প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী আশরাফ, পিইঞ্জ
পরিবেশবান্ধব স্বপ্ননগরী চট্টগ্রাম গড়তে

প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী আশরাফ, পিইঞ্জ দেশের একজন স্বনামধন্য প্রকৌশলী, পরিকল্পনাবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ। জন্ম ১৯৫১ সালের ১০ নভেম্বর, চট্টগ্রামে। বাবা মরহুম আলহাজ মো. নুরুল হুদা ও মা আলহাজ বেগম নূরজাহান হুদা। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এর অধীনে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৪ সালে রিজিওনাল অ্যান্ড কমিউনিটি প্লানিংয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

ছাত্রাবস্থায় এবং পেশাগত জীবনে প্রকৌশল চর্চার পাশাপাশি জড়িয়ে যান বহুমুখী কাজে। নগর পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত নগর নির্মাণ, সড়ক অবকাঠামো, পরিবেশসহ নানা বিষয়ে তিনি দেশে ও বিদেশে নিয়েছেন বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ। ভূমিকম্প, পর্যটন সম্ভাবনা, জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, যানজট নিরসন, পাহাড়ধস, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আর্সেনিক, বস্তি উন্নয়ন, ভবনধসসহ নানা বিষয়ে করেছেন গবেষণা। গবেষণার এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বই, প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র দেশ ও বিদেশে। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছেন এবং করেছেন পেপার প্রেজেন্টেশন। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য এবং বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনা, ডিজাইন ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন। চট্টগ্রাম নগর পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত আছেন দীর্ঘ সময় ধরে। ১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রাম মাস্টারপ্ল্যান ও ২০০৮ সালের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রস্তুত কাজে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত ছিলেন। দেশের বাণিজ্যিক এ নগরীর নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মতামত দেন নিয়মিত।

বর্তমানে যুক্ত আছেন দেশের ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানের সম্মানজনক পদে। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান। ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সম্মানিত ফেলো। এ ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য। বর্তমানে তিনি সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া স্ট্রাকসেল (ঝঃৎঁপীবষ) কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্সের চেয়ারম্যান। তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের সাম্মানিক উপদেষ্টা। চট্টগ্রামের নানা প্রতিবন্ধকতা, উত্তোরণের উপায় ও সম্ভাবনা নিয়ে গুণী এ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে লিখেছেন মাহফুজ ফারুক

চট্টগ্রাম সিটি গেট

চট্টগ্রাম দিন দিন জৌলুশ হারাচ্ছে যে কারণে
হাজার বছরের ঐতিহাসিক প্রাচীন নগর চট্টগ্রাম। প্রাকৃতিক নৈসর্গিকের অনবদ্য লীলাভূমি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই নগরে এখন প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বাস। এত অধিকসংখ্যক জনগণের চাহিদা মিটিয়ে নান্দনিক শহর গড়তে যে পরিকল্পনার প্রয়োজন, তা এখানে হয়নি। জলাবদ্ধতা, যানজট, পাহাড়ধস ইত্যাদি এখনো এ নগরের অন্যতম সমস্যা। শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য দূষিত করছে এখানকার নদী-খাল। জাহাজভাঙাশিল্পে পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে না। রাতের আঁধারে পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট বানানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস এখানকার দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ ছাড়া রয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পাবলিক স্যানিটেশন সমস্যা।

শহুরে সংস্কৃতিতে পোস্টারের ব্যবহার থাকলেও কিন্তু চট্টগ্রামে তা চোখে পড়ার মতো। শহরের যত দেয়াল, গাছ, গোলচত্বর, লাইটপোস্ট, ফোয়ারা, ভাস্কর্যÑ কোনো জায়গাই পোস্টারের আগ্রাসনমুক্ত নয়। বাড়ির দেয়ালে নতুন রং করার পরদিনই লাগছে পোস্টার। এ ধরনের অপসংস্কৃতির কারণে চট্টগ্রাম হারাচ্ছে তার নিজস্ব অভিজাত সৌন্দর্য।

৩০-৪০ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরীর জনসংখ্যা ছিল সাত-আট লাখ। রেয়াজুদ্দিন বাজার, চকবাজার, বকশীরহাট, ফিরিঙ্গিবাজার, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ সিডিএ মার্কেট, কাজীর দেউড়ি, ইছনাহাট, ফইল্যাতলীবাজার ইত্যাদি ছিল তখনকার বাজার। এখন নগরীর জনসংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়ালেও বাড়েনি বাজারের সংখ্যা। জনগণের প্রয়োজনে এখন রাস্তাঘাটে বাজার বসছে নিয়মিত। এসব নানা কারণেই আসলে ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম হারাচ্ছে তার অনাবিল সৌন্দর্য।

চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়ন ও মাস্টারপ্ল্যান
১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যানে প্রস্তাবিত ৬০ বর্গমাইল আয়তনের মধ্যে চট্টগ্রাম নগরী এখনো সীমাবদ্ধ। ২০১৬ সালে এসেও আয়তন বাড়ানোর প্রয়োজন পড়েনি। মাস্টারপ্ল্যানের প্রণেতারা যা ভাবতেও পারেননি, এখন তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি মানুষ এই নগরে বাস করছে। ১৯৯৫ সালে করা দ্বিতীয় মাস্টারপ্ল্যানটি ২০ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম করলেও তা মেনে কাজ হয়নি খুব একটা। মাস্টারপ্ল্যানে চট্টগ্রাম উন্নয়নের সবকিছুই আছে। যেমন, সদরঘাট থেকে কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত একটি সংযোগ সড়ক হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয়নি। এই রিং রোড হলে নগরের কোর (প্রধান) এলাকা যানজটমুক্ত হতো। এ ছাড়া বায়েজিদ বোস্তামি থেকে ট্রাম রোড পর্যন্ত সংযোগ সড়ক ও ফৌজদারহাট রিং রোড হলে শহরের বাইরেই কক্সবাজার, বান্দরবান, টেকনাফ ও অন্যান্য স্থানে সহজেই যাওয়া যাবে। ড্যাপেও বিআরটির (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) কথা উল্লেখ আছে কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যেখানে শহর করার পরিকল্পনা ছিল, সেখানে অপরিকল্পিতভাবে গলি বানাচ্ছে, ৬-১০ ফুটের রাস্তা হচ্ছে, সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)ও অনুমোদন দিচ্ছে, এতে তারা বাধা দেয়নি। যেখানে কোনো গাড়ি ঢুকতে পারে না। ঢাকার মতো চট্টগ্রামও পরিণত হচ্ছে কংক্রিটের বস্তিতে।

চট্টগ্রামের উন্নয়নে সরকার যে প্রকল্প অনুমোদন বা অর্থছাড় দেয় না তা নয়, বরং আমাদের তরফ থেকে বাজেট বরাদ্দ চেয়ে ডিপিপি আকারে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রস্তাবনা দেয়া হয় না। আমরাই যদি এসব ব্যাপারে তৎপর না হই তাহলে সরকার দিবে কিভাবে। এটা একধরনের গাফিলতি। এগুলো করা যাদের দায়িত্ব ছিল তারা তা করেনি। এটা বড় ধরণের অন্যায়। মাস্টারপ্ল্যানে উপেক্ষা করে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা বেশি মনোযোগী হয়েছে। শহরে প্রায় ৩২টার মতো উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা সরকারের উন্নয়নকাজ করে কিন্তু সমন্বয় নেই, একটা প্রতিষ্ঠান আরেকটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। কার্যকর কোনো সিটি গভর্নমেন্ট নেই, যাকে সবাই জবাবদিহি করবে। কারও গাফিলতি ও অন্যায়ের জন্য শহর নষ্ট হবে, দুর্ঘটনা ঘটবে, দেশের সম্পদ ও অর্থ নষ্ট হবে, তার জন্য থাকা চাই জবাবদিহি ও বিচারের ব্যবস্থা। চট্টগ্রামের সাধারণ নাগরিকেরা এসব অবহেলা ও অন্যায়ের বিচার চায়।

কাপ্তাই লেক

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার নেপথ্যে
বর্ষায় নগরবাসী জলাবদ্ধতায়, বন্যায় কষ্ট পায়, সম্মুখীন হয় আর্থিক ক্ষতির। আন্দোলন, মিছিল, অনশন হয়, হয় লেখালেখিও। অথচ এ সমস্যার সমাধান এমন কোনো জটিল বিষয় নয় যে আমরা করতে পারব না। সমাধান প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আসার আগে জানা প্রয়োজন এর কারণ। যেমন-

জল নিষ্কাশনে চাক্তাই খালের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা
চট্টগ্রাম নগরীর জলবন্দী প্রধান প্রধান এলাকার পানি নিষ্কাশনের আমরা চাক্তাই খালের ওপর নির্ভরশীল। প্রশ্ন আসতে পারে, ১৫ বছর আগে তো এমন সমস্যা ছিল না! তাহলে এখন পারছে না কেন? আসলে খালটি তখনো যতটা পরিমাণ পানি টানত, এখন প্রায় সেই পরিমাণ পানিই টানে। অতিরিক্ত পানি তখন জমে থাকত বিলে, বাঁকলিয়ার চর আর নিচু জলাভূমিতে, বর্তমান চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার পতিত জমিতে, জামেয়া আহমদিয়া ছুন্নিয়ার আশপাশ, খতিবের হাট, মোহাম্মদপুরের ধানি জমিতে। নির্বিচারে জলাভূমি ও কৃষিজমি ভরাট করে আমরা দালানকোটা বানিয়েছি। নালা-নর্দমার মতো অপ্রয়োজনীয় কাজে এক ইঞ্চি জমিও ছাড় দিইনি, সম্ভব হলে খালের ভেতর থেকে দু-এক ফুট জায়গা হাতিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণ, নালা-নর্দমা আবর্জনায় ভর্তি করার ফলে অতিরিক্ত পানিকে কিছু সময় আটকিয়ে রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সড়কগুলো খালে পরিণত হয়েছে আর বাড়ির আঙিনা হয়েছে পুকুর।

খাল-নালা-নর্দমার অনিয়মিত কিংবা ত্রুটিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ
চট্টগ্রামের পাহাড় মূলত ভাঁজ পর্বত। সাগরের নিচ থেকে উত্থিত হয়ে এসব পর্বতের সৃষ্টি হয়েছে প্রধানত বালু আর পলিতে। আমরা পাহাড় কাটি বা না-কাটি, এসব পাহাড় থেকে পলি মাটি বৃষ্টির সঙ্গে নালা, নর্দমা কিংবা খালে নেমে আসে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারলে এবং বনায়ন কিংবা ঘাসের আচ্ছাদন সৃষ্টি করতে পারলে পানিবাহিত পলির পরিমাণ কমানো সম্ভব। কিন্তু পলি আসা বন্ধ হবে না। তাই নালা-নর্দমা খালের রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বালুর ফাঁদ (সিল্ট ট্র্যাপ) ভরাট হওয়ার জন্যই এটির সৃষ্টি। এসব সিল্ট ট্র্যাপ থেকে নিয়মিত বালু বা পলি অপসারণের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের প্রয়োজন রাস্তাঘাটের রক্ষণাবেক্ষণের মতো খাল, নালা-নর্দমারও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ। প্রতিবছরের মিউনিসিপ্যাল বাজেটে এই খাতে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

