পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক
রাজধানীতে সমন্বিত ও পরিকল্পনামাফিক গণপরিবহনব্যবস্থা চালু না করলে যানজট থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না

বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছর উদযাপন করছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্য অনেক দেশের রোল মডেল। সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ এত দিন পিছিয়ে ছিল মেগা প্রকল্পে। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেই যখন চলছে মেট্রোরেল, গাড়ি ছুটছে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে, সেখানে এত দিন পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ও সাহসী পদক্ষেপের কারণে সামনের বছরগুলোতে একাধিক মেগা প্রজেক্ট পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

উত্তাল পদ্মার বুকে গড়ে উঠছে স্বপ্নের সেতু। রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। যানজটে নাকাল নগরী ভরসা পাচ্ছে মেট্রোরেলে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীতে টানেল, রামপাল ও মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় যোগাযোগের জন্য চার লেনের সড়ক আর যমুনায় আলাদা রেল সেতুর মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে গড়ে উঠছে নতুন এক বাংলাদেশ। এর মধ্যে মেট্রোরেলের একাংশের কাজ শেষের দিকে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও চলবে মেট্রোরেল। পদ্মা সেতু আছে উদ্বোধনের অপেক্ষায়। জোরগতিতে এগোচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ।

সমাপ্তির পথে থাকা মেগা প্রজেক্টগুলোর আদ্যোপান্ত নিয়ে ‘বন্ধন’-এর সঙ্গে কথা বলেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু

বন্ধন: পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসের মতো মেগা প্রকল্প রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় কী ধরনের সুফল ও সমস্যা দেখা দিতে পারে?
ড. মো. সামছুল হক: দুই ধরনের মেগা প্রকল্প প্রায় শেষের দিকে। একটি গণপরিবহন সম্পর্কিত, আরেকটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যানবাহনের গতিশীলতা বাড়াতে করা হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে দ্রæতই বাইরের জেলা থেকে ঢাকায় প্রবেশ করা যাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে আমাদের নিবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। ফেরিভিত্তিক যোগাযোগ ছিল। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে চমৎকার একটা সংযোগ স্থাপিত হবে। দুইটার দুই প্রেক্ষাপট। মেট্র্রোরেল গণপরিবহনের সর্বোচ্চ বৈচিত্র্য আনবে। তার নিচে আছে বিআরটি, তার নিচে বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ, তার নিচে অর্ডিনারি বাস। গণপরিবহনের একটা বাস্তুতন্ত্র তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের অবকাঠামো পিক আওয়ারে ভালো সমাধান দেয়। দেরিতে হলেও এই কাজ শুরু হয়েছে। মেট্রোরেলের সেবাগ্রহীতাদের যানজটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না। নিচে যানজট হোক অথবা বর্ষায় ডুবে যাক, যা-ই হোক না কেন, তারা নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাবে সঠিক সময়ে। মেট্রোরেল যাত্রীদের চলাচলের স্বাধীনতা দেবে। যত দিন মেট্রোরেল থাকবে, তত দিন মিনিট সেকেন্ড ধরে আমরা যেতে পারব। রাজধানীর গণপরিবহনে নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটছে।

দৃশ্যমান পদ্মা বহুমুখী সেতু (ছবি: হাসিন রেজা চঞ্চল)

যদিও মেট্রো প্রকল্প সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। এত বড় বিনিয়োগ থেকে আমাদের আরও বেশি কিছু পাওয়ার সুযোগ ছিল। সমন্বিত হলে রাজধানী অনুভূমিকভাবে সম্প্রসারণ না হয়ে, উল্লম্বভাবে সম্প্রসারিত হতো। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে ঢাকার ভেতরে একটা ভালো কানেক্টিভিটি তৈরি হবে। ঢাকার যানজট, দূরপাল্লার যান, যেগুলো ঢাকায় প্রবেশ করে, সেগুলো পৃথক করবে। সাভার এলাকায় যত শিল্পকারখানা আছে, সেখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংযোগ স্থাপন ও ঢাকার ভেতরে যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। পদ্মা সেতুটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগে হবে মাইলফলক। সেতু না থাকায় ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে গিয়েছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে বাধা ছিল, পদ্মা সেতু হওয়ার পরে সেটা দূর হবে। রাজধানীর সঙ্গে সংযোগ ও আঞ্চলিক যোগাযোগে এই সেতু যোগ করবে নতুন মাত্রা।

