মনোমুগ্ধকর ভাসমান মসজিদ

প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের কথা শুনলেই যেন মনে হয় বিশাল এক বাগান শূন্যে ঝুলে বাতাসে দোল খাচ্ছে। ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। একই কথা খাটে মরক্কোর মনোমুগ্ধকর ভাসমান মসজিদটির ক্ষেত্রে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মসজিদটি পানিতে ভাসছে। আদৌতে কিন্তু তা নয়। এমনই চমক জাগানিয়া স্থাপত্যকর্ম এটি, যার নির্মাতা মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হাসান। অবস্থান মরক্কোর কাসাব্লঙ্কায়।

কাসাব্লঙ্কা শহরে অবস্থিত ভাসমান এ মসজিদটি মরক্কো ও আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মসজিদ। সারা বিশ্বের বৃহৎ মসজিদের মধ্যে এর অবস্থান সপ্তম। এই মসজিদে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ মিনারটির উচ্চতা ২১০ মিটার বা ৬৮৯ ফুট, যার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ১৯৯৩ সালে। মসজিদটির নকশাকার ফরাসি স্থপতি মিশেল পিনচিউ। মসজিদটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের বয়গিম কোম্পানি। মসজিদের মিনারটি উচ্চতা ৬০তলা বিল্ডিংয়ের সমান, যার চূড়ায় রয়েছে একটি লেজার লাইট, যা সাগরে চলাচলরত নাবিকদের সর্বদা পবিত্র কাবা শরিফের পথ নিদর্শন করে। মসজিদটির তিন ভাগের এক ভাগ আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর অবস্থান করায় এটিকে ভাসমান মসজিদ বলা হয়। দূরের কোনো জাহাজ থেকে দেখলে মনে হয় ঢেউয়ের বুকে যেন দুলছে মসজিদটি। আর মুসল্লিরা নামাজ পড়ছেন পানির ওপর দাঁড়িয়ে। মসজিদের মূল ভবনের কাচের সামনে দাঁড়ালে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের অবারিত জলরাশি।

গঠন প্রকৃতি ও অবস্থান
মসজিদটি মরক্কোর কাসাব্লঙ্কা শহরে অবস্থিত। এখানে একই সঙ্গে প্রায় দুই লাখ মুসল্লি নামাজ পড়তে পারে। মসজিদটির মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ৬৫ মিটার। মসজিদের ছাদটি প্রতি তিন মিনিট পরপর স্বয়ংক্রীয়ভাবে খুলে যায়। ফলে মসজিদের ভেতরে সহজেই প্রাকৃতিক আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবেশ করতে পারে। তবে বৃষ্টিতে ছাদটি খোলা হয় না। মসজিদটি আকৃতিতে এতই বড় যে এর মূল কাঠামোর ভেতরে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবাগকে অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া সম্ভব। 

মসজিদ অভ্যন্তর
মসজিদ অভ্যন্তর

২২ দশমিক ২৪ একর জায়গার ওপর অবস্থিত মসজিদের মূল ভবনের সঙ্গেই আছে লাইব্রেরি, কোরআন শিক্ষালয়, অজুখানা আর কনফারেন্স রুম। দুই হাজার ৫০০ পিলারের ওপর স্থাপিত এ মসজিদের ভেতরের পুরোটাই টাইলসে মোড়া। শুধু তা-ই নয়, কোথাও কোথাও আবার সোনার পাত দিয়ে মোড়া হয়েছে। মিহরাবের উচ্চতা দুই তলা ভবনের সমান। মসজিদ এলাকার আশপাশে রয়েছে ১২৪টি ঝরনা সঙ্গে ৫০টি ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি। মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালের আগস্টে। প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক ও কারুশিল্পীর দিনে দুই শিফটের শ্রমে প্রায় সাত বছরে শেষ হয় মসজিদটির নির্মাণকাজ। মসজিদটি উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৩ সালের ঈদে মিলাদুন্নবীতে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবসে। বিলাসবহুল এই মসজিদটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