নালা-নর্দমার অবস্থান কিংবা আয়তনকে ন্যূনতম গুরুত্ব দিয়ে নকশা অনুমোদন
সিডিএ বাড়িঘরের নকশা অনুমোদনের সময় সাইট প্ল্যানে বাড়ির সামনের রাস্তা কতটুকু চওড়া এবং প্রধান সড়ক কোন বা গলির সঙ্গে এটি যুক্ত হচ্ছে তা গুরুত্বসহকারে দেখে। নালা-নর্দমার বেলায় এসে তা করা হয় না। বিল ভরাট করে বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাড়ির অভ্যন্তরের সীমানা দেয়ালঘেঁষে চারপাশে সারফেস ড্রেনের অবস্থান নকশায় দেখানো হয়। কিন্তু এই নালা কোনো প্রধান নালা কিংবা খালের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তার কোনো উল্লেখ নকশায় থাকে না। আদৌ আশপাশে কোনো বড় নালা কিংবা খাল আছে কি না, আদৌ এই সাইটের পানি অপসারিত হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না এই নকশা।

শাহ আমানত (তৃতীয় কর্ণফুলী) সেতু

নালা-নর্দমার ওপর দোকান পার্ক নির্মাণ
দীর্ঘদিন ধরে আয়বর্ধক প্রকল্পের নামে পৌর কর্তৃপক্ষ নালা-নর্দমার সংকোচন কিংবা নালা-নর্দমার ওপর দোকান ঘর বানিয়ে আসছে। এসব বাণিজ্যিক ভবনের কিছু কিছু কলাম উঠে এসেছে একেবারে নালার ভেতর থেকে। পানির ¯্রােত যখন বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন এসব কলামের গোড়ায় পলি জমতে থাকে। বহদ্দারহাট, রেয়াজুদ্দিন বাজার এলাকার পৌর বাণিজ্যিক ভবনগুলোই এর প্রমাণ। এর সঙ্গে আছে নালার সংকোচন। প্রবর্তকের মোড়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটি এ ধরনের নালা সংকোচন করে নির্মাণকাজের উদাহরণ। সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি সংস্থা কিংবা ব্যক্তির অনিয়ম। যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই দখল করছে। রেয়াজুদ্দিন বাজার, বকশীরহাট এলাকা, মোগলটুলী এলাকার নালার পাশের ব্যক্তিমালিকানাধীন মার্কেটগুলো, মির্জাখাল, চাক্তাই খালের দুপাশের ভবনগুলোর দিকে তাকালেই ব্যাপারটা চোখে পড়বে। পিএস, বিএস শিট অনুযায়ী তদন্ত করলে জবর-দখলকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব।

নালা-নর্দমায় বর্জ্য নিক্ষেপ
নির্বিচারে বর্জ্য ফেলার কারণে নালা-নর্দমা ভরাট হচ্ছে। এটি একটি অভ্যাসগত সমস্যা। এক্ষেত্রে শিক্ষিত-অশিক্ষিতদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বর্জ্য অপসারণ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির কার্যকরী পন্থা খুঁজে বের করা না গেলে সমস্যাটি সমস্যাই থেকে যাবে।

নির্বিচারে পাহাড় নিধন
১৯৯৪ সালের ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনায় চট্টগ্রামের অভ্যন্তরের পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করে আইনও হয়েছে। কিন্তু মানা হচ্ছে না। রাতের অন্ধকারেও পাহাড় কাটা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে পাহাড় কাটার ফলে বৃষ্টির পানিতে পলির পরিমাণ অস্বাভাবিক বাড়ছে। বৃষ্টির পানিবাহিত পলি, নালা-নর্দমা ভরাট হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।

ওপরে বর্ণিত সমস্যাগুলোর প্রতিটিরই সমাধান সম্ভব। কিছু সমস্যা আছে যা খুব সহজেই সমাধান করা যাবে আবার কিছু সমস্যা আছে, যার সমাধান সময়ের ব্যাপার। এসব সমস্যা সরেজমিনে তদন্ত করে ১৯৯৪ সালে ‘চট্টগ্রাম স্ট্রর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্ল্যাড কন্ট্রোল’ নামক একটি ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই মাস্টারপ্ল্যানটি বাস্তবায়ন করা দরকার। আরও একটি বিষয়, চট্টগ্রাম এখনো সেপটিক ট্যাংক-নির্ভর নগরী। এই সেপটিক ট্যাংকগুলো আবার নালা-নর্দমার সঙ্গে যুক্ত। এতে খালগুলো এখন ওপেন সিউয়্যার হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের জন্য ভূগর্ভস্থ সিউয়্যার নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। মহাপরিকল্পনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করার জন্য কিছু ড্রেনেজ প্রকল্পকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এর মধ্যে নতুন কিছু খাল খননের প্রস্তাবও আছে। সম্প্রতি আরও দুটি খাল খননের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগ্রাবাদ এলাকায় স্লইচগেট করতে হবে। যে আমলে গেটগুলো করা ছিল, সেগুলো করা হয়েছিল ছোট করে। অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত প্রথম পর্বের কাজগুলো সমাধা করা গেলেই চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতার সিংহভাগ অপসারিত হবে।