বন্ধন: মেগা প্রকল্পগুলো আর্থসামাজিক উন্নয়নে কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. মো. সামছুল হক: যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে এর বাইরে মানবসম্পদ উন্নয়ন, উৎপাদন বাড়িয়ে এই প্রকল্পগুলো আমাদের অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করবে। যানজটের কারণে বা দূরত্বের কারণে কর্মঘণ্টা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে কাজ করার প্রোডাক্টিভিটি। মেট্রো করিডরে যাঁরা থাকবেন, তাঁরা একটু স্বস্তি পাবেন যাতায়াতে। টাইমভ্যালু ক্যাপচার করে এখানে উপযোগিতা বাড়ানো যাবে। এটা প্রোডাক্টেশনে এলে অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। যানজটের কারণে যে কর্মঘণ্টা আমাদের নষ্ট হয় সেটা বাঁচবে। যেই সময়টা বাঁচবে, সেটা ভ্যালু হিসেবে অ্যাড হবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের শিল্প-কলকারখানায় সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। দূরত্বের কারণে যাঁরা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা শিপিং টাইম ও ট্রান্সপোর্ট নিয়ে অনেক ভুগে থাকেন। অনেক সময় তাঁদের বড় আর্থিক ক্ষতিও হয়। এই এক্সপ্রেসওয়ে ট্র্যাভেল টাইম কমাবে। ব্যবসায়ীদের স্বাচ্ছন্দ্য দেবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন করে কর্মচাঞ্চল্য ফিরবে। ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সেতু যেভাবে ভূমিকা রেখেছিল, পদ্মা সেতু আরও দ্রুত ভূমিকা রাখবে। কারণ এটা ঢাকার অনেক কাছাকাছি, মোংলা পোর্টেও এর একটা অবকাঠামো আছে। যোগাযোগ, আঞ্চলিক উন্নয়নের পাশাপাশি রিজিওনাল কানেক্টিভিটিতে এটা একটা ব্যাকবোন। আন্তবাণিজ্য সম্প্রসারণেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বন্ধন: এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু আছে?
ড. মো. সামছুল হক: রক্ষণাবেক্ষণের সক্ষমতায় আমরা অত্যন্ত সেকেলে আছি। আমরা উন্নয়ন করি ভুলে যাই, পুনঃ উন্নয়ন করি। এই উন্নয়ন বড় কথা নয়। প্রকল্পগুলোকে টেকসইভাবে ব্যবহার করতে হলে, রক্ষণাবেক্ষণ হতে হবে একদম ইন্টিগ্রাল পার্ট অব দ্য সিস্টেম। সেখানে আমাদের দুর্বলতা আছে। এলিভেটেডে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৩০ বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যেটা পিপিপি প্রকল্পের সবচেয়ে ভালো দিক। উন্নয়ন প্রকল্পে পিপিপি যারা অপারেট করে, তারা মানদন্ডটা ধরে রাখতে পারে। কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে আমরা এখনই রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি। দুর্ঘটনায় ঢাকা-মাওয়া সড়কের ডব্লিউ বিম, ডিভাইডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না। অনেক সরঞ্জাম সড়কে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে সড়কটার দেখভালের কেউ নেই। এটাই হলো বাস্তবতা। আমরা উন্নয়ন করি, আড়ম্বর করে ফিতা কাটি তারপর আর কেউ নজর দিই না। সেই জায়গায় আমাদের সক্ষমতা ও দায়িত্বশীল আচরণ করার মতো সিস্টেম থাকতে হবে।

