‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনো বাংলাদেশের অর্জিত অগ্রগতি সামান্যই’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র সম্পর্কে জানতে চাই?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বিদেশি কিংবা স্বদেশি সংগঠনের অর্থায়নমুক্ত। এটির মূল উদ্দেশ্য পরিবেশের ব্যাপারে সামাজিকভাবে মানুষকে সচেতন করা। এটি একটি সামাজিক উদ্যোগ। ২০০০ সালে বাপার জন্ম। জন্মের শুরু থেকেই পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার। দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পরিবেশ-সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে জন্ম বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র।
২০০০ সালের আগে বাংলাদেশে পরশ নামে একটি সংগঠন ছিল, যারা বিভিন্ন সময় পরিবেশের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব দেশপ্রেমিক বাঙালি, তারা মূলত নর্থ আমরিকা, সুইডেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইতালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে কাজ করে। তাদের উদ্যোগে গঠিত হয় বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক বা বেন। এই বেনের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হলো বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে। তারা চিন্তা করে দেখল বাংলাদেশে যে হারে পরিবেশদূষণ হচ্ছে এতে এর ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়েই মতপার্থক্য দূর করতেই নতুন একটি সংগঠন করার চিন্তা থেকেই জন্ম এমন সংগঠনের। এর আগে ২০০০ সালে আইসিবিএন দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন করে, যেখানে পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মূলত, সেটাই বাপার জন্মের সূতিকাগার হিসেবে কাজ করে। ২০১০ সালে নতুন করে সংশোধিত দলিলই হয় বাপার পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা।

বাপা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ কী কী?
মূলত পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাপার। আশির দশকে বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা ঘটে। নব্বইয়ের দশকে তা আরও অগ্রসর হয়। ‘পরিবেশ রক্ষা শপথ’ (পরশ) নামক সংগঠনের আওতায় দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এখানে সমবেত হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও পরিবেশরক্ষার উদ্দেশ্যে সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৯৮ সালে তারা ‘বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক’ (বেন) প্রতিষ্ঠা করে। পরশ, বেন এবং অন্য বহু পরিবেশসপক্ষ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ২০০০ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ‘বাংলাদেশের পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ (আইসিবিএন) অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দেশের সব পরিবেশসপক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তারই ফসল হিসেবে ২০০০ সালের জুলাই মাসে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’ (বাপা) গঠিত হয়।
এক যুগের বেশি সময় ধরে বাপা বাংলাদেশের পরিবেশরক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাপা এবং অন্যান্য পরিবেশসপক্ষ সংগঠনের প্রচেষ্টায় দেশে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও গৃহীত হয়েছে। সিসা বিমুক্ত গ্যাসোলিনের প্রচলন, দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনবিশিষ্ট যানসমূহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, জলাশয় রক্ষা আইন পাস, নদীবিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার অনুমোদন প্রভৃতি এরই কয়েকটি উদাহরণ।
