মাত্র ক’দিন পরেই ঈদ। সবার মধ্যেই উৎসবের আমেজ। পুরান ঢাকা এলাকায় মানুষের বাড়ি ফেরা নিয়ে ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। শেকড়ের টানে বাড়ি ফেরার তৃপ্তিটা সবার চোখে-মুখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। ঘরমুখী মানুষের এই হন্তদন্ত ভাব দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে পৌঁছলাম কেরানীগঞ্জে। বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘সফল যারা কেমন তারা’ পর্বের সফল ব্যবসায়ীর খোঁজেই এবার হাজির হয়েছি ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী তীরবর্তী কালীগঞ্জের চুনকুটিয়াতে। আকিজ সিমেন্টের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা খন্দকার আরিফুর রহমানকে সাথে নিয়ে গেলাম বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ রিয়াজ উদ্দিন আদু সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ তিনি। আমাদের স্বাগত জানালেন। কথা হলো সফল এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে; জানলাম তার জীবনের সফলতার গল্পগাথা।
এলাকায় তিনি আদু ভাই নামেই পরিচিত। জন্ম ১৯৬৭ সালে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার পূর্বপাড়ায়। পিতার নাম মৃত একরাম উদ্দিন, মা জাহানারা বেগম। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে সবার ছোট। ছোট বলে আদরটাও ছিল বেশি। শাঁখারী বাজারস্থ পগজ স্কুলে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। ছাত্র ভালো থাকলে কী হবে! মাথার ভেতর ছিল খেলার পোকা। আর তাই খেলাপাগল এ মানুষটি পড়ালেখা খুব বেশি করতে পারেননি। ১৯৯৯ সালে ব্যবসায়িক জীবনের শুরু। বাবা ছিলেন শাড়ির ব্যবসায়ী। সদরঘাট শরীফ মার্কেটে তিনি ব্যবসা করতেন। বেশ বড় ব্যবসা ছিল কিন্তু ব্যবসাতে খুব সফল হতে পারেননি। সঠিক দেখভালের অভাবেই এমনটি হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি ব্যবসায় জড়িয়ে যান। চুনকুটি, কালীগঞ্জে একটি দোকান ক্রয় করেন। নাম রাখেন বিসমিল্লাহ স্টিল স্টোর। গ্রিলের সামগ্রী দিয়েই ব্যবসায়ের হাতে খড়ি। কিন্তু খেলাধুলার মতো ব্যবসা এত সহজ বিষয় ছিল না। তবে বাবার ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। তার পরও ব্যবসায় ক্ষতি এড়াতে পারেননি। বাকিতে মালামাল বিক্রি করাতেই এ সমস্যা হয়। তবে থেমে থাকেননি। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা ধার নেন। নতুনভাবে শুরু করেন রডের ব্যবসা। ধীরে ধীরে ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেন সিমেন্টের ব্যবসা। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে এখানেই শেষ নয়। ব্যবসা দাঁড় করাতে করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম। শুরুতে দোকানে ছিল মাত্র ১ জন কর্মী। সেই ঘাটতি মেটাতে নিজে দোকান কর্মীর সাথে কাজ করেছেন। কখনো কখনো মাল বহনেও সাহায্য করেছেন। এই পরিশ্রম ও সফলতা লাভের মনোভাবেই বাড়তে থাকে তার ব্যবসায়ের পরিসর। বর্তমানে চুনকুটি বাজারে তার রয়েছে একটি গোডাউনসহ ৪টি দোকান। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, কোনো দোকানেই ম্যানেজার নেই। নিজেই সব কিছু ম্যানেজ করেন। সীমিত লাভে পণ্য সরবরাহ করেন। ওজনেও সঠিক মাপ দেন। অনেক কষ্টে গড়া ব্যবসাকে তিনি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেন। খুচরা ও পাইকারি দু’ভাবেই ব্যবসা করেন। সিমেন্ট বিক্রিতে ফ্লাই অ্যাশমুক্ত সিমেন্ট ব্যবহারে ক্রেতাকে অবহিত ও উৎসাহিত করেন, যা সাধারণ ক্রেতারা এতদিন বুঝত না। এলাকাতে একজন ভালো ব্যবসায়ী ও সৎ মানুষ হিসেবে তার বেশ সুনাম রয়েছে। এ সবই তার ব্যবসা পরিচালনার অন্যতম মূলধন।
২০০৫ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী তাহসিনা আক্তার লিনা। ব্যবসায়ে তিনি তাকে উৎসাহ দেন। দুটি সন্তান নিয়ে তাদের সুখের সংসার। বড় ছেলে রিয়ন উদ্দিন রানা শিশু শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। ছোট ছেলে রিমন উদ্দিন আদর। ব্যবসায়ের ব্যস্ততার জন্য তাদের বেশি সময় দিতে পারেন না। এতে পরিবারের সবাই কখনো কখনো তার উপর রাগও করেন। কিন্তু কষ্টে গড়া ব্যবসাটাকে অবহেলা করতে পারেন না। তবে মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর ছেলেদের নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরতে যান।
ব্যবসায়িক পরিচয়ের পাশাপাশি একজন কৃতী ফুটবলার হিসেবেই এলাকায় পরিচিত। খেলতেন স্বনামধন্য ক্লাব ভিক্টোরিয়াতে। দেশে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত ১ম বিভাগ (ফার্স্ট ডিভিশন) ফুটবল প্রতিযোগিতায় ক্লাবটির হয়ে খেলেছেন বেশ ক’বার। এর আগে মালিবাগ ক্লাবের পক্ষে খেলতেন ২য় বিভাগে। সেখানে তৎকালীন কোচ লাভলুুর হাত ধরেই পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়াতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন দলের রাইট উইঙ্গার। খেলাতে অল্প সময়েই বেশ সুনাম অর্জন করেন।