বহুল কাঙ্খিত মেট্রোরেল প্রকল্প

বন্ধন: কবে নাগাদ প্রকল্পগুলোর সুফল পাওয়া যাবে?
ড. মো. সামছুল হক: প্রকল্পগুলো শেষ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাবে। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা সুদূরপ্রসারী। পদ্মা ব্রিজের ক্ষেত্রে আমরা বলব, রিং রোড না করা পর্যন্ত এর সুফল অনেকাংশে পাওয়া যাবে না। পদ্মা সেতু পার করে যে সময় আমরা বাঁচাব, সেটা ঢাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে উপযোগিতা হারাবে। মানুষের কর্মঘণ্টা বাঁচবে মেট্রেরেলে। মেট্রোভিত্তিক উন্নয়নে সুফল ভোগ করতে হলে প্রস্তাবিত গণপরিবহন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে না পারলে এর সুফল ভোগ করা যাবে না।

বন্ধন: নির্মাণব্যয় ও কাজের দীর্ঘসূত্রতা কি অস্বস্তি তৈরি করছে?
ড. মো. সামছুল হক: ভালো অস্বস্তি তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডের তুলনায় প্রতি কিলোমিটার মেট্রো, এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা পদ্মা সেতুর রেলওয়ের খরচ অনেক বেশি। খরচ প্রথমে যৌক্তিক থাকে কিন্তু সময়ক্ষেপণের কারণে খরচ বেড়ে যায়। কাজের পরিমাণ বা দৈর্ঘ্য বাড়ে না। যখন কাজটা শেষ হয়, তখন দেখা যায় প্রকল্পটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফিজিবিলিটি স্টাডি যখন করা হয়, তখন পার কিলোমিটার খরচটা মানানসই থাকে। কিন্তু কাজে নামার পর দেখা যায় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। সেগুলো সমাধান করতে গিয়ে সময় ও খরচ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত খরচটা যখন পার কিলোমিটারে এসে পড়ে, তখন দেখা যায় খরচটা পার্শ্ব¦বর্তী দেশের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। এমনকি ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় খরচ অত্যন্ত অস্বস্তিকর। আসল ঘটনা না জেনে অনেকেই ভাবেন এখানে বিরাট দুর্নীতি হয়েছে।

বন্ধন: প্রকল্পগুলো প্রাণ পরিবেশ রক্ষার্থে কতটা উপযোগী বা পরিবেশবান্ধব?
ড. মো. সামছুল হক: পদ্মায় বড় বড় স্প্যান তৈরি করা হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এসবের ফলে ম্যাটারিয়ালস অনেক কম লাগছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চিকন পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। স্ট্রেন্থ ও ডিউরিবিলটি বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। দৃষ্টিকটু না হওয়ায় এটা পরিবেশবান্ধব হয়েছে।

মেট্রোর ক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এটা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছুঁয়ে গেছে। টিএসসি, বাংলা একাডেমি, কার্জন হল আবার হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাবে। এটাও অনেক শব্দ তৈরি করতে পারে। শব্দনিরোধক জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয় মেট্রোতে। পরিবেশবান্ধব সব ধরনের ফিচার প্রকল্পগুলো এর ফিচারে আছে। এখন ব্যবহারকালীন পরিবেশের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশেও প্রচুর বসতি আছে, এখানেও শব্দদূষণের ব্যাপার আছে। রাতে যখন অনেক গাড়ি চলাচল করবে, তখন শব্দদূষণ কিন্তু ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাবে। এ কারণে নির্মাণের পরে শব্দ কীভাবে কমানো যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অতিরিক্ত শব্দ কমাতে যদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে প্রকল্পগুলো পরিবেশ ও প্রতিকূলের জন্য উপযোগী হবে।