কিন্তু এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে দেশের পরিবেশের অবক্ষয় অব্যাহত আছে। নদ-নদীর দখল এবং দূষণ বন্ধ হয়নি; উজানে পানি অপসারণের ফলে নদ-নদী অবক্ষয়ের প্রক্রিয়া আরও প্রকট হয়েছে; নদ-নদীর ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে লেনদেনে স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে; শিল্পদূষণ দিন দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে; বনাঞ্চল সংকুচিত হচ্ছে; জলাভ‚মি ভরাট হয়ে যাচ্ছে; জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে; রাসায়নিক কৃষিজনিত দূষণ অব্যাহত থাকছে; যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে; বিপজ্জনক কর্ম পরিবেশের কারণে লাখ লাখ শ্রমিকের স্বাস্থ্যহানি এবং শত শত শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটছে; খেলার মাঠ ও চিত্তবিনোদনের জন্য উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ বিরল হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে শিল্পায়ন এবং মাথাপিছু আয় বাড়া সত্ত্বেও দেশে স্বস্তির সঙ্গে বসবাস কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন জরিপে জীবনমানের দৃষ্টিকোণ থেকে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট শহর বলে বিবেচিত হচ্ছে। সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনো বাংলাদেশের অর্জিত অগ্রগতি সামান্যই, অথচ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন বিচারে বাংলাদেশই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব দিক বিবেচনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে বাপা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পরিবেশরক্ষায় ও জনসচেতনতায় কী ধরনের কাজ অথবা ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বিষয়ভিত্তিক বা গ্রুপ ওয়াইজ কাজ করে, যা নীতিমালা থেকে নেওয়া। ৩৩টি বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচি অথবা উপকমিটি আছে বাপার। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, নদীদূষণ এসব বাপার কাজের তাত্ত্বিক ভিত্তি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বাংলাদেশের বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, নদীদূষণ নিয়ে জনগণকে সোচ্চার করে তারা যেন নিজ অঞ্চলের বায়ু, পানি ও নদীদূষণ নিয়ে সচেতন হয়।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেসব ব্যক্তি আছেন, তাঁরা যেন সচেতন হন। পরিবেশ বাঁচাতে আইন করতে হবে, নীতিমালা করতে হবে, পুরোনো আইনের সংস্কার করতে হবে। এসব বিষয়ে বাপা তাদের পরামর্শ দেবে।
সামাজিক সংগঠন যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করে, তাদের সঙ্গে কাজ করবে দেশব্যাপী, এমনকি বিশ্বব্যাপী সে কাজের পরিধি ছাড়িয়ে দেবে। এসবের সঙ্গে যে কেউ যুক্ত হতে পারে। সেটা হতে পারে খেলার সংগঠন, এনজিও, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সিভিল সোসাইটি। বাপার সম্মেলনে শুধু বিশেষজ্ঞরা আসেন না, সেখানে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মতামত জানাতে পারেন। যেমন- বর্তমানে তিস্তাপারের মানুষেরা পানির জন্য হাহাকার করছে। তারা ইচ্ছে করলে তাদের কথা আমাদের মাধ্যমে সবাইকে জানাতে পারে। তেমনি সুন্দরবনের মানুষেরাও তাদের কথা বলতে পারে। আদিবাসী মানুষেরাও, যাদের নিয়ে আমরা এলাকাভিত্তিক আন্দোলন করি। এ ছাড়া এসব বিষয় নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনার করে থাকি। ২০০১ সালে আমরা সুন্দরবন নিয়ে সম্মেলন করি। সেখানে সুন্দরবনের কী কী করতে হবে তা বলা আছে। ২০০৪ সালে আমরা আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে সম্মেলন করি, সেখানে নদীগুলো অর্থাৎ যেসব নদীর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বাইরে কিন্তু বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে, এসব নদীর বিষয়ে আমরা কাজ করেছি। ২০০৫ সালে জ্বালানি নিয়ে সম্মেলন করি। এ সম্মেলনে জ্বালানি নীতিমালা তৈরি হয়। ২০০৭ সালে আদিবাসী বন রক্ষায় সম্মেলন হয়। ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন পাশাপাশি ২০১০ সালে সার্বিক বিষয় নিয়ে সম্মেলন করে বাপা। তবে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি।

রাজধানীর নদীগুলো দূষণ, দখল ও নাব্যতার সংকটে ভুগছে। এগুলো থেকে রক্ষা করে মৃতপ্রায় নদীগুলোকে কি আগের রূপ দেওয়া সম্ভব? যদি হয় তাহলে নদীগুলো কীভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবে?
