বাংলাদেশ ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের একটি ব-দ্বীপ। যার প্রধান অংশ (প্রায় ৮০ শতাংশ) দেশের পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা, মেঘনা নদী এবং তাদের শাখা-প্রশাখা দ্বারা বাহিত পলি জমে গঠিত। উপকূলবর্তী অঞ্চল প্রায় ২৯,০০০ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের মোট ভূখন্ডের প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের চাষযোগ্য জমির ৩০ শতাংশ এর অধিকের অবস্থান উপকূলবর্তী এলাকায়। উপকূলবর্তী এলাকার প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চলই লবণাক্ত। এ এলাকাতে কৃষিবিষয়ক জমির ব্যবহার খুব পারিপাট্যহীন। ফলে এ অঞ্চলে দেশের গড় ফলনের চেয়ে কম পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। এর প্রধান কারণ আর্দ্র মৌসুমের (জুন-অক্টোবর) সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এবং শুষ্ক মৌসুমে (নভেম্বর-মে) মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি। এই লবণাক্ততা বৃদ্ধির চরম সঙ্কটপূর্ণ দশাতে মাটির উর্বরতা অস্বাভাবিকহারে কমতে থাকে এবং তা বছর জুড়ে স্বাভাবিক ফসল উৎপাদনকে দারুণভাবে ব্যাহত করে।
আইলা, শ্রেণী-১ জলোচ্ছ্বাস, ২৫ মে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানা এক প্রলয়ঙ্করী বিভীষিকার নাম। প্রায় ২৩ লাখ মানুষ আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং এখনো উপদ্রুত অঞ্চল আইলার বিভীষিকা থেকে মুক্ত নয়।
২০১০ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা একটি গবেষণাধর্মী ক্লাস প্রজেক্ট করে, যার মূল লক্ষই ছিল এই জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য কিছু একটা করা। ২০০৯ সালের ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে ‘Design of Disaster Adaptive Rural settlement in the Coastal Area of Bangladesh’’ শিরোনামে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিয়ে একটি গবেষণাধর্মী ক্লাস প্রজেক্ট করানো হয়, যাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সমুদ্র উপকূলবর্তী সুন্দরবনবেষ্টিত এলাকাগুলোর মধ্যে হাউজিং বিশ্লেষণের একক হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামকে। এর লক্ষ্য ছিল সহজে প্রাপ্তিসাধ্য এবং ‘সামর্থের মধ্যে’ এমন সম্পদ সনাক্ত করে, সহনীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দেশীয় জ্ঞান ব্যবহারে মাধ্যমে জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি নির্মাণ করা। পাশপাশি পুরো এলাকার বসতির দুর্যোগ সহনশীল নকশা প্রণয়ন করা। গবেষণাধর্মী এ ক্লাস প্রজেক্টের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. আফরোজা পারভীন।