বন্ধন: কী ধরনের ডিজাইন ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো বাস্তবসম্মত বা টেকসই কি?
ড. মো. সামছুল হক: পদ্মা ব্রিজে আধুনিকতা আছে। এটাকে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। আমাদের মেট্রো প্রজেক্ট সুন্দর হয়েছে। আমাদের নির্মাণে নান্দনিকতার অভাব আছে। সিগনেচার কোনো স্থাপনা আমাদের নেই। যখন অস্ট্রেলিয়ার কথা মনে করি, তখন সিডনি হারবার ব্রিজ চোখে ভাসে। একটা ব্রিজ উৎসব, পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। লন্ডন ব্রিজ, ব্রুকলিন ব্রিজ কিংবা কাছেই কলকাতার হাওড়া ব্রিজ, এগুলোর কথা মানুষ মুখে মুখে বলে। এমন ধরনের আইকনিক কোনো ব্রিজ নেই আমাদের। ঢাকার আশপাশে এত ব্রিজ আছে, সবই অত্যন্ত ট্র্যাডিশনাল। এখনো সিগনেচার ব্রিজ হয়ে উঠতে পারেনি। সেই ধরনের স্থাপনা থাকলে আমরা ১৬ ডিসেম্বর কিংবা বর্ষবরণ হয়তো ব্রিজের কাছাকাছি করতে পারতাম। অনেক দেশেই বিজয় দিবস বা বর্ষবরণ ব্রিজের কাছাকাছি আয়োজন করা হয়। মানুষ আতশবাজি ফোটানো দেখে, নদীর পাড়ে উৎসব দেখে।

প্রকল্প নির্মাণে নাগরিক ভোগান্তি (ছবি: হাসিন রেজা চঞ্চল)

এখন যে মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে আমি কিছুটা নান্দিনকতা, ব্যতিক্রম পাই। অন্য যত ব্রিজ আছে, সেগুলো অত্যন্ত সেকেলে মনে হয়, দেখে চোখ আটকায় না। এদিকে নজর দিতে হবে। আশপাশের দেশগুলোতে যখন এমন ধরনের স্থাপনা করে একদম ইউনিক কিছু করে। ভিয়েতনামের দৃষ্টিনন্দন ড্রাগন ব্রিজ সব ট্যুরিস্ট দেখতে যায়। একটা ব্রিজকে যখন ড্রাগনের ফর্ম দিতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে, সেখানকার মানুষ আসলে শুধু ব্রিজ বানাচ্ছে না, অর্গানিকভাবে পাবলিক স্পেস তৈরি করে ফেলছে। এই জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। চলমান মেগা প্রজেক্টগুলোতে কিছু না কিছু ব্যতিক্রম আছে।

বন্ধন: বলা হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি নেক্সট বিগ থিং? মানববাহী ড্রোন বা ফ্লাইং ট্যাক্সির পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই সেতু কিংবা মেট্রোরেল কী সময়োপযোগী?
ড. মো. সামছুল হক: মেট্রো সব সময়ই সময়োপযোগী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে উন্নত দেশগুলো নগর রেল ও গতিভিত্তিক রেলে বিনিয়োগ করছে। চায়না একসময় প্রচুর সড়ক বানাত। এখন তারা উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন করছে। কারণ, সড়ক টেকসই না, দূষণ বাড়ায়, জ্বালানি খরচ করে।

আমরা যখন শুরু করেছি তখন শহর অনেক পরিণত। এখানে কাজ করতে গিয়ে আমাদের ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। অন্য যেসব জায়গা এখন গ্রো করছে, সেখানে মেট্রো করলে তা টেকসই হবে। ঢাকা এত বেশি অ্যানালগ, এত বিশৃঙ্খলা এখানে যে আধুনিক বা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। একটা ডিজিটাল সিগন্যাল আমরা চালু করতে পারিনি। যেখানে এগুলো হয়, সেখানকার নগর অনেক সুশৃঙ্খল। ট্রাফিক অনেক নিয়ন্ত্রিত। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সামর্থ্য দেখাতে পারে।

