে সেচের পানি ঢালু জমিতে প্রবেশ করে। আর এভাবে জমি থেকে অন্য জমিতে পানি প্রবাহিত করতে করতে সেচ দেওয়া হয়। এখানে জমিতে পানির প্রবাহের মাত্রা মাটির গুণাবলির ওপর নির্ভর করে। বালু মিশ্রিত মাটির চেয়ে কাদা মাটিতে পানির প্রবাহ তুলনামূলক বেশি হয়। মাটির মান বা ল্যান্ড গ্রেড ফারো ইরিগেশনের দিকে ১ শতাংশ বা এর চেয়ে কম হলে পানি প্রবাহ সঠিকভাবে হয়। এই মান ২-৩ শতাংশ হলে (মাটির মানের ওপর নির্ভর করে এই মান পরিবর্তিত হয়) এটা সেচে প্রভাব ফেলে। জমি বেশি খাড়া হয়ে গেলে তখন জমিতে পানির অবস্থান কম হয়, পানিও তখন বেঁকে প্রবাহিত হয়। ফারোগুলোর ব্যবধান ফসলের ধরন এবং চাষ এবং রোপণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ধরনের ওপর নির্ভর করে। এদের দৈর্ঘ্য মূলত মাটির ব্যাপ্তি, শ্রমের ধরন, দক্ষতা ও সেচের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। প্রবাহের হার মাটির হারে অনুপ্রবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ফারোর আড়াআড়ি ঢাল মাটির প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে, বিশেষ করে পানির প্রবাহ ঠিকমতো না হওয়ার কারণে জমির ঢাল কম হওয়া। যেমন-
ঢাল %
০.২৫ ০.৫ ০.৭৫ ১.০ ১.৫ ২.০
ছসধী (স৩/যৎ)
৯.০ ৪.৫ ৩.০ ২.২ ১.৫ ১.১
বর্ডার বা স্ট্রিপ সেচপদ্ধতি: জমিকে বেশ কয়েকটি ৫ থেকে ২০ মিটারের স্ট্রিপে ভাগ করা হয়। জমির অন্যদিকে ১০০ থেকে ৪০০ মিটার ভাগে ভাগ করা হয়। পানির গতিকে চালনা করার জন্য সমান্তরাল আর্থ ব্যান্ড বা লেভ প্রদান করা হয়। অনুদৈর্ঘ্য ঢালের প্রস্তাবিত নিরাপদ সীমা মাটির গঠনের ওপরও নির্ভর করে:
বেলে দো-আঁশ ও বেলে মাটি
০.২৫ – ০.৬%
মাঝারি দো-আঁশ মাটি
০.২ – ০.৪%
এঁটেল থেকে এঁটেল দো-আঁশ মাটি
০.০৫ – ০.২%
বেসিন ইরিগেশন: পানির বড় ¯্রােত প্রায় সমতল এবং ছোট জমিতে প্রয়োগ করা হয়, যা লেভি বা বাঁধ দ্বারা বেষ্টিত থাকে। প্রয়োগ করা পানি বেসিনে রাখা হয় যতক্ষণ না এটি মাটিতে মিশে না যায়। মাটির ধরন, ¯্রােতের আকার ও সেচের গভীরতা বেসিন এলাকা নির্ধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সেচের ধরন
ফসলের প্রকার
বর্ডার স্ট্রিপ মেথড
গম, শাক, পশুখাদ্য
ফারো মেথড
তুলা, আখ, আলু
বেসিন মেথড
বাগানের অন্যান্য গাছ
ট্রিকাল সেচপদ্ধতি
ট্রিকাল সেচ হলো সেচের সেই পদ্ধতি, যেখানে ছোট প্লাস্টিকের টিউবের মাধ্যমে প্রতিটি গাছের গোড়ায় পানি (এবং পুষ্টি) ক্রমাগত প্রয়োগ করা হয়; কার্যত মাটি থেকে সব বাষ্পীভবন দূর করে, মাটির ক্ষয়, পানির সঠিক ব্যবহার অত্যন্ত সুন্দরভাবে করা সম্ভব। পানির কম ব্যবহার জমির অনুর্বর হয়ে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব।
সাব সারফেস ইরিগেশন
কিছু কিছু এলাকায় মাটির অবস্থা উপসেচের জন্য অনুকূল। এর জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো হলো ফসলের মূলের কাদামাটিতে সেচ প্রদান। ৫০ থেকে ১০০ ফুট ব্যবধানে খাদের মধ্যে খেতে পানি সরবরাহ করা হয় এবং এই উচ্চতায় পানির প্রবাহ বজায় রাখার জন্য মাটিতে প্রবেশ করানো হয়। এতে অনুর্বর জায়গায়ও পানির সুষম সরবহার সম্ভব হয়। পানির কম সরবরাহ জমিতে পানির প্রবাহ কমিয়ে দেয় না। কারণ এতে পানির সরবরাহ জারি রাখা সম্ভব হয়। মাটির অতিরিক্ত লবণাক্ততা এড়াতে সেচের পানি ভালো মানের হতে হবে। উপ-সেচের ফলে পানির বাষ্পীভবন কমে যায় এবং ফসলের উপরিভাগের বর্জ্য হ্রাস পায় এবং এতে পরিশ্রম ও কম হয়।
মালচিং
মালচিং অর্থ হলো মাটি ভিজিয়ে দেওয়ার পর এর ওপর আচ্ছাদন। কোনো একটি বীজতলায় বৃষ্টি হলে বা এর ওপর সেচ দেওয়ার পর সেই মাটি কোনো কিছু দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেওয়ার মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার নাম মালচিং। মালচিং মূলত দুই প্রকার। প্রাকৃতিক মালচিং ও আর্টিফিসিয়াল মালচিং। কোনো একটি বীজতলায় যদি কোনো ইটের টুকরো থাকে বা কোনো বড় বস্তু থাকে, যার নিচে উল্টালেই দেখা যায় জায়গাটা ভেজা। সূর্যালোকের সংস্পর্শ না পেলে মাটি মূলত ভেজাই থাকে। সেখানে মাটির আর্দ্রতা বেশি থাকে। এভাবে বীজতলায় বড় বড় ইটের টুকরো রেখে যে মালচিং করা হয় বা নিজে থেকেই যা সংঘটিত হয়, সেটা হলো প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল মালচিং। আমাদের দেশে সাধারণত এভাবেই মালচিং করে আসছি আমরা হাজার বছর ধরে। অনেকেই কুলা অথবা এমন কোনো বস্তু দিয়ে মাটি ঢেকে দেয়, যাতে মাটি দ্রæত শুকিয়ে না যায়। আর এভাবেই মালচিং হয়ে আসছে।