নগরের জলাবদ্ধতা ও জীর্ণদশায় নগরের খাল

চট্রগ্রামের উড়ালসড়ক, যানজট ও পরিত্রাণ প্রসঙ্গ
চট্টগ্রামের যানজট আমাদেরই সৃষ্টি, এমন নয় যে এখানকার সড়কের সক্ষমতা কম। সম্প্রতি সাদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের এক গবেষণা উঠে এসেছে, নগরের সড়কে যে পরিমাণে গাড়ি চলে, তার দ্বিগুণ চলাচল করলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথচ সড়কগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও যানজট হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ প্রতিটি জংশনে একাধিক যানবাহন স্ট্যান্ড। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন এলোমেলোভাবে সড়কমুখগুলো দখলে রাখে। ফলে গাড়িগুলো বের হতে পারে না। অথচ নিয়ম অনুযায়ী যেকোনো যানবাহন স্ট্যান্ড জংশন থেকে অন্তত ১০০ গজ দূরে থাকা উচিত। একাধিক পুলিশ সদস্য এসব জংশনে থাকলেও যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। কারণ, তাঁদের কার্যকর প্রশিক্ষণ নেই। ফুটপাত দখলে থাকার কারণে মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। রাস্তায়ও রয়েছে পার্কিংয়ের সমস্যা। অনেক ভবনের বেইজমেন্ট পার্কিং থাকলেও তা ভাড়া দেওয়া। প্রধান সড়কের পাশে এবং আবাসিক এলাকাগুলোতে প্রচুর স্কুল হয়েছে। বিশেষ করে যেসব স্কুলে গাড়ি চড়া ছাত্রছাত্রী বেশি, সেখানে যানজট বেশি। ১২০ ফুট রাস্তা পরিণত হচ্ছে ৬০ ফুটে। রাস্তা অর্ধেক হয়ে গেলে তো যানজট হবেই।

এ ছাড়া সড়কে বাজার, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, রাজনৈতিক সভা, পূজা উৎসব, মিলাদ-মাহফিল, পথসভা সবকিছুই হচ্ছে সড়কে; এগুলোর জন্য নেই নির্ধারিত কোনো স্থান। এ ছাড়া বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো নানা অনুষ্ঠান সব সময় লেগেই থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে লোকজন অনেক সময় দ্বিধা আর সংকোচে কিছু বলে না; মুখ বুজে সহ্য করে। এটি এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

এসব অসংগতি দূর না করে আমরা ফ্লাইওভার নির্মাণ করছি। আসলে এটি কিন্তু নগরের যানজট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সাময়িকভাবে কিছুটা ফল মিললেও ভবিষ্যতে তা কাল হয়ে দাঁড়াবে। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নিয়ে সাদার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের আরও এক গবেষণা দেখা গেছে, ফ্লাইওভারটি অধিকাংশ সময় ফাঁকাই থাকে, খুব বেশি গাড়ি উঠতে চায় না এতে। কারণ, এখানে ছিনতাই হয়। কোনো পুলিশি নিরাপত্তা নেই। অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ না করে আমাদের সড়ক নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। আমরা যদি নগরের পশ্চিমে আরও একটা বা দুটো নতুন সমান্তরাল সড়ক করি, তাহলে তা অনেক বেশি কার্যকর হতো। যে টাকা দিয়ে ফ্লাইওভার করব, তার থেকে অনেক কম টাকায় নতুন সড়ক নির্মাণ সম্ভব। যদিও নগরের উন্মুক্ত জায়গা অনেক কমেছে তবুও কিছু সড়ক করার মতো জামি এখনও পাওয়া যাবে। হয়তো ২০-২৫ বছর পর এই সুযোগ আর থাকবে না। আর কোনভাবে সড়ক নির্মাণ করা গেলেও জায়গা বরাদ্দ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ অনেকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। নতুন সড়ক হলে শহর সম্প্রসারিত হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যানজট সমস্যা আসলে সমাধানযোগ্য। সংকট সমাধানে জোর দিতে হবে ব্যবস্থাপনার ওপর।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নে জলবায়ু পরিবর্তনের শঙ্কা ও ক্ষতি
দেখুন, আমাদের অঞ্চল সম্পর্কে এ সম্পর্কিত জরিপ বা পূর্বাভাস কিন্তু পাওয়া যায় না। তবে এখন প্রকৃতির যে পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ছে, তাতে বুঝতে পারি, কিছু একটা হচ্ছে। তবে এটা কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বা কতটা ফেলবে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশে এ নিয়ে খুব কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না, অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যে তথ্যগুলো আমরা পাচ্ছি, তা পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে শোনা। ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অব ক্লাইমেটের মতে, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গেলে বাংলাদেশের মতো দেশে আগামী শতকে ১৬-১৭ শতাংশ ভূমি পানির নিচে চলে যাবে। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমানের মতে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হলে শতকরা ৬০-৭০ শতাংশ ভূমি পানির নিচে চলে যেতে পারে। আসলে উন্নত বিশ্বের পরিবেশদূষণের কারণে এ অভিশাপের মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের; এটাকে অনেকে বলেন ক্লাইমেটিক জেনোসাইড। নাসার আবহাওয়াতত্ত¡বিদ অধ্যাপক জেনস হ্যানসেনের মতে, আগামী শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে পাঁচ মিটার। তা-ই যদি হয়, পতেঙ্গা বা সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল তো বটেই, চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে। তবে চট্টগ্রামের কনট্যুর ম্যাপ (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সমুন্নত নকশা/রেখা) ও জিআইএস (জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সিস্টেম) ম্যাপ পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি, সাগরের উচ্চতা যদি এক মিটারও বাড়ে, তবুও চট্টগ্রাম শহর ডুববে না। কারণ, শহরটি বেশ উঁচু। হয়তো আশপাশে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে।