বন্ধন: তাহলে কি এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেরিতে শুরু হলো?
ড. মো. সামছুল হক: অনেক দেরিতে শুরু হলো। ২০২২-২৩ সালে আমরা যখন মেট্রো পেতে যাচ্ছি, আমাদের আশপাশের অনেক দেশই এখন একাধিক মেট্রোরেল উপভোগ করছে। আমাদের পরেও মেট্রোর কাজ শুরু করে অনেকেই মেট্রো উপভোগ করছে। এশিয়ার অনেক দেশেই এক-দুই দশক আগে মেট্রোটা করে ফেলেছে। বড় অবকাঠামোর যখন সুযোগ থাকে, সেটা কাজে না লাগালে পরবর্তী সময়ে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়। আমাদের মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো সমন্বিত হয়নি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রাস্তায় ও ফুটপাতে। স্টেশনভিত্তিক যে সুন্দর অঞ্চল পরিকল্পনা করা যেত, সেটাও এখন আর করা যাচ্ছে না। কারণ শহরে অনেক বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হয়ে রয়েছে। সময়ের কাজ সময়ে না করায় আমাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে।

প্রায় ১.৫ হাজার কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে ভিয়েতনাম করে ফেলেছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছরে। পাকিস্তানও ৪ হাজার কিলোমিটারের ১৬টা এক্সপ্রেসওয়ে/মোটরওয়ে করে ফেলেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করেছে ৪টি। আমরা শুরু করেছি অনেক দেরিতে। পদ্মা সেতু আমাদের অনেক আগেই শুরু করা দরকার ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সেতু করার পর পরই এটা করার দরকার ছিল।

পদ্মা সেতুর সুফল পেতে ঢাকায় একটা রিং রোড দরকার। কারণ পদ্মা ব্রিজ একটা ব্রডব্যান্ড কানেকশন, মাওয়া একটা ব্রডব্যান্ড কানেকশন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দ্রুতগতিতে যখন অনেক গাড়ি ঢুকবে, তখন কিন্তু অনেক সমস্যা দেখা দেবে। যেকোনো এক্সপ্রেসওয়ের ঢোকার রাস্তা দিয়ে একটা রিং রোড করে কনসেনট্রেটেড ট্রাফিক বিরাট একটা এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত। এই ধরনের রিং রোড ঢাকায় মিসিং। পরে রিং রোড করতে গেলে অনেক সমস্যা দেখা দেবে। এখন যেটা সম্ভব হচ্ছে, পরে অবকাঠামো উঠে গেলে সেটা আর সম্ভব হবে না। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দেরি হলে, অন্যরা কিন্তু বসে থাকবে না। অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে যাবে, তখন প্রকল্পগুলোর সুফল পাওয়া যাবে না। প্রকল্পগুলো দেরি করে শুরু করলে ভূমি-জটিলতা সৃষ্টি হয়। উন্নয়ন হয় কিন্তু কার্যকর সুফল বা উপযোগিতা পাওয়া যায় না।

বন্ধন: এগুলো কতটা দুর্যোগ সহনীয় হবে? কোনো সার্ভে বা ফোর কাস্ট আছে কি?
ড. মো. সামছুল হক: জন্মগতভাবেই এগুলো হেভি ডিউটি স্ট্রাকচার। এলিভেটে হওয়ায় পরিবেশগতভাবে সুরক্ষাও পাবে। দুর্যোগ সামলানোর সক্ষমতা নিয়ে নিশ্চয়ই স্টাডি করা হয়েছে; সেই অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে।