আর্টিফিসিয়াল মালচিং
যে মালচিং প্রক্রিয়া আমরা নিজেরাই সংগঠিত করে থাকি, তা-ই হলো আর্টিফিসিয়াল মালচিং। এটি মূলত দুই প্রকার। জৈব আর্টিফিসিয়াল মালচিং ও অজৈব আর্টিফিসিয়াল মালচিং।
জৈব আর্টিফিসিয়াল মালচিং করা হয় মূলত জমিতে কলাপাতা বা খড় অথবা কচুরিপানা বিছিয়ে দিয়ে। এভাবে আমাদের দেশে অনেক আগে থেকে মালচিং চলে আসছে। আমরা কচুরিপানা বা কলাপাতা অথবা খড় ব্যবহার করে যে মালচিং করি বা আমাদের দেশের কৃষকেরা করে আসছেন, সেসব জিনিস কিছুদিন পরে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এগুলো মিশে যেতে যে সময় লাগে, সেই সময়ে ফসল বড় হয়ে যায়। আর এভাবে সেগুলো মিশে জৈব সারের ব্যবস্থাও করে ফেলে। ফলে এগুলো জমির জন্য বিশেষ কার্যকরী। প্রকৃতির জন্য ও বেশ স্বাস্থ্যকর।
অজৈব আর্টিফিসিয়াল মালচিং হলো অপচনশীল প্লাস্টিক দিয়ে যে মালচিং করা হয়, তাকেই বলা হয় অজৈব মালচিং। এটি মূলত করা হয় কালো প্লাস্টিক শিট মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে। এই শিট অনেক বছর ব্যবহার করা যায়। একবার মাটি ভিজিয়ে দিলে এটি অনেক দিন পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে পারে। মাটির সংস্পর্শে পচে যায় না। কিন্তু এটি থেকে দূষণ ছড়ায়। প্লাস্টিকের দূষণে দূষিত হয়ে পড়ে মাটি। তবে এই প্রক্রিয়া বেশ ধীরগতির বলে সেটা সাধারণত তেমন একটা চোখেই পড়ে না।
সুবিধা
সেচ সবসময় মাত্রার মধ্যে থাকা উচিত। কারণ অধিক পানি ফসলের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পানি জলাবদ্ধতার দিকে পরিচালিত করে, অঙ্কুরোদগম বাধাগ্রস্ত করে, লবণের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং উপড়ে যায়। কারণ শিকড় জমে থাকা পানি সহ্য করতে পারে না। এ জন্য আধুনিক প্রযুক্তিতে জমিতে এভাবে সেচ প্রদান করলে যেসব সুবিধা মিলবে সেগুলো হচ্ছে- ফলন ভালো হয়।
- আধুনিক প্রযুক্তিতে পানি পরিবহন অপচয় প্রায় শূন্য
- সঠিক ও পরিমিত পানি ব্যবহারে ফসলের ফলন বৃদ্ধি পায়
- সব সময় পানি বদ্ধ অবস্থায় থাকে না বলে মিথেন গ্যাস কম তৈরি হয়
- জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানোর ফলে মাটিতে বায়ু চলাচল সুগম হয় এবং গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়
- পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে সেচ এলাকা বৃদ্ধি ও সেচ খরচ কমানো সম্ভব
- অতি দ্রæত উৎস থেকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পানি পৌঁছে
- উঁচ-নিচু জমিতে সহজেই পানি বিতরণ সম্ভব
- জ্বালানি তেল খরচ সাশ্রয় করে কার্বন নিঃসরণ কমায়
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সংস্থান নিশ্চিত করা বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে যেন পরিবেশ বিপর্যয় না হয় সেদিকে অবশ্যই গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উপায় আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব সেচপদ্ধতি অনুসরণ। এ দেশের অসংখ্য কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীগণও সেচপদ্ধতির উন্নয়নে কাজ করছেন। কিন্তু প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে তা সম্প্রসারণ করা না গেলে তার সুফল মিলবে না। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গকে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তির কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপনের মতো সুবিধা প্রদান করতে হবে। তবেই আসবে কাক্স্ক্ষিত সাফল্য।
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৫২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০২৩