রাজধানী যেভাবে বেড়ে উঠছে, সেটাকে কোনোক্রমেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এক অস্বাভাবিক বিভীষিকার মধ্যে বেড়ে উঠছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো। রাজধানীর আবাসন তৈরি করতে গিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীরা প্রত্যক্ষভাবে এবং সরকার পরোক্ষভাবে যে কথাগুলো বলতে চায়, মানুষের থাকার জন্য বাড়ি দরকার, উন্নয়ন দরকার, শহর সুন্দর করা দরকার, শিল্প-কারখানা করা দরকার। এ জন্য পরিবেশ নষ্ট হলেও এসব করতে হবে এ কথা মোটেও ঠিক না। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন আলোচনার পর জাতিসংঘ ঠিক করেছে, একটা নীতিমালা করেছে, যেখানে বলা আছে কোথাও পরিবেশ নষ্ট করে কোনো উন্নয়ন করা যাবে না। পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখেই উন্নয়ন করতে হবে। এ নীতিমালা যদি আবাসন ব্যবসায়ীরা এবং সরকার ফলো করে, তাহলে ঘরবাড়ি বা আবাসন করতে গিয়ে কোনো জলাশয় ভরাট করা, কোনো নদী ভরাট করার দরকার হবে না। তবে আমাদের ডেভেলপাররা এতই লোভী যে তারা কুখ্যাত ভূমিদস্যুতে পরিণত হয়েছে। আর এ ভূমিদস্যুদের কোনোক্রমেই ডেভেলপাররা বলব না, তারা আসলেই ভূমিদস্যু। তারা কোনো নীতিমালা এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। এই ডেভেলপাররা শহরে এবং শহরের বাইরে বাড়িঘরের জন্য টাকার নেশায় সব নষ্ট করছে। আমাদের কিন্তু নগরায়ণ বিষয়ে সম্মেলন হয়েছে, সেখানে আমরা নগরায়ণের নীতিমালা বিষয়ে বলেছি যে এভাবে করলে শহর সুন্দর থাকবে আর পরিবেশ ভালো থাকবে।
রাজধানীর বিভিন্ন খেলার মাঠ ও পার্ক দখল হয়ে যাচ্ছে, দখল ঠেকাতে আপনারা কী ধরনের ভূমিকা রাখছেন?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল গুলশান লেক ও ধানমন্ডির মাঠ নিয়ে সেই ২০০০ সালে। পরে ২০০১ ও ২০০২ সালে কাজ চলে। এখনো আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকাসহ বাইরের শহরের মাঠগুলোর কোনো সমস্যা থাকলে আমরা খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করছি। এ নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র স্টাডি টিম কাজ করছে। প্রতিবছর এই টিম কয়েকটি পার্ক, মাঠ নিয়ে কাজ করছে। একটি শহরের মধ্যে যত উন্নয়ন-সহায়ক পরিবেশ আছে, তার সব নিয়েই কাজ করে বাপা। এ নিয়ে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা শহরে শুধু রাস্তার আন্দোলন করি না, যেকোনো সময় সরকারের ডাকে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত সরকারের ১৪-১৫টি কমিটিতে মেম্বার, যেখানে বাপা নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। যখন নতুন নীতিমালা বা আইন হয় তখন সেগুলো আমাদের কাছে পাঠায় দেখে স্টাডি করে আমরা পরামর্শ দিই। আমরা সরকারের সঙ্গেই কাজ করি, আমরা বিরোধী আন্দোলনকারী নই। সরকারকে আমরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করছি। ঢাকার বাইরে কোন নদীকে কীভাবে দখলমুক্ত করতে হবে, কোন পার্কের উন্নয়ন করতে হবে সবকিছুর সঙ্গে বাপা জড়িত। আমরা সহায়তা দিচ্ছি এবং সরকারকে ব্যবহার করছি, যাতে তারা কাজগুলো করে। আমাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ‘চলনবিল আন্দোলন’ গোমতী নদী নিয়ে আন্দোলন, বড়াল নিয়ে আন্দোলন। এ ছাড়া ডাইকি ও ডাহুক নদী নিয়ে আন্দোলন আছে। এ ছাড়া কর্ণফুলী ও কক্সবাজারের বাঁশখালী নদী নিয়েও আমাদের আন্দোলন আছে। মূলত আমরা সমস্যা চিহিত করি, সরকারের কাছে বলি, জনগণের কাছে বলি, মিছিল-মিটিং করি, দাবি আদায়ের চেষ্টা করি।
একসময় বাপার অন্দোলন পলিথিন বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তা রোধ করা যায়নি, ক্রমেই বাড়ছে এর ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কী?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) পলিথিন নিয়ে কাজ করে সফল হয়েছে। পলিথিন রোধ করা গেছে। পলিথিন রোধ করেও সরকার এবং প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে পলিথিন বেআইনি হলেও মার্কেট থেকে সরানো যাচ্ছে না। কিন্তু বর্তমানে মানুষ অনেক সচেতন। শুধু সরকারের গাফিলতির কারণে এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রশাসনকে সোচ্চার হতে হবে, পলিথিন কারখানা বন্ধ করতে হবে। সরকার চাইলে এটা পারবে, আমি চাইলে পারব না।

নগরে পাবলিক স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে কীভাবে মোকাবিলা সম্ভব?