বন্ধন: মেগা প্রকল্পগুলো কী গণমানুষের হবে? টোল বা ভাড়া বেশি হওয়ায় আগ্রহ কমে যেতে পারে কি?
ড. মো. সামছুল হক: পুরো পৃথিবীতে মেট্রো অত্যন্ত ব্যয়বহুল বা ক্যাপিটাল ইন্টেনসিভ। এ ধরনের স্থাপনা বানালে কৌশলগত ভর্তুকি দিতে হবে। এটা ছিল সনাতনী ধারণা। ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় মেট্রোতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের প্রচুর যাত্রী আছে। বিশেষ করে মেট্রো-৬ করিডরে সবচেয়ে বেশি যাত্রী, তাদের বিকল্পও নেই। অপারেশনে পেশাদারত্ব থাকলে ভর্তুকি না দিয়ে বরং সরকার এখান থেকে মুনাফাও করতে পারে। এ জন্য মেট্রো পরিচালনায় গণপরিবহন বোঝে এমন পেশাদারি লোক নিয়োগ দিতে হবে। হংকং, সিঙ্গাপুরের মডেল আমরা অনুসরণ করতে পারি। তারা শুধু ভাড়া থেকে রেভিনিউ সংগ্রহ করেনি। স্টেশনে অন্যান্য সেবা প্রদানের মাধ্যমে তারা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ জুগিয়েছে। আমরা যেহেতু উন্নয়নটা অনেক পরে শুরু করেছি, এ ক্ষেত্রে ভুল হলে তা অমার্জনীয় অপরাধ হয়ে যাবে। মেট্রো সম্পর্কে জানে এমন পেশাদারি লোক দিয়ে মেট্রো পরিচালনা করলে ভর্তুকির বদলে সরকার মুনাফা পেতে পারে। এখানে যে যাত্রী, সেটা পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। জাপানের পিক আওয়ারের মতো যাত্রী এখানে হয়ে থাকে। এখানে ভর্তুকির কথা মাথায় নেওয়া সমীচীন হবে না। বরং বিভিন্ন নন-অপারেশনাল খাত থেকে রেভেনিউ স্ট্রিম সংগ্রহের মাধ্যমে যাত্রীদেও ভর্তুকিবিহীন সহনীয় ভাড়ার সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

বন্ধন: প্রকল্প করতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা কতটা? দেশীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবন্ধকতা কী?
ড. মো. সামছুল হক: প্রকল্পগুলোর খরচ বাড়ার অনেক কারণের একটি বিদেশি পরামর্শক। প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় উপকরণ খুব কম ব্যবহার করা হয়। সেটা ম্যাটেরিয়ালের বা মেধার দিক থেকেও। আশপাশের দেশে আমরা দেখেছি, উন্নয়নের আগে নিজের সক্ষমতা তৈরী করে, যা এই দেশে করা হয় না। এছাড়া যারা দেশের বাইরে পড়াশোনা বা কাজ করতে গিয়ে সক্ষমতা অর্জন করে, বড় কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সরকার সেই এক্সপার্টদের বিদেশ থেকে দেশে এনে ভালো পজিশন ও বেতন দিয়ে তাদের কাজে লাগায়। এভাবে এখানেও সুন্দর একটা সিস্টেম করা যেত। আমাদের অনেক এক্সপার্ট দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। তাঁরা এ দেশে কাজ করার সুযোগের আশা করেন। মনে রাখতে হবে চড়ামূল্যে বিদেশী পরামর্শক ধার করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না। এজন্য দরকার দেশ প্রেমে উজ্জীবিত বিদেশে অবস্থানরত দেশীয় সফল বিশেষজ্ঞদের উন্নয়নের অংশীদারি করা। এই ধরণের উন্নয়ন দর্শন অনুসরণ করে ইন্দোনেশিয়া প্রায় আমাদের সমসাময়িক সময়ে তাদের প্রথম মেট্রো প্রকল্প আরম্ভ করে তা গত বছর সফলভাবে চালু করতে পেরেছে। নির্মাণ সময়, খরচ ও উন্নয়ন যন্ত্রনা সবই আমাদের থেকে অনেক কম লেগেছে। যদিও তাদের মেট্রোতে ৫ কি.মি ভ‚গর্ভস্ত নির্মাণ ছিল। আমারা আর কত দিন বিদেশিদের ওপর নির্ভর করব। এখন থেকেই নিজেদের সক্ষমতা তৈরি করা উচিত। সাশ্রয়ী মূল্যে, টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে নিজের মেধা ও টেকশিয়ানদের প্রতি আস্থা রাখতে হবে।