মসজিদটির একাংশ নির্মিত হয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে। মসজিদের মূল কাঠামোর কিছু অংশ মাটিতে; বাকিটা সমুদ্রে নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের ভিত্তিকে পর্যাপ্ত দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব দিতে সমুদ্র থেকে প্রাকৃতিক পাথর সংগ্রহ করে নির্মাণে তা ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের মধ্যে রয়েছে একটি সুইমিংপুল। সমুদ্রের বিশাল আকৃতির ঢেউয়ের আঘাত থেকে মসজিদটিকে সুরক্ষা দিতে দুটি বৃহৎ আকৃতির ইৎবধশধিঃবৎ নির্মাণ করা হয়েছে। যার উচ্চতা প্রায় ১০ মিটার বা ৩৩ ফুট। মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে কোলাহলমুক্ত। সব সময় এতে ঢুকছে সমুদ্রের নির্মল ও সজীব। 

পেছন ফিরে দেখা
১৯৬১ সালে বাদশাহ পঞ্চম মোহাম্মদের মৃত্যুর পর শুরু হয় এ মসজিদের নির্মাণ-পরিকল্পনা। বাদশাহ পঞ্চম মোহাম্মদের মৃত্যুর পরে বাদশাহ দ্বিতীয় হাসান দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মানুরাগীদের অনুরোধ করেন যাতে করে বৃহৎ আকৃতির কোনো কিছুর নির্মাণ পরিকল্পনা তাঁর কাছে আনার জন্য, যা শুধু পরলোকগামী বাদশাহকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত হবে। ১৯৮০ সালে বাদশাহ দ্বিতীয় হাসানের জন্মদিন উদ্যাপনের সময় আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা ইচ্ছা পোষণ করেন যে কাসাব্লঙ্কা শহরে Landmark Monument নির্মাণের মাধ্যমে তাঁরা পরলোকগামী বাদশাহর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জানাবেন।

বাদশা দ্বিতীয় হাসানের প্রস্তাবিত মসজিদটি মরক্কো শহরের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী নির্মাণ প্রকল্পের অন্যতম। মসজিদটির নকশা প্রণয়ন করেন বাদশা হাসানের বিশ্বস্ত সহচর ফরাসি স্থপতি মিশেল গিনচিউ। আর নির্মাণে যুক্ত ছিল ফ্রান্সের বয়গিম কোম্পানির একদল দক্ষ প্রকৌশলীরা।

মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯৮৬ সালের ১২ জুলাই। এর নির্মাণকাজ চলে প্রায় সাত বছর ধরে। যদিও মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৮৯ সালের বাদশাহ হাসানের ৬০তম জন্মদিন উদ্যাপনের আগে। স্বল্প সময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার জন্য এক হাজার ৪০০ শ্রমিক দিনে ও এক হাজার ১০০ শ্রমিক রাতেও কাজ করেছে। এ ছাড়া ১০ হাজার শিল্পী ও কাঠমিস্ত্রি নিয়মিত কাজ করেছে শুধু মসজিদটির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য। সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ হলে ১৯৯৩ সালের ৩০ আগস্ট পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে মসজিদটির উদ্বোধন করা হয়।

অর্থায়ন
মসজিদটির নির্মাণব্যয় ধরা হয় ৫৮৫ মিলিয়ন ইউরো, যা ছিল মরক্কোর মতো দরিদ্র একটি দেশের জন্য দারুণ চিন্তার বিষয়। কিন্তু বাদশাহ হাসান এমন একটি মসজিদ নির্মাণের কথা ভাবলেন, যা আকার-আকৃতিতে হবে বিশ্বের দ্বিতীয়তম আর যার অবস্থান হবে পবিত্র মক্কার পরেই। তা ছাড়া এমন বিশাল নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য সরকারের কোষাগারে ছিল না যথেষ্ট অর্থ। মসজিদের নির্মাণে অধিকাংশ অর্থের জোগানদাতা সাধারণ মানুষ। মসজিদের নির্মাণকাজে প্রত্যেক মরোক্কান পরিবারের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ধরা হয়েছিল, যা পুলিশ দিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। মসজিদ নির্মাণে মোট ১২ মিলিয়ন মানুষ অনুদান দেয়। প্রত্যেক অনুদান প্রদানকারীকে দেওয়া হয় বিশেষ সনদ। সর্বনিম্ন অনুদানের পরিমাণ ছিল পাঁচ দিরহাম। সাধারণ মানুষের অনুদান ছাড়াও বড় বড় ব্যবসায়ী, আরব দেশসমূহ বিশেষত কুয়েত, সৌদি আরব ও পশ্চিমা দেশসমূহ নির্মাণকাজে বড় ধরনের লোন দিয়েছিল।