হায়ারেও খেলেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু মুন্সীগঞ্জে গোল্ডকাপ খেলতে গিয়ে পায়ে গুরুতর আঘাত পাওয়ার পর শেষ হয় খেলাধুলার অধ্যায়। শুধু ফুটবলই নয় ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন খেলা করেই বেড়ে উঠেছেন। হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কাবাডি, ঘুড়ি ওড়ানো, লাটিমসহ প্রায় সব ধরনের খেলাই খেলেছেন জীবনে। লাটিম খেলায় ছিলেন ওস্তাদ। অন্যের লাটিম ভাঙতে তার জুড়ি ছিল না। ঘুড়ি ওড়ানোতেও কম যাননি। ধরাশায়ী করতেন আকাশে ওড়া অন্যদের ঘুড়িকে। তবে সবচেয়ে পছন্দের খেলা ফুটবল। স্কুলে একজন ভালো খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম ছিল। আন্তঃস্কুল ফুটবলে অংশ নিতেন সব সময়। দৌড় প্রতিযোগিতাতেও তাকে রোখার মতো কেউ ছিল না। সব সময় ১ম স্থানটাই দখল করতেন। এমনও হয়েছে স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক তাকে পরীক্ষার হল থেকে ডেকে খেলতে নিয়ে গেছেন।

শৌখিন ও সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ সফল এ ব্যবসায়ী। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তাকে খুব একটা পরিপাটি থাকতে দেখা না গেলেও বাহারি পোশাকের ব্যাপারে রয়েছে চরম আগ্রহ। সংগ্রহে আছে অসংখ্য পোশাক। কোথাও বেড়াতে গেলে বা অবসর সময়ে তিনি এগুলো ব্যবহার করেন। ব্লেজার, পাঞ্জাবি, শার্ট, গেঞ্জি ও জুতার বেশ সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে তার। এগুলো সংগ্রহ ও ব্যবহার করা রীতিমতো তার শখ। তিনি বেশ ভোজনরসিক। পুরান ঢাকার মানুষ বলেই হয়তোবা তার এই ভোজনপ্রিয়তা। গরুর মাংস সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। এলাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোও তার কাছে খুব প্রিয়।
ব্যবসাই এখন তার ধ্যানজ্ঞান। পাশাপাশি তিনি চুনকুটিয়া, কালীগঞ্জ বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। বিগত তিন বছর যাবত এই পদে আছেন। এ ছাড়াও কালীগঞ্জ কবরস্থান কমিটির একজন সদস্য। বিভিন্ন সামাজিক কাজেও বিভিন্ন সময়ে অংশ নেন। দরিদ্র মানুষকে নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। তবে তিনি গরিব ও অসহায় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে মেয়ে বিবাহ দিতে সাহায্য করতে চেষ্টা করেন।
তিনি মনে করেন ব্যবসাতে সুনাম বড় সম্পদ। জবানও (প্রতিশ্রুতি) অনেক বড় জিনিস। বাকি ব্যবসা তিনি পছন্দ করেন না। তার মতে, বাকিই ব্যবসায়ের সবচেয়ে ক্ষতির কারণ, যা ব্যবসাকে পঙ্গু করে দেয়। তা ছাড়া ব্যবসা একটি দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া যেখানে হুট করে সফলতা পাওয়া যায় না। এখানে সততা না থাকলে হয়তো ব্যবসা বড় হবে কিন্তু তা রক্ষা করা যাবে না। বাজারে ভালো খারাপ সব ধরনের পণ্য রয়েছে। ক্রেতাদের ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার আহ্বান, তারা যেন নির্মাণকার্যে ভালো পণ্য ব্যবহার করে।
তবে তার জীবনে এই সফলতার পেছনে যার সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে তিনি তার মা। চরম মা ভক্ত এই মানুষটি তার যাবতীয় প্রেরণার উৎস মনে করেন তার মাকে। মাকে যেমন ভালোবাসেন তেমনি তার দেখাশোনাও করেন। তবে ভাইয়েরাও তাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন। নিজ চেষ্টা, পরিশ্রম এবং তার মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণাতেই আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন তিনি। কখনো কারও সাথে কথার বরখেলাপ করেন না। এখন আর আগের মতো খেলাধুলা করেন না। তবে খেলা দেখেন। টিভিতে খেলা হলেই রাত জেগে তা উপভোগ করেন। বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি আর্জেন্টিনার সমর্থক। মেসির খেলা তার খুবই ভালো লাগে।
ব্যবসায়ে সফলতা লাভের কিছু কথা বললেন সফল এই ব্যবসায়ী। তার মতে, ব্যবসাকে সম্মান করতে হবে। সৎ ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করার ব্যাপারেও তাগিদ দেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষাও সফলতা লাভের মূলমন্ত্র হতে পারে বলে তার অভিমত। শুধু বড় ব্যবসায়ী হলেই চলবে না সুনাম থাকতে হবে। মা-বাবাকে ভালোবাসতে এবং তাদের সেবা করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কেননা মা-বাবার দোয়াই সন্তানের জীবনে সবচেয়ে বড় পাথেয়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২