আশপাশে দেশগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কারণ নির্মাণই শেষ কথা নয়, পরে তো রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। সক্ষম করলে উন্নয়নের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণে দেশীয়রা ভূমিকা রাখতে পারেন। দেশের যন্ত্রপাতি, জনবল কাজে লাগাতে এই দর্শন কাজে লাগাতে হবে। টেকসই উন্নয়নের মূলনীতি হচ্ছে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট। এটার ঘাটতি থাকলে আমাদের ভিত অত্যন্ত দুর্বল হবে। এখন থেকেই বড় প্রকল্পগুলো করার জন্য যেসব প্রকৌশলী, স্থপতি, ঠিকাদার বিদেশে নিজেদের সক্ষম করেছেন, তাঁদের সুযোগ দিতে হবে। তাহলে আর অন্য কারোর মুখাপেক্ষী হতে হবে না। দেখা যাবে, একসময় আমাদের প্রচুর এক্সপার্ট বিদেশে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন, যেটা এখন থাইল্যান্ড, চায়নার ইঞ্জিনিয়াররা করছেন।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করা আর ধার করা পরামর্শক দিয়ে কাজ করার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। আমরা উন্নয়ন করে ফেলতে পারি কিন্তু কখনো দ্বিতীয় উন্নয়ন করার বা রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রযুক্তি বা সক্ষমতা আমাদের হবে না। পরনির্ভরশীলতায় বড় মাপের উন্নয়ন কখনো কিন্তু টেকসই হয় না।

বন্ধন: প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল, সেগুলো পাড়িই-বা কীভাবে দেওয়া হলো?
ড. মো. সামছুল হক: পদ্ম সেতুর কাজে হিমালয় পরিমাণ চ্যালেঞ্জ ছিল। এর অর্থায়ন নিয়ে দোটানা ছিল। যত বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তত বড় সাফল্যও কিন্তু এসেছে। বাংলাদেশ তার নিজের সক্ষমতা, অর্থায়নে কাজটা করেছে। পৃথিবীকে জানান দিয়েছে যে বড় মাপের উন্নয়ন প্রকল্প এখন বাংলাদেশ একাই করতে পারে। পদ্মা সেতু যে নদীর ওপর দিয়ে এসেছে, সেটাও অনেক খরশ্রোতা। পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতু, সেখানে নদীশাসনটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। এই সরকারের সক্ষমতার কারণে সুন্দরভাবে পদ্মা সেতুর কাজ সমাপ্ত হচ্ছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের পিপিপি প্রজেক্ট। এর নির্মাণকাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। ২০১০ সালে আরম্ভ করে আমরা এখনো প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতে পারিনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে আরও বেশি সাংঘর্ষিক অবস্থা হবে। এখানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার দরকার ছিল। এই প্রকল্পটা শহরের মধ্য দিয়ে গেছে। এখানে চ্যালেঞ্জ অনেক জটিল। কেননা ঢাকায় এক ফুট জায়গা কেউ ছাড়তে চায় না, এর আকাশচুম্বী দামের কারণে। অন্যের জমিতে প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। সরকার যদি এখানে এখনো নজর না দেয়, তাহলে এর অগ্রগতি নিয়ে আমি শঙ্কিত। নতুন নতুন আরও প্রজেক্ট এই করিডরে আসছে। এগুলো কিন্তু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

কংক্রিটের জঙ্গলের ঢেকে যাচ্ছে আকাশ (ছবি: হাসিন রেজা চঞ্চল)