মসজিদের ডিজাইন
মসজিদের ডিজাইনে ইসলামিক স্থাপত্য শিল্পরীতি আর মরোক্কান নির্মাণ উপকরণের চমৎকার যুগলবন্দী ঘটেছে। এতেই মসজিদটি পরিণত হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্তে। মসজিদে পাথরে নির্মিত ডোম (Dome)-এর ধারণা নেওয়া হয়েছে বিশ্বখ্যাত সব মসজিদ থেকে।

মসজিদের শৈল্পিক কারুকার্য
মসজিদের শৈল্পিক কারুকার্য

ইবাদত ঘর
মসজিদের ইবাদত ঘরটি নিচতলায় অবস্থিত। কেন্দ্রীয় হলটি যান্ত্রিকভাবে সর্বদা গরম থাকে। এই হল থেকে আটলান্টিক মহাসাগরে পানির নিচের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যবলি দেখা যায়। মসজিদের ইবাদত ঘরটির সৌন্দর্যবর্ধনে মরক্কোর দেশসেরা ছয় হাজার রাজমিস্ত্রি ও কারুশিল্পীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। মসজিদের নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে মার্বেল পাথর  ও গ্রানাইট পাথর।

মসজিদের ইবাদত ঘরটি আয়তাকার নকশায় নির্মিত, যার দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার বা ৬৬০ ফুট আর প্রস্থ এক হাজার মিটার বা তিন হাজার ৩০০ ফুট। হলটি তিন হাজার ৩০০ ফুট। সম্পূর্ণ ইবাদত ঘরটি নানা ধরনের মহামূল্যবান কাচে সুসজ্জিত। ইবাদত ঘর বা হলের উভয় দিক কালো রঙের কাঠে আবৃত, যা শুধু মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। মসজিদের দরজাগুলো বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা সেনসর দ্বারা পরিচালিত। মসজিদের দরজাগুলো মার্বেলের ব্লক দ্বারা ঋধশব আর্চের মতো বিস্তৃত। মসজিদের পিলারগুলো ১৩ মিটার বা ৪৩ ফুট উঁচু। আকৃতি বর্গাকার।

মসজিদের ছাদটি Retractable হওয়ায় এটি দিনের সূর্যের আলোয় আলোকিত হয় আর রাতে ইবাদতকারীদের আকাশ ভরা তারার নিচে বসে ইবাদতের সুযোগ করে দেয়। ছাদের ওজন প্রায় এক হাজার ১০০ টন, যা মাত্র পাঁচ মিনিটেই খুলতে সক্ষম। ইবাদত হলটি প্রায় ৬০ মিটার বা ২১০ ফুট উঁচু, যার আয়তন প্রায় তিন হাজার ৪০০ বর্গমিটার বা ৩৭ হাজার বর্গফুট। এই হলের ছাদটি কাস্ট অ্যালুমিনিয়ামের টাইলসে আবৃত, যা প্রথাগত সিরামিক টাইলসের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী। সাধারণ টাইলসের তুলনায় যা শতকরা ৩৫ ভাগ হালকা। এ ছাড়া ইবাদত ঘরটি তথা হলটি উত্তর দিকের দেয়ালে অবস্থিত কাচের গেটে আলোকিত হয়।

প্রকৌশলী সনজিত সাহা
sonjit7022@gmail.com

প্রকাশকাল: বন্ধন ৫৩ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top