ওয়ার সিমেট্রি, চট্টগ্রাম ও কাপ্তাই লেক সড়ক

পরিবেশবান্ধব চট্টগ্রাম নগরী হতে…
পরিবেশবান্ধব নগর গড়তে হলে চট্টগ্রামের সৌন্দর্য যা আছে তা অক্ষুণœ রেখেই উন্নয়ন করতে হবে। আমরা নগরের যেসব সৌন্দর্য নষ্ট করেছি, তা ফেরানো সম্ভব না হলেও যতটা সম্ভব ফিরিয়ে দিতে হবে। যেমন, পাহাড় না কেটেও তো উন্নয়ন করা যায়। পাহাড় লুকিয়ে তো আপনি সৌন্দর্য আশা করতে পারেন না। পরিবেশবান্ধব নগরীতে পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণ সহনশীল মাত্রায় থাকবে। পাহাড় কাটা, বৃক্ষনিধন ইত্যাদি নিরুৎসাহিত করতে হবে। যেকোনো বড় প্রকল্পের প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আগে ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) যাচাই করতে হবে।

ইদানীং বিশ্বের বিভিন্ন নগরে এনার্জি ইফিসিয়েন্ট করার চেষ্টা চলছে। ঘরবাড়ির নকশা প্রণয়ন করার সময় বিদ্যুতের ব্যবহারে সাশ্রয়ী অর্থাৎ স্থাপনায় যাতে এয়ার কন্ডিশনিং, বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়া যায়। রাস্তাঘাটের ঢাল, সিগন্যালিং সিস্টেম ইত্যাদি ডিজাইন করার সময় যানবাহনের জ্বালানি খরচের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়। উপযুক্ত ডিজাইন করা গেলে যানবাহনের জ্বালানি খরচ কমে। এগুলো চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। এনার্জি ইফিসিয়েন্ট নগরী করা গেলে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের ব্যবহার কমবে, অপচয় বন্ধ হবে। সরকার কিছুদিন আগে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব বিতরণ করেছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ, তবে যথেষ্ট নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে সম্প্রতি বিলবোর্ড অপসারণ করে প্রমাণ করেছে প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে সব সম্ভব। বিলবোর্ড অপসারণের ফলে টাইগারপাসসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরে এসেছে। এখন রাস্তার পাশের দোকানপাটের সাইনবোর্ড যদি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়, তাহলে চট্টগ্রাম দৃষ্টিনন্দন নগর হিসেবে আবির্ভূত হবে। এবং তা তবে দেশের অন্য যেকোনো নগর থেকে আলাদা। যেহেতু পোস্টার আমাদের শহুরে সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে, তা-ই বর্জন করা কঠিন। এ জন্য শহরের প্রতিটি রাস্তার পাশে নির্ধারিত কিছু দেয়াল যদি চিহ্নিত করা যায় পোস্টারের জন্য এবং কিছু কিছু স্থানে যদি পোস্টার স্ট্যান্ড বানিয়ে দেওয়া যায়, তখন অন্য কোনো অনির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানোর অপরাধে শাস্তি কিংবা সাজার বিধান করা যাবে। সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থানসমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা এবং ভবনসমূহে স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারে, যেখানে পোস্টার লাগানো যাবে। এর বাইরে পোস্টার লাগানো হলে যাদের নামে কিংবা যাদের পণ্যের পোস্টার থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিচ্ছন্ন নগর গড়তে চাইলে রাস্তার পাশে কোনো আবর্জনা রাখা যাবে না। এ জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতি ওয়ার্ডে রিকশা-ভ্যানের মাধ্যমে ঘরে ঘরে গিয়ে আবর্জনা সংগ্রহ করতে হবে। একটি নির্ধারিত স্থানের ডাস্টবিনে ময়লা রাখতে হবে। তবে তা যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে জনসমাগম ও দৃষ্টিনন্দন স্থান থেকে দূরে হয়। অর্থাৎ ঐ জোনটির চারপাশে গাছ লাগিয়ে ঘেরাও করে দিতে হবে যেন তা দৃষ্টিকটু না লাগে এবং মানুষের দৃষ্টির বাইরে থাকে। সেখান থেকে সিটি করপোরেশনের আবর্জনার গাড়ি তা নিয়ে যাবে ডাম্পিং স্টেশনে। এ ক্ষেত্রে আবর্জনা অপসারণে সহজীকরণ করতে সিটি করপোরেশন আরও কিছু ডাম্পিং স্টেশন গড়ে তুলতে পারে। এতে ট্রিপের সংখ্যা বাড়বে এবং বেশি ময়লা অপসারিত হবে। ডাম্পিং স্টেশন হবে নগরীর চার প্রান্তে। স্টেশনের স্থান নির্বাচন এমন হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এসব স্থানে পার্ক, খেলার মাঠ কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে তোলা যায়।

