অনবদ্য শৈল্পিক স্থাপনা মেরিনা বে স্যান্ডস

সিঙ্গাপুরের মেরিনা সাগরের বুকে দুই পাশে বাঁকানো দুটি কলাম স্লাবের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া জাহাজসদৃশ্য এক রিসোর্ট ‘মেরিনা বে স্যান্ডস’। বিশ্বের অনেক নান্দনিক স্থাপনা যাঁর হাতের ছোঁয়ায় অনবদ্য বিশ্বখ্যাত, সেই স্থপতি মোসেহ সাফদির অন্যতম শৈল্পিক স্থাপত্য সৃষ্টি এই রিসোর্টটি। স্থাপনাটিকে কাছ থেকে না দেখলে সত্যিই বোঝা মুশকিল কী অপার বিস্ময় এই স্থাপনা কর্মটির মধ্যে লুকিয়ে। স্থপতি মোসেহ সাফদির সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রকৌশলী, ডিজাইনার, স্থপতি ও অন্যান্য শিল্পীর সমন্বিত দল স্থাপনাটির সঙ্গে পরিবেশ, আলোর খেলা, পানি আর বাতাসকে মিলিয়ে একাকার করেছেন। স্থাপনাটি সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের পর্যটন অর্থনীতিতে রাখছে অনন্য অবদান।

স্থাপনার ডিজাইন
কী আছে (কী নেই!) এই রিসোর্টে? নান্দনিক এই স্থাপনায় রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল ক্যাসিনো, যার আর্থিক মূল্য ৮ বিলিয়ন ডলার। রয়েছে ২ হাজার ৫৬১টি হোটেল রুম, ১৩ লাখ বর্গফুট কনভেনশন প্রদর্শনী সেন্টার, ৮ লাখ বর্গফুটের শপিংমল, একটি জাদুঘর, দুটি বিশাল নাট্য প্রদর্শন হল, রেস্তোরাঁ, দুটি ভাসমান ক্রিস্টাল প্যাভিলিয়ন, স্কেটিং জোন, অসংখ্য সুইমিংপুল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আটরিয়াম ক্যাসিনো, যেখানে রয়েছে ৫০০টি টেবিল ও ১৬০০ স্লট মেশিন। পুরো কমপ্লেক্স ১ হাজার ১২০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন, যার ধারণক্ষমতা প্রায় ৩ হাজার ৯০০ জন।

জাদুঘরে রয়েছে দুটি ভাগ। বেসটি মাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওপরে সাগরের পানিকে ঘিরে রেখেছে। যেন সমুদ্রের মাঝে দৈত্যাকৃতির এক ‘পদ্মফুল’। ফুলটির রয়েছে ১০টি পাতা, যা দূর থেকে দেখে মনে হয় পুকুরের মধ্যে ভাসছে; একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত দুলছেও। প্রতিটি পাতা মাথা বরাবর উঠেছে যেন আকাশছোঁয়ার চেষ্টায় রত। অসাধারণ আলোর বিন্যাসযুক্ত পাতাগুলো যেন কৌত‚হলী পর্যটকদের কাছে ডাকছে। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য রয়েছে উন্মুক্ত স্বচ্ছ কাচের সারি যুক্ত আসন। সর্বমোট তিনটি স্তরের গ্যালারি আছে প্রায় ছয় হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে। জাদুঘরের মধ্যখানে ভরা যে ঝরনা আছে, তার পানি বৃষ্টির পানি থেকে সংগৃহীত। জাদুঘরটি ৬০ মিটার করে ১০টি কোণে যুক্ত, যা নিচে একটি ঝুড়িসদৃশ স্থাপনার ন্যায় স্থাপিত। আকাশচুম্বী এই স্থাপনায় রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এলিভেটেড সুইমিংপুল, যার দৈর্ঘ্য ৪৭৮ ফুট এবং বিস্তার ১৯১ মিটার জায়গাজুড়ে। সুইমিংপুলটি ৪ লাখ ২২ হাজার পাউন্ড স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি, যেখানে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ গ্যালন পানি অনায়াসে সাঁতার কাটার উপযোগী করে রাখা।