চিত্র : গাবুরা ইউনিয়নের এলজিইডি-এর অবকাঠামো ম্যাপ
সব শিক্ষার্থীরা কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে গাবুরা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে জরিপ চালায়। সার্ভের ৪টি গ্রুপ ৪টি প্রতিবেদন তৈরি করে-
১. ডেমোগ্রাফি সার্ভে
এই জরিপটি ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জীবন-জীবিকা, স্বাক্ষরতা প্রভৃতি সম্বন্ধে।
২. এক্সজিসটিং ল্যান্ড ইউজ প্যাটার্ন
এই জরিপে গাবুরার ভূমিরূপের বিভিন্ন ব্যবহার, যেমন- চাষযোগ্য জমি, চিংড়ি চাষের ঘের, বসতি, সামাজিক মিলনস্থান, হাটবাজার, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, খেয়াঘাট, খাল নেটওয়ার্ক ইত্যাদি সম্বন্ধে গভীর ধারনা পাওয়া যায়। এছাড়া এ জরিপের সাহায্যে গাবুরার নির্দিষ্ট কিছু অংশের ডিটেইল নকশা তৈরি করা হয় এবং তাতে বিদ্যমান বাড়িঘর, মসজিদ, স্কুল, পানির ট্যাঙ্ক, রাস্তা, খাল, বাঁধ, বাজার প্রভৃতির সূক্ষè নকশা তৈরি করা হয়।
৩. বিল্ড ইনভারনমেন্ট
কোন এলাকার বসতি কেমন, বসতিসমূহের প্যাটার্ন, তার আশপাশের গাছপালা, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির যোগাযোগ ব্যবস্থা, সামাজিক স্থান ইত্যাদি ইনফ্রা স্ট্রাকচার এবং প্রাকৃতিক উপাদানসমূহের জরিপ করা হয়।
৪. বিল্ড-ফর্ম অ্যানালাইসিস
স্থানীয় ঘরবাড়ি, জায়গা, তাদের আকার-প্রকার, তৈরির উপাদানসমূহ, কারিগরি ও নির্মাণ পদ্ধতি, উপাদানসমূহের মূল্য, নির্মাণ সময় এ জরিপের অন্তর্ভুক্ত।
তথ্যবহুল জরিপের পর দলগুলো পুনর্বিন্যাসিত হয়ে চারটি দলে
বিভক্ত হয়ে চারটি সম্ভাবনাময় নকশা প্রণয়ন করে। প্রত্যেকটি দলের এক ও অভিন্ন লক্ষ্য থাকলেও প্রত্যেক দলই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সমাধান দেয়ার চেষ্টা করে।
ডিজাইন প্রসেস
নকশা প্রণয়নের সময় ‘গাবুরার উন্নয়ন পরিকল্পনা’ শীর্ষক প্রকল্পকে কয়েকটি ধাপে বিভক্ত করা হয়। এতে ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিগুলো ছিল-
জরিপের তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক, কারিগরি ও পরিবেশগত বিষয়গুলো চিহ্নিত করা।
গাবুরার বিভিন্ন সম্ভবনাকে কাজে লাগানো এবং প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমাধান বের করা।
কিছু প্রধান ইস্যু চিহ্নিত করা, যেগুলো নিয়ে কাজ করা হবে। যেমন- ভূমি ব্যবস্থাপনা, লবণাক্ততা, দুর্বল অবকাঠামো, বাঁধ, বনায়ন প্রভৃতি।
পরিবেশের কথা লক্ষ্য রেখে কিছু স্ট্য্রাটেজি ঠিক করা যা অর্থনৈতিক দিকগুলোকে উন্মোচন করবে।
মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করা।
সবশেষে সেগুলোকে সবার কাছে তুলে ধরে বা উপস্থাপন করে সচেতনতা তৈরি করা এবং সমাধানগুলোকে কাজে লাগানো।
গ্রুপ-১ এর লক্ষ্য ছিল-
পুরো গাবুরা ইউনিয়নের একটি টেকসইম ভূমি-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা দেয়া এবং নকশা প্রণয়ন করা।
স্থানীয় উপকরণ ও স্থানীয় কারিগরির সুবিধার সাহায্যে জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি নির্মাণ করা।
দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগপরবর্তী সময়ের জন্য টেকসই বাসস্থান নির্মাণ করা।
দৃঢ় সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা।
কোন কোন স্থানে কি কি ধরনের ফসল চাষ করতে হবে, তা সম্পর্কে ধারণা দেয়া। এ ব্যাপারে গ্রুপটি সাহায্য নেয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের।
জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধের জন্য বাঁধ এবং সুইস গেট পুনর্নিমাণ ও সংস্কার-সংরক্ষণ এবং এর সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা।
ভূমির লবণাক্ততা প্রতিরোধ এবং কমানোর জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা তৈরি করা।
পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য প্রত্যেকটি কমিউনিটিতে একটি করে ফিল্টার ট্যাঙ্ক স্থাপন এবং প্রত্যেকটি বাড়িতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা। এছাড়া বর্ষা মৌসুমের পানি পুকুর ও কুয়ায় ধরে রাখার জন্য প্রত্যেকটি বাড়িতে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে পুকুর-জলা খনন বা সংস্কার করা।
ভঙ্গুর প্রবণ এলাকা সনাক্ত করে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বাঁধ এবং ওইসব এলাকা সংরক্ষণ করা এবং সাথে সাথে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া। সেক্ষেত্রে নিম, শিশু, বাবলা, কেওড়া, নারিকেল, খলসি, ঝোপজাতীয় অড়হর প্রভৃতি গাছের চারা সহজলভ্য এবং কার্যকরী। এছাড়া সামাজিক বনায়নের সাথে সাথে মৌমাছি চাষও ব্যাপক লাভজনক, যা গাবুরার অধিবাসীদের অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা সাহায্য করতে পারে।
ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি

ধাপ-১
বাঁধ সংস্কার।
ভঙ্গুরপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে নদীরপাড় এলাকায় পলিকরণ/সেডিমেন্টেশন।
নদীর পানির মাধ্যমে পুরো গাবুরায় পলি জমাকরণ (সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে)।
বাঁধ এবং চিহ্নিত এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনায়ন।
কৃষিকাজের উন্নয়নের বাঁধাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান সবার কাছে পৌঁছে দেয়া।
উপকূলীয় লবণাক্ত মাটি ব্যবস্থাপনা
বাঁধ সংরক্ষণ।
কৃষিভূমি উঁচুকরণ ও নিচুজমি ভরাটকরণ।