সার্কিট হাউস, চট্টগ্রাম

জলাবদ্ধতা দূরীকরণ এ নগরের অবশ্যম্ভাবী কাজ। এ জন্য প্রকল্প তৈরি করতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধান কাজ হলো বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খনন করা, যা ইতিমধ্যে সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। দ্বিতীয় হলো মির্জা খাল ৬০ ফুট চওড়া করার পাশাপাশি নতুন খাল খনন করা। আর তৃতীয় হলো সিডিএ অ্যাভিনিউয়ের উত্তর দিক থেকে আসা পানি নেমে যাওয়ার জন্য রেললাইনের সমান্তরালে খাল খনন করা। আর তা করা হলে চট্টগ্রাম শহরের মেরুদন্ড বলে বিবেচিত সিডিএ অ্যাভিনিউ এলাকা জলাবদ্ধতামুক্ত হবে। এ ছাড়া জোয়ার-ভাটার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে চাক্তাই ও রাজাখালীর মুখে স্লুইচগেট কিংবা নেভিগেশন চ্যানেল বসানো যেতে পারে। বড় গাছপালা নেই পাহাড়ে, ঢল নামে দ্রুতই। বৃষ্টির পানি যদি এক-দুই ঘণ্টা দেরি করে আনা যায় তবে একসঙ্গে পানির চাপ বেশি থাকে না। গাছ লাগাতে হবে। তবেই শহর পাবে গ্রাম, সবুজ প্রকৃতি, পাহাড় আর পুকুর।

নগরের যানজট সমস্যা নিরসনে কিছু কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা। যেহেতু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, ছোটখাটো রাজনৈতিক সভা, মাহফিল ইত্যাদির জন্য নির্ধারিত স্থান: পূজা উদৃয্যপন হবে, মিলাদ করতে হবে, পথসভা করতে হবে নির্ধারিত স্থানেই। যত্রতত্র রাস্তা বন্ধ করে এসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এটি এখন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কখনো রাস্তার একপাশ অনুষ্ঠানের জন্য বন্ধ করে দিয়ে অপর পাশ দিয়ে দ্বিমুখী গাড়ি চলতে দেওয়া হয়। এতে যানজট হয়; জনগণ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে। বারো মাসে তেরো পার্বণের এখানে কোনো না কোনো অনুষ্ঠান সব সময় লেগেই থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে লোকজন অনেক সময় সংকোচে কিছু বলে না, মুখ বুজে সহ্য করে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দু-তিনটা করে ছোট আয়তনের খোলা প্লাজার ব্যবস্থা করা যায়। যেখানে প্রতিদিন বিকেলে লোকজন আড্ডা দেবে, সভা-সমিতির কার্যক্রম চলবে, মৌসুমি ভাসমান বিক্রেতারা এসে জটলা করবে। প্রয়োজন শুধু এক চিলতে উঠোন সব কাজের কাজি হবে উঠোনটিই। যেখানে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কিংবা ভাড়ায় সারা বছরই ছোটখাটো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সভা-সমিতি করা যাবে।

নান্দনিক ও পর্যটনবান্ধব চট্টগ্রাম
ঢাকায় হয়ে গেল নগরীর ৪০০ বছর পূর্তির উৎসব। চট্টগ্রামে কেন হাজার কিংবা দুই হাজার বছর পূর্তির উৎসব হয় না? দুই হাজার বছর আগে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে চট্টগ্রামকে মার্কেট টাউন হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক প্লিনি। সপ্তম এবং অষ্টম শতাব্দীতে আরব বণিকেরা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য করেন। ১৩১৩ সালে ম্যারজন হার্বার্ট চট্টগ্রাম ভ্রমণকালে চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধ এবং জনবহুল এক নগরী হিসেবে দেখেছেন। পনেরো ও ষোলো শতকের ঐতিহাসিক বর্ণনায় চট্টগ্রামকে বড় এক নগরী এবং বন্দর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এবং পরিব্রাজক এই নগরীকে বাংলার প্রধান নগরী বলেও উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এটি আজও বেঁচে আছে; কখনো পরিত্যক্ত হয়নি। দিন দিন বাড়ছে এর কলেবর। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্ব এবং আনন্দের বিষয়। চট্টগ্রাম অবশ্যই অহংকার করতে পারে; দাবি করতে পারে কৌলিন্যের। দুই হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের।

অপরিকল্পিত নগর উন্নয়নের ফলে নগর যে সৌন্দর্য হারাচ্ছে তা কিছু পদক্ষেপ নিলেই রোধ করা সম্ভব। যেমন, প্রধান সড়কের পাশের দেয়াল, লাইটপোস্ট এগুলো কিন্তু স্ট্রিট ফার্নিচার বলা হয়। চট্টগ্রাম শহরে এগুলোর জন্য যদি বিশেষ ডিজাইন করা হয় তাহলে মনে হবে আপনি চট্টগ্রামেই এসেছেন। বাংলার লোক সংস্কৃতিকে যদি এসব দেয়ালে চিত্রায়িত করা যেত, তাহলে নগরের রূপই বদলে যাবে। একবার ভাবুন তো চারপাশে সবুজ, পাহাড় তার মধ্যে চিত্রকলা। এমন অনুভূতি কিন্তু চারুকলার মধ্যে ঢুকলে দেখা যায়। রাস্তার দুই পশের দেয়ালে ওরা আর্ট করেছে, ব্যাপারটা কী দারুণ, ভাবুন না একবার!

