ব্যবসায়িক পণ্যের প্রচার, প্রতিষ্ঠান পরিচিতি বা কোম্পানির ব্র্যান্ডিংয়ে বিজ্ঞাপনই সবচেয়ে আকর্ষণীয় পন্থা। তাই ক্রেতা বা ভোক্তাকে আকৃষ্ট করতে কোম্পানিগুলোও চোখ ধাঁধানো সব বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ডকে। দিনে সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপনগুলো স্বাভাবিকভাবে দেখা গেলেও, রাতে দেখতে বাতি বা টিউব লাইটের ব্যবস্থা করতে হয়। ফলে প্রয়োজন হয় বিদ্যুতের। চরম বিদ্যুৎ ঘাটতিতে যখন দেশ তখন সাইনবোর্ডে বিদ্যুতের ব্যবহার রীতিমতো চিন্তার বিষয়। বিশ্বব্যাপী তাই বিজ্ঞাপনের এ ধরনের ব্র্র্যান্ডিংয়ে এসেছে নতুনত্ব, এসেছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। দেরিতে হলেও বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি নিয়ন সাইন প্রযুক্তির ব্যবহার; যার ফলে একদিকে সাশ্রয় হবে বিদ্যুতের, অন্যদিকে অর্থের। সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন স্থানে এলইডি নিয়ন সাইন সংযোজনে বিজ্ঞাপনই হয়ে উঠবে আরো জ্বলজ্বলে, দ্যুতিময় ও আকর্ষণীয়।
বিশ্বে বৈদ্যুতিক বাতির সূচনা আঠারো শতকে। বাতিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ডিভাইসে বিদ্যুতের যোগান দিতে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ। গ্যাস, কয়লা, পারমাণবিক ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই সাধারণত উৎপাদন করা হয় বিদ্যুৎ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্গত হয় প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড। তাছাড়া বৈদ্যুতিক বাতির বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই ধারাবাহিকভাবেই এই বাতিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করতে নেওয়া হয়েছে নানা পরিবর্তন। দিনে দিনে বেড়েছে এর কার্যকারিতা ও ক্ষমতা। অবশেষে বাতিগুলো হয়ে উঠেছে অধিক উজ্জ্বল, সাশ্রয়ী, দীর্ঘস্থায়ী, হালকা ও পরিবেশবান্ধব। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বাতিগুলো যেন অত্যন্ত কম বিদ্যুতে চলতে পারে করা হয়েছে সে ব্যবস্থাও।

১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড খরচ হয় :
উৎপাদন মাধ্যম কার্বন ডাই-অক্সাইড (গ্রাম)
কয়লা. ৮০০-১০৫০
প্রাকৃতিক গ্যাস. ৪৩০
নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট. ৬
হাইড্রোইলেকট্রিক. ৪
কাঠ. ১৫০০
ফটোভোল্টেনিক. ৬০-১৫০
বায়ু. ৩-২২
এলইডি নিয়ন সাইনের যত সুবিধা
বৈদ্যুতিক বাতির জগতে এলইডি নিয়ন বাতি নতুন এক যুগের সূচনা করেছে। বিশ্বজুড়ে পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বাজারে প্রচলিত বাতির তুলনায় এই বাতি প্রায় ৯০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ খরচ করে। এ ছাড়াও অন্য বাতির তুলনায় এর স্থায়িত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। গবেষণাগারে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এলইডি নিয়ন বাতিই অধিক বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই বাতি পরিবেশবান্ধব, দীর্ঘস্থায়ী ও অধিক গতি সম্পন্ন। অন্য বাতিগুলো প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ খরচ করলেও তার সদ্ব্যবহার করতে পারে মাত্র ৫ শতাংশ। কিন্তু এলইডি নিয়ন বাতি অল্প বিদ্যুতেই জ্বালাতে পারে অধিক আলো। বিদ্যুৎ ঘাটতিতে যখন পুরো দেশ, তখন প্রযুক্তিটির এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে প্রথমবারের মতো গ্রীন ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশে এনেছে এলইডি নিয়ন সাইন। প্রতিষ্ঠানটি দেশে এলইডি সাইন অ্যান্ড নিয়ন নামে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের সাইনবোর্ডে প্রযুক্তিটি সংযোজনের কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক অবস্থায় এই প্রযুক্তিটিকে দীর্ঘদিন যাচাই-বাছাইয়ের পরই বাজারে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যেই মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইউসিবিএল, ইস্টার্ন ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ডে শোভা পাচ্ছে তাদের এই এলইডি নিয়ন সাইন। ইস্টার্ন ব্যাংকের সাইনবোর্ডগুলোর উপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, মাত্র একটি সাইনবোর্ডে টিউব লাইটের