কৃষিকাজের জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা।
খরিফ ধানবীজ সরবরাহ করা। যেমন- বারি-২৩, বারি-৩০, বারি-৪০, বারি-৪১ ধান।
শীতকালে রবিশস্য চাষ উৎসাহিত করা।
শীত ও গ্রীষ্মকালে ফসলি জমিগুলোকে যথাসম্ভব ঢেকে রাখা, যাতে আর্দ্রতায় নষ্ট না হয়ে যায়।
জমিতে পটাস সার ব্যবহার করা।
পানি নিষ্কাশন সুগম করা।
জলবায়ু পরিবর্তনরোধে সক্রিয় অংশগ্রহণ। যেমন- সামাজিক বনায়ন, পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষিকাজে সহায়তা প্রদান করে সুন্দরবনকে রক্ষা করা।

ধাপ-২
কৃষিজমি উঁচু করা এবং চারপাশে পোল্ডারিং করা।
নদীর ঘাট সংস্কার এবং ঘাট থেকে ঘাটে নৌ-নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করা।
ভূমিরূপের ব্যবহার নির্দিষ্ট করে দেয়া।

ধাপ-৩
গাবুরার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার।
বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নয়ন।
প্রত্যেক ওয়ার্ডে একটি করে সাইক্লোন-শেল্টার কাম প্রাইমারি স্কুল নির্মাণ।

চিত্র : বাঁধ নির্মাণ পদ্ধতি ও চিত্র : গাবুরার একাংশের (৭নং ওয়ার্ড) প্রস্তাবিত নকশা।
চিত্র : গাবুরার ৭নং ওয়ার্ডে প্রস্তাবিত সাইক্লোন শেল্টার।
সবশেষে গ্রুপটি থাকার ঘরের বিশদ নকশা তৈরি করে যাতে ব্যবহার করা হবে স্থানীয় প্রযুক্তি, স্থানীয় সহজলভ্য উপাদান এবং স্থানীয় কারিগরি সুবিধা। গোলপাতা অথবা টিনের চাল, বাঁশের চাটাই বা কাঠের তক্তার বেড়া, গরানের ছিটা, বাঁশ কিংবা কাঠের খুঁটি ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রুপটি ৪ ধরনের আয়ের কথা বিবেচনা করে ৪টি মডিউল ডিজাইন করে।

এক একটি বাড়ি, যাতে এক একটি খামার বা অর্থনৈতিক উৎপাদনের উৎস হিসেবে গণ্য করা যায়, নকশা তৈরি করার সময় গ্রুপ সদস্যরা তা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। প্রত্যেকটি বাড়িতে সবজির খামার, হাঁসমুরগি পালনের সুব্যবস্থা, পানীয় জলের জন্যে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা, দুর্যোগ-প্রতিরোধী অবকাঠামো ইত্যাদি খুব সুলভে সামর্থের মধ্যে ধাপে ধাপে দেয়া হবে যাতে এই জলবায়ু শরণার্থীরা সহজেই তৈরি করতে পারে, তার ধাপগুলোও গ্রুপটি নির্দিষ্ট করে।
গ্রুপটি তাদের এই শ্রম শুধু ক্লাস প্রজেক্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে, তার কোনো মানে হয় না। এ সীমাবদ্ধ জ্ঞান যদি কখনো অসহায় এসব লোকদের জন্যে কাজে লাগানো যায়, তবেইনা তাদের শ্রমের সার্থকতা। তবে এর জন্যে প্রয়োজন সব মহলের সদিচ্ছা। জলবায়ু পরিবর্তন যদিও একটি সার্বিক সমস্যা, তবুও এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ব্যক্তিগত সব মহল থেকেই আসতে হবে।
গ্রুপ-১ এর সদস্যরা-
জেড, এইচ, এম, মঞ্জুর মোর্শেদ তূর্য (০৬০১১৪)
ফেরদৌস আহমেদ অপু (০৬০১০১)
লিপিকা রায় লোপা (০৬০১২১)
নওশিন নুসরাত (০৬০১২৮)
উম্মামা মাহজাবিন শশী (০৬০১৩৭)
মুত্তাসিফ হাসান দীপ (০৫০১০৩)
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৫ তম সংখ্যা, মে ২০১২