টপরুফে সুবিশাল সুইমিং পুল

স্থাপনাটিতে অসংখ্য গাছ এবং উন্মুক্ত জায়গা আছে, যেখান থেকে পুরো সিঙ্গাপুর স্কাইলাইনকে ৩৬০০ অ্যাঙ্গেল থেকে অবলোকন করা যায়। পুলটি চারটি ঘুরন্ত জোড়া দ্বারা সংযুক্ত এবং প্রতিটি জোড়ার আছে স্বতন্ত্রভাবে নির্দিষ্ট অক্ষে ঘোরার সক্ষমতা। পুরো পুলটি ৫০০ মিলিমিটার অবধি ঘোরানো সম্ভব। বাতাসের বেগের সঙ্গে আকাশছোঁয়া পুলটিকে শান্ত ও সচল রাখতে প্রায় ৫০০ আলাদা আলাদা পয়েন্টে জ্যাকযুক্ত পা সংযোগ করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মূল স্থাপনাটির সঙ্গে।

কপিংয়ে আগ্রহী প্রতিটি ব্যক্তির জন্য এখানে প্রায় ১০ লাখ বর্গফুটজুড়ে পসরা সাজিয়ে রেখে ৩০০ শোরুম, ঋ্ ই আউটলেট এবং বুটিক হাউস। আর এই শোরুমগুলোর মধ্য দিয়ে অবিকল লাসভেগাসের ভেনেটাইনের মতো একটি খাল প্রবাহিত হয়েছে। ফলে ক্রেতারা নদীর পাড় ধরে কেনাকাটার এক বিমল আনন্দ পান। ক্রেতা এবং বেড়াতে আগ্রহী পর্যটকদের জন্য রয়েছে সাম্পানে চড়ে ঘোরার সুব্যবস্থা।

স্থাপনার নেপথ্য-কথন
মেরিনা বে বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিদ¦›দ্বীমূলক নির্মাণ প্রকল্প, যা একই সঙ্গে সর্বাধিক ব্যয়বহুল রিসোর্ট। যেখানে ক্যাসিনো থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলার লভ্যাংশ পাওয়া যায়। রিসোর্টটি উন্মুক্ত হওয়ার দুই মাসের মাথায় প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার দর্শনার্থী এটি পরিদর্শন করে। দেশীয় অর্থনীতিতে এর অবদান প্রায় ০.৮ শতাংশ। এখানে প্রায় ১০ হাজার লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত আর প্রায় ২০ হাজার কাজ খুঁজতে আসা লোকের জীবন-জীবিকার উৎসও এটি।

স্থাপনার আভ্যন্তরিন লেক

নির্মাণের যত চ্যালেঞ্জ
মেরিনা বে স্যান্ডস রিসোর্ট জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার কথা ছিল ২০০৯ সালে। কিন্তু নির্মাণব্যয় বাড়ায় সাময়িক আর্থিক সংকটে পড়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। পিছিয়ে যায় গ্র্যান্ড ওপেনিং বা শুভ উদ্বোধনের তারিখ। প্রায় ২৭ এপ্রিল ২০১০ অবধি এবং অফিশিয়ালি ২৩ জুন ২০০০ সনে পুনর্নির্ধারিত হয় গ্র্যান্ড ওপেনিংয়ের এবং যা দুই দিনব্যাপ্তি সুবিশাল আয়োজন এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয়। পরে সব অংশের কাজ শেষ হওয়ার পর আবারও গ্র্যান্ড ওপেনিং হয় প্রায় এক বছর পর ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে। প্রমোদ আর উপভোগের আকাশছোঁয়া স্কাই পার্কটি খুলে দেওয়ার পর ৩০ নভেম্বর থিয়েটারে প্রথম প্রদর্শিত হয় ‘রিভার ড্যান্স’। স্কেটিং রিংয়ের মধ্যে কৃত্রিম বরফ জমিয়ে তৈরি করা প্লটটিতে প্রথম প্রদর্শনী শো দেখান মিশেল কাওয়ান, ১৮ ডিসেম্বর। আর মেরিনা বে স্যান্ডস রিসোর্ট নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে ‘চমৎকার’ ১৩ মিনিটের আলোকচ্ছটায়। লেজার ও পানি দ্বারা সৃষ্ট এই শোর মাধ্যমে পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে মেরিনা বে স্যান্ডস রিসোর্ট আত্মপ্রকাশ করে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১-এ।

খন্দকার নাসরিন আখতার
[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৬ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top