ঢাকাসহ সব জায়গাতেই স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভালো না। স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খারাপ হলে এটা নদী ও পানিদূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়াঁয়। সরকার সব সময় বড় বড় কথা বলছে যে স্যানিটেশনে আমাদের অর্জন ৭০-৮০ শতাংশ কিন্তু কাজের কাজ কিছু করছে না। শহর থেকে গ্রামে পর্যন্ত যদি ধরা যায় তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। সরকারের অবকাঠামোমূলক কাজ সে নিজে করুক বা এনজিও বা বিদেশি সংস্থা দিয়ে করাক, তবে এটা করতে হবে। বর্তমানে ঢাকা শহরের ৩০-৪০ শতাংশের বেশি স্যানিটেশন পরিষ্কার না। এখন ভাবুন ঢাকায় যদি না থাকে তবে কোথায় থাকবে? রাজধানীর গুলশানের মতো এলাকায় সব বর্জ্য লেকে ফেলা হয়। খিলগাঁও, বাসাবো এলাকার স্যানিটেশন এখনো পরিষ্কার হয়নি। সমগ্র শহরের ময়লা সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলা হয় তার ৭০ শতাংশ খোলা অবস্থায় থেকে পরিবেশকে দূষিত করছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো সচেতনতা। দেশে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সব লোককে সচেতন হতে হবে। এ জন্য সরকারের জনবল বাড়াতে হবে, প্রচার চালাতে হবে। বাপা এ নিয়ে অনেক বড় বড় কাজ করছে।
পরিবেশরক্ষার মাধ্যমে কীভাবে একটি সুন্দর নগর তথা একটি উন্নত দেশ গড়া সম্ভব?
উন্নয়ন পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে জড়িত। শুধু উন্নয়ন করলেই হবে না সেখানে যদি পরিবেশের ক্ষতি হয় সে উন্নয়নকে আমরা উন্নয়ন হিসেবে ধরতে পারি না। জাতিসংঘ থেকে টেকসই উন্নয়নের কথা বলেছে সেখানে পরিবেশ বাঁচিয়ে উন্নয়ন করতে হবে। কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা না থাকলে কাজ হবে না। অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা আনতে হবে, প্রশাসনকেও স্বচ্ছ হতে হবে, জনগণকেও সৎ হতে হবে, শুধু টাকা খরচ করে কিছুই হবে না।
সমাজের প্রতিটি মানুষ কীভাবে পরিবেশরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে?
মানুষ পরিবেশ ভালো রাখতে চায়। মানুষ যে সচেতন হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, তখনই বুঝি যখন মানুষ ফোন করে জানতে চায় পরিবেশের অবস্থা কেমন। তবে সরকারের দুর্বলতা, প্রশাসনের অদক্ষতা, নীতিমালায় ভুল, প্রশাসনের অসৎ আচরণ এ সংকটগুলোর ক্রণ, সরকার যদি এগুলো অতিক্রম করতে পারে, তবে সরকার ডাক দিলেই মানুষ আসবে। মানুষকে যদি বলা হয় সচেতন হতে, তখন তারা যদি দেখে প্রশাসনের মধ্যই গন্ডগোল, তারা সমাজবিরোধী লোকদের প্রশ্রয় দিয়ে সমাজবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে, গাছ কেটে বিক্রি করছে, তাহলে তো তাদের কথা জনগণ শুনবে না। দেশে প্রশাসনের মধ্যে কিছু পরিবেশপ্রেমিক মানুষের প্রয়োজন। তাহলেই পরিবেশ বাঁচিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়া সম্ভব।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র কাজের পরিসর অর্থাৎ দেশের কোথায় কোথায় এর কার্যক্রম রয়েছে এবং কীভাবে তা পরিচালিত হচ্ছে?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র সারা দেশে ২১টি শাখা আছে। প্রথমে শাখা খোলা নিষিদ্ধ ছিল। তাই ১৪ বছরে সংগঠনটির বেশি শাখা নেই। অনেক সুবিধাবাদী লোক আছে, যারা বাপাকে খারাপভাবে ব্যবহার করতে পারে স্থানীয়ভাবে ঝামেলায় ফেলতে পারে। আবার শাখাগুলো মেইনটেইন করতে অনেক টাকাপয়সারও প্রয়োজন। এ জন্য প্রথমে শাখা খোলা হয়নি গত তিন-চার বছর ধরে শাখা খোলার কাজ শুরু হয়েছে এর মধ্যেই আমরা ২১টি শাখা খুলে ফেলেছি। আশা করা হচ্ছে শাখাগুলো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। এর মধ্যে নানা কারণে অনেক শাখার কাজ আটকে আছে, এগুলোকে মুক্ত করতে হবে। আমরা সারা দেশে শাখা খোলার কাজে হাত দিয়েছি যাতে মানুষকে সচেতন করতে পারি। শুধু শাখা নয়, আমাদের ১৭টি বিভিন্ন বিষয়ক আন্দোলন সারা দেশে কাজ করছে।
পরিবেশরক্ষায় কাজ করতে গিয়ে আপনারা কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছে কি? আপনাদের কাজে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে কিছু বলুন?