কিছু এলাকায় জোনভিত্তিক দেশীয় গাছ লাগানো যেতে পারে। যেমন সোনালু, জারুল, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলগাছ প্রভৃতি। এ গাছগুলোতে যখন ফুল ফুটবে তখন পুরো এলাকার দৃশ্যপটই বদলে যাবে। প্রতিটি বাড়ির বারান্দা ও ছাদে ফুলগাছ লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে প্রতিবছর সবচেয়ে সুন্দর কয়েকটি ভবনকে সিটি করপোরেশন থেকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। তাহলে সবাই নিজ নিজ বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে উৎসাহিত হবে। সাইনবোর্ডগুলোর শৃঙ্খলা আনতে হবে। সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায়, ডিজাইন, লেখার সাইজ ও ধরন নির্ধারণ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে ডিজাইন প্রতিযোগিতা করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। কিছু এলাকা শত বছর আগে যে রূপ ছিল, সেভাবে সাজানো যায়। অর্থাৎ জমিতাল ফালা মসজিদ, সার্কিট হাউস, সিআরবি এলাকাগুলোকে একটি ভিক্টোরিয়ান এলাকায় রূপ দেয়া যায় যা কলোনিয়াল যুগের মত দেখতে লাগবে। পুরোনো ভবনগুলো রেখে নতুন স্থাপনাগুলো কলোনিয়াল স্টাইলেই তৈরী করলে পরিবেশই বদলে যাবে। মনে হবে একটি মিউজিয়ামে ঢুকছেন। আসলে মানুষের ভালোলাগার সবকিছুই রয়েছে এ নগরে শুধু একটু সাজালেই হবে। নগরের প্রতিটি দিঘি-পুকুরকে যদি লালদিঘির মতো উন্নয়ন করা যায়, তাহলে তা সৌন্দর্য বাড়াতে সহায়ক হবে। এগুলো নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। এগুলো করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন নেই, দরকার শুধু ইচ্ছে আর উদ্যোগের। এসব বাস্তবায়ন করা গেলে চট্টগ্রাম শুধু বাণিজ্যিক রাজধানী নয়, বরং দেশের শিল্প-সংস্কৃতির রাজধানী হতে পারে।

চট্টগ্রাম নৌবন্দর

চট্টগ্রামের উন্নয়নে যত বাঁধা ও অগ্রাধিকার পরিকল্পনা
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন। জাতীয় অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের অবদান কি এতই কম যে চট্টগ্রামের বিনিয়োগের বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়? চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও আদতে তা নয়। বাণিজ্যিক রাজধানী বলতে এমন এক নগরীকে বোঝায়, যার বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চূড়ান্ত ক্ষমতা আছে। দেশের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ট্রানজিট পয়েন্ট বা গেটওয়ে চট্টগ্রাম, কিন্তু চূড়ান্ত বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত এ নগরের হাতে নয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্যার কারণেই চট্টগ্রাম থেকে প্রধান শিল্প-কারখানাগুলো একে একে ঢাকামুখী হয়েছে। বড় বড় কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি ইতিমধ্যেই সদর দপ্তর ঢাকায় সরিয়ে নিয়েছে, অন্যরাও যাওয়ার পথে। এমনকি বড় আকারের অনেক বেশি কোম্পানিও ঢাকায় স্থানান্তর করেছে প্রধান দপ্তর। সারা দেশে উন্নয়ন কিছু না-কিছু হয়েছে, তবে এই উন্নয়নকে অসম উন্নয়ন বলা যায়। অগ্রাধিকার নিরূপণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। চট্রগ্রামের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে-

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন : চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অন্যতম প্রধান একটি সম্পদ। পলির আগ্রাসনে চট্টগ্রাম বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই বন্দর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহেরও প্রবেশদ্বার হতে পারে। এই বন্দরকে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং দক্ষিণ চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লাভজনকভাবে ব্যবহার করা যায়। পশ্চাৎসুবিধাসহ বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ চট্টগ্রাম বন্দরকে সত্যিকার অর্থেই দেশের জন্য গল্পকথার স্বর্ণডিম্ব প্রসবিনী হাঁসে পরিণত করতে পারে। এই বন্দরের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ হওয়া উচিত। এটি হতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মকান্ডের অগ্রাধিকারে এক নম্বর।

ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে : দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েই। অনেক দিন হয়ে গেলেও চার লেনবিশিষ্ট সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হচ্ছে না। অর্থনৈতিক লাভালাভের কথা ভেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়কটি নির্মাণ সম্পন্ন করতে হবে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন : বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেল যোগাযোগের কথা উঠলে অবশ্যই সর্বপ্রথম ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের কথা আসবে। অন্য সব লাইন অলাভজনকভাবে চালু থাকলেও এই রেল লাইনটি সব সময়ই লাভজনকভাবে চলে আসছে। অথচ আজও এই রেলওয়ে ট্র্যাকটি ডাবল লাইন করা সম্ভব হয়নি। রাস্তায় যদি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়, রেল যোগাযোগে চার ঘণ্টার বিলম্ব অবধারিত। অন্য একটি ট্রেন পাশ দিয়ে যাবে, অতএব এই ট্রেনকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই বিলম্বে আর্থিক ক্ষতি পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রেন ভ্রমণে সময় লাগে বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে লাকসাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটা কর্ড লাইনের কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে অনেক আগে। এই লাইনটি করা গেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব কমবে, সাশ্রয় হবে দুই ঘণ্টা সময়। অত্যন্ত লাভজনক বিবেচিত হওয়া সত্তে¡ও আমরা এখনো পর্যন্ত এই কর্ড লাইনটা করতে পারিনি।