গতিপথ পরিবর্তন করতে করতে মেট্রো এখন সংসদ ভবন চত্ত্বরে ঢুকে গেছে। তিনবার পরিবর্তন করতে হয়েছে গতিপথ। এখানে আরও চ্যালেঞ্জ আছে। কমলাপুরে মেট্রোরেলের হাব তৈরি করতে চাওয়া হচ্ছে। শাপলা চত্ব¡র, বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে কমলাপুরে নেওয়া কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জের। মেট্রোর মাস্টারপ্ল্যানে প্রথমে সায়েদাবাদে হাব করার কথা ছিল। কিন্তু ভুল করে একটা ফ্লাইওভার করে ফেলেছি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ঢাকার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছে। এসটিপি না মেনে একটা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করলাম আর তাতে অন্য জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর সমন্নিত উন্নয়নের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট হয়ে গেল, এটা হয় না। STP কর্তৃক সুপারিশকৃত গণপরিবহন ভিত্তিক BRT ও MRT এর মাস্টার প্ল্যান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত করে ১টি ফ্লাইওভার করা ছিল মারাত্বক ভুল। STP মানলে সায়েদাবাদে বাস, BRT, MRT ও রেলওয়ে সম্বলিত ১টি সমন্নিত বহুমাত্রিক পরিবহন হাব তৈরী করার সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানো যেত।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের গুরুত্বের জায়গা হচ্ছে সেখানে ৩১টি জেলা থেকে বাস এসে থামছে। সেখানে যদি BRT ও MRT প্রকল্পগুলো হতো তাহলে যাত্রীরা অনেক লাভবান হতো। তারা বিআরটি পেত, এমআরটি পেত। এগুলো ব্যবহার করে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দে গন্তব্যে চলে যেতে পারত। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল সুন্দর একটা জায়গা ছিল। ফ্লাইওভার করে এই জায়গার বহুমাত্রিক ব্যবহারের সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেললাম। এখন জোর করে কমলাপুরের দিকে নেওয়া হচ্ছে। যেটা STP প্রস্তাবনায় ছিল না। তাই MRT পুরো প্রজেক্টটিকে এখন আর সমন্বিত বলতে পারছি না। সেই হিসেবে মেট্রোতে সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এখন যদি অন্য মেট্রো প্রকল্পগুলোর সঙ্গে কিছুটা সমন্বয় করা যায়, তাহলে এর সুফল পাবে নগরবাসী।

বন্ধন: মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা যানজটমুক্ত, বসবাসযোগ্য হবে? কী মনে হয়?
ড. মো. সামছুল হক: মেট্রো বা দু-একটা প্রকল্প দিয়ে ঢাকাকে যানজটমুক্ত করা সম্ভব নয়। পুরো মেট্রো প্রকল্প যখন শেষ হবে, তখন যাত্রীরা সুফল পাবে। করিডরভিত্তিক হওয়ায় কিছু এলাকার মানুষ এর সুফল পাবে আর পুরোটা হলে গণপরিবহনে সুন্দর পরিবেশ আসবে। মেট্র্রোর নিচে যে বাসটা আছে, সেটাকে যদি সুশৃঙ্খল করতে না পারি, মোটরসাইকেলকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে গণপরিবহনে সুশৃঙ্খলা আসবে না, যানজট থেকেও মুক্তি মিলবে না। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, মোটরসাইকেল ডোর টু ডোর সেবা দেয়, মেট্রো তা দিতে পারে না। ফলে প্রথম কদিন যাত্রীরা মেট্রোমুখী হলেও পরে তারা আবার মোটরসাইকেলে ফিরে যাবে। আবার মেট্রো পুরো ঢাকা কভার করবে না। রাজধানীতে সমন্বিত ও পরিকল্পনামাফিক গণপরিবহনব্যবস্থা চালু না করলে যানজট থেকে সহসাই মুক্তি মিলবে না।

বন্ধন: রাজধানীতে এত প্রকল্প? সব পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে তো! কংক্রিটের জালে আচ্ছন্ন হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
ড. মো. সামছুল হক: কংক্রিটে আকাশ দেখা যায় না। দূষিত বায়ু খোলা জায়গায় দিয়ে নিঃসৃত হয়। কিন্তু ওপরে আচ্ছাদন হয়ে গেলে পুরো শহর গ্যাসচেম্বার হয়ে যাবে। প্রচুর দূষণ ঘটবে। ধুলাবালুতে ঘর থাকবে পরিপূর্ণ। ঢাকাকে গ্রিন ও ক্লিন রাখা সম্ভব হবে না। অনেক পরিকল্পনা যদি একটা ছোট শহরকে ঘিরে করা হয়, তাহলে তার নেতিবাচক ফল কিন্তু হবেই।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৩৭ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top