পরিবেশরক্ষায় প্রথম বাধা জনগণের অসচেতনতা, সরকারের অসচেতনতা, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের অপকর্ম এবং পরিবেশবিরোধী ব্যক্তিদের বাধা। এখানে সমস্যা অন্য জায়গায়। বাপার চরিত্র, পরিচালনা পদ্ধতি, জন সম্পৃক্ততার ফলে প্রতিষ্ঠানটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সারা দেশের মানুষ বাপার কার্যক্রম সম্পর্কে জানে, এটাই বাপার সবচেয়ে বড় শক্তি। এখন খুব একটা বাধা নেই, এখন সময় শুধু কাজ করে যাওয়ার। এত কিছুর পরেও সব থেকে বড় বাধা মনে করে দুটি বিষয়কে।
প্রশাসনের অসচেতনতা
স্থানীয় মাস্তান, প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার অধিকাংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
তবে মজার বিষয় যে এখন জনগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সরকার যদি তাদের প্রতিনিধিদের সচেতন করতে পারে, তবে বাংলাদেশ পরিবেশরক্ষায় একটা মাইলফলকে পৌঁছাবে।
পরিবেশরক্ষায় আপনাদের অর্জন বা কাজের স্বীকৃতি কোথায় বলে আপনি মনে করেন?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র সব থেকে বড় অর্জন আমরা মানুষকে সচেতন করতে পেরেছি। পরিবেশ বলতে কী বোঝায় বাপা ১৪ বছর ধরে এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ ভালো না থাকলে মানুষ ভালো থাকতে পারে না এবং পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না। পরিবেশ নষ্ট হলে জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়। পরিবেশের ওপর জীবন নির্ভরশীল, তাই পরিবেশরক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ বাপার একটি বড় অর্জন।

এ ছাড়া খ্যাতি বলতে বিভিন্ন খেলার মাঠ, নদী দখলমুক্ত করা হয়েছে। যেমন- ধানমন্ডি মাঠ ২০০৪ সালে দখলমুক্ত করা হয়। আইনের মাধ্যমে তা পরিবেশবান্ধব করার চেষ্টা করছি। এ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর তারা সেখানে উন্নয়নের নামে মাঠকে দখল করে নিয়েছে। আর এ ধরনের জায়গায় আমাদের অর্জন হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা আমাদের সেই অর্জন রক্ষায় কাজ করছি। আমরা যখন পরিবেশ আন্দোলন শুরু করি, তখন রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্রে পরিবেশ নিয়ে কিছু বলা ছিল না কিন্তু এখন সব রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্রে পরিবেশ নিয়ে আলাদাভাবে বলা হয়। নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ নিয়ে আলাদা চ্যাপ্টার থাকে। আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ নিয়ে বিস্তর পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশ নিয়ে এখন সিনেমা, নাটক, গান তৈরি হচ্ছে, এটা অবশ্যই পজেটিভ দিক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কী? আরও কী ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে সংগঠনটির?
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র ২০১০ সালে নতুন যে ঘোষণাপত্র আছে, সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। সবকিছু পুরোপুরি অর্জন করতে না পারলেও অনেক ভালো অর্জন আমাদের গর্বিত করে। এটা বাপার গর্ব, এটা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের গর্ব। যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশের দিক দিয়ে অনেক সংকটে আছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশ যখন উন্নত দেশের মতো হবে, তখনো পরিবেশ আন্দোলনের দরকার হবে। সরকারকে ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সচেতন করা সব করেছি। এর মধ্যে বাপার অর্জন হলো ‘রাতারগুল’ জলাভূমিতে জেলেদের বন অধিদপ্তর লিজ দিয়েছিল মাছের ব্যবসা করার জন্য, বাপার সহায়তায় এটাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। আমরা এটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। ভবিষ্যতে বাপার এমন কাজ অব্যাহত থাকবে।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