নেভাল সড়ক, পতেঙ্গা

চট্টগ্রাম ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান : চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৯৫ সালে প্রণীত হয়েছে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান। পনেরো বছর হয়ে গেলেও ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ফেইজের কাজটিও এখন শুরু করা যায়নি। আমরা বলছি, চট্টগ্রাম বিনিয়োগের জন্য উত্তম জায়গা। কিন্তু যে নগরীর এক-তৃতীয়াংশ বর্ষা মৌসুমে পানির নিচে তলিয়ে যায়, সেখানে বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নিতে কোনো উদ্যোক্তা কি রাজি হবেন? চট্টগ্রামের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে জলাবদ্ধতা নিরসন করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রয়োজন।

গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ : চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানাসমূহ গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নতুন শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে অর্থ বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে বহু টাকা বিনিয়োগের বর্তমান শিল্প অবকাঠামো অব্যবহৃত থেকে যাবে, দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বান্দরবানের থানচি উপজেলার উজানে শঙ্খ নদীতে বিভিন্ন লেভেলে বাঁধ দিয়ে একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যায়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি নদীতে ছোট ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সমীক্ষা চালানো উচিত। ক্ষুদ্রাকৃতির জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য অর্থ বরাদ্দ অগ্রাধিকার প্রাপ্তির দাবি রাখে।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের উপযুক্ত ব্যবহার : আমাদের একটা উন্নত বিমানবন্দর আছে। কিন্তু সেই বিমানবন্দরটির উপযুক্ত ব্যবহার হচ্ছে না। এই বিমানবন্দরটির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেল প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো। বিমানবন্দর নির্মাণে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ হয়েছে কিন্তু সেই বিনিয়োগের ফসল ঘরে তুলে আনা যাচ্ছে না কেন? সরকারি পলিসিগত আনুকূল্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে লাভজনক সরকারি স্থাপনায় পরিণত করতে পারে।

পর্যটন অবকাঠামো : চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গড়ে উঠতে পারে অতুলনীয় এক পর্যটন বলয়। শুধুমাত্র এই খাত থেকেই আসতে পারে বাংলাদেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা। চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ি পরিবেশকে অক্ষুণœ রেখে মেঘের কোলে বাড়ি, হোটেল, হ্রদ ইত্যাদি নিয়ে সৃষ্টি করা যায় স্বপ্নের এক পর্যটন উপশহর। যদি উপযুক্ত অবকাঠামো সৃষ্টি করা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসবেন এই শহরে। আয় বাড়বে। চট্টগ্রাম শহর সাথে লাভবান হবে দেশ। চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশমুখে ফৌজদারহাটের নিকট সমুদ্র উপকূলে সমুদ্র থেকে জমি পুনরুদ্ধার করেও নির্মাণ করা যায় এক্সক্লুসিভ পর্যটন নগরী। এর জন্য কারিগরি সমীক্ষা প্রয়োজন।

ব্যাংকিং অবকাঠামো : ব্যাংক ও বিমা অবকাঠামো আছে চট্টগ্রামে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। এসব প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত আর্থিক সক্ষমতা নেই। কমপক্ষে মাঝারি পাল্লার শিল্প স্থাপনের জন্য যেন ঢাকায় দৌড়াতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রামে যে অবকাঠামো আছে, শুধু তাই ব্যবহার করে, যদি সরকারি পলিসিগত আনুকূল্য পাওয়া যায়, চট্টগ্রাম সব সময়ই জাতীয় কোষাগারকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম।

পতেঙ্গা সী বীচ, চট্টগ্রাম

সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর : কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক আখ্যায়িত করা হয়েছে। সরকারও সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই বন্দর স্থাপিত হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা কর্মচঞ্চল হবে, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রতিবেশী দেশসমূহের প্রয়োজনকে লক্ষ রেখে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

ওপরে আলোচিত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন জাতীয় স্বার্থে অগ্রাধিকার দাবি করে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের কথা মাথায় রেখে রেললাইন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে হবে, এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। কালুরঘাটে বর্তমান ব্রিজের স্থানে রেলওয়ে ট্যাকসহ চার লেনের একটি নতুন ব্রিজ দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করবে। কর্ণফুলীর ওপারে রাঙাদিয়া হতে পারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্প নগরী। রাঙাদিয়া পয়েন্টে কর্ণফুলীর এপার-ওপার একটি টানেল একসময় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক প্রমাণিত হবে। স্বাধীনতার পর অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এবং হয়েছে বাস্তবায়িত। প্রকল্পগুলোর অনেকগুলোই দাতাদের চাপে কিংবা পরামর্শে হয়েছে। আমাদের যেখানে আগে প্রয়োজন সেখানে বিনিয়োগ হয়নি। যে কাজটি পরে করলেও চলত, সেখানেই বিনিয়োগ হয়েছে সবার আগে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে টাকা খরচ হয়েছে অনেক। দুর্নীতি গিলে ফেলেছে এসব বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশ।

দেশের উন্নয়ন হতে হবে অগ্রাধিকারভিত্তিক। চট্টগ্রাম এমন সম্ভাবনাময় জায়গা, যেখানে এক টাকা বিনিয়োগে ১০০ টাকা তুলে আনা সম্ভব। সংবিধানে ঘোষিত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ বা স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না নানা অজুহাতে। স্থানীয় সরকারকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। দেশের মোট বাণিজ্য এবং জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ জোগান দেয় চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে, ব্যবসায় অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এই আয় আরও বাড়বে।

আপনাকে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ তোমাকে ও বন্ধনকে।

  • প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৩ তম সংখ্যা, মে ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top