পরিবর্তে এলইডি নিয়ন ব্যবহারে বছরে প্রায় ১৯৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব। ব্যাংকটির ৬৪টি শাখার সাইনবোর্ডগুলোতে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩০০০ মেগাওয়াট। ব্যাংকটির বর্তমান হিসাব মতে, এই এলইডি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রায় ৬৮ শতাংশ বিদ্যুৎ কম ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘একটি প্রতিষ্ঠানের চিত্রই যখন এই তা হলে সারা দেশের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডগুলোতে যদি এলইডি নিয়ন সাইন সংযোজন করা যায় তবে এ দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেকটাই মোকাবেলা করা যাবে।’ এ আশাবাদ গ্রীন ওয়ার্ল্ডের টিম লিডার হেদায়েতুল ইসলাম হেলালের।

এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞাপনে কাচনলের ভেতর গ্যাস ঢুকিয়ে জ্বালানো নিয়ন বাতি ব্যবহার করা হয়। এই বাতির বিভিন্ন ত্রুটি থেকেই এসেছে এলইডি নিয়ন। একটি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিংয়ে তাদের নাম ও লোগোর পরিচিতিই মুখ্য। কিন্তু প্রচলিত সাইনবোর্ডগুলোতে এর বাইরেও আলোকিত করার প্রয়োজন পড়ে। কেননা সেখানে থাকে টিউব লাইটও। সাইনবোর্ডগুলোতে সাধারণত ২-২০টি টিউব লাইট ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর প্রয়োজন খুব বেশি না হলেও প্রযুক্তিমুখী না হওয়ায় এত সংখ্যক টিউব লাইট ব্যবহার করতে হচ্ছে। এর বিপরীতে এলইডি নিয়ন বাতি দিয়ে প্রয়োজনানুয়ায়ী আলোকসজ্জা করা যায়। যেখানে একটা টিউব লাইটে বিদ্যুৎ প্রয়োজন ৬০ ওয়াট সেখানে এলইডি নিয়নে ১০-১২টি স্পটিংয়ে ব্যয় হয় মাত্র ১.৫-২ ওয়াট। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ বর্গফুটের একটি সাইনবোর্ডে প্রায় ৩২টি টিউব লাইট প্রয়োজন। এতে তৈরি হয় ২৪৩২০ লুমেন । কিন্তু একই স্থানে এলইডি নিয়ন বাতি লাগে ৩৭৮০টি, যা তৈরি করে প্রায় ২৬০০০ লুমেন। ফলে সাইনবোর্ডটির ঔজ্জ্বল্য বাড়ে অধিকমাত্রায়। তা ছাড়া যেখানে ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাইটের লুমেন প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে কমে সেখানে এলইডিতে এই পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। বিদ্যুৎ খরচের দিক থেকে প্রতিটি টিউব ৫৮.৩ ওয়াট খরচ করলে বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৪০৪ কিলোওয়াট ইউনিট। কিন্তু এলইডি একই ক্ষেত্রে খরচ করছে মাত্র ৩১০ কিলোওয়াট ইউনিট।
আগে এলইডি নিয়ন ব্যবহার করা হতো গাড়ির মিটার বা ইন্ডিকেটরের বাতিতে। পর্যায়ক্রমে মোবাইল ফোন, টিভির স্ক্রিন, ইনফ্রারেড রশ্মি, আলোকসজ্জা, ট্রাফিক সিগন্যাল, কম্পিউটারের মাউস, লেজার রশ্মিসহ বিভিন্ন স্থানে এর ব্যবহার শুরু হয়। এসব স্থানে স্পটিংয়ের মাধ্যমে এলইডি নিয়নের ব্যবহার হয়। স্পটিং করার প্রধান উদ্দেশ্যই বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু আলো ব্যবহার করা। এটি এমনই এক প্রযুক্তি যাতে বিশেষ স্থানে লাইটিং করলেই পুরো বিজ্ঞাপনটিই আলোকময় মনে হয়। তা ছাড়া স্পটিংয়ে আলোর উজ্জ্বলতা কম-বেশিও করা যায়। সাধারণত ব্যাক লিড, বিল্কিং অর্থাৎ জ্বলা-নেভা ও বর্ণের মাধ্যমেই সাইনবোর্ডগুলোকে সাজানো হয়। এই বোর্ড তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে পিভিসি বোর্ড, অ্যাক্রিলিক পেস্ট, ভিনাইল, এসএস, এমএসসহ অন্যান্য উপাদান। এসি ও ডিসি উভয়ভাবেই এটি চালানো যায়। প্রতিটি সিস্টেম পরিচালনায় সংযোজিত আছে একটি ফিউজ। যদি কখনো কোনো সমস্যা হয় তাহলে ফিউজেরই সমস্যা হবে, মূল সিস্টেমের নয়। এলইডি সাইন অ্যান্ড নিয়ন প্রতিষ্ঠানটি দেশে দক্ষতার সাথে এ কাজটি পরিচালনা করছে। তারা যে শুধু এটা সংযোজন করছে তা কিন্তু নয়, পাশাপাশি এগুলো যেন যথাযথভাবে কাজ করে সেদিকেও রাখছে সজাগ দৃষ্টি। যেখানে টিউব লাইটের কোনো ওয়ারেন্টি নেই সেখানে তারা এলইডি নিয়ন বাতির ক্ষেত্রে এক বছরের রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি দিচ্ছে। প্রথম এক বছর এই সেবা ছাড়াও তিন বছরের সার্ভিসিং ওয়ারেন্টি দেওয়া হয়। তবে তাদের অভিজ্ঞতা বলে এই প্রযুক্তিতে ৩ বছর পরেও তেমন কোন সমস্যা হয় না। ইতোমধ্যে যে সাইন কিংবা বিলবোর্ডে এটি সংযোজন করা হয়েছে সেখানে একদিনের জন্যও কোনো সমস্যা হয়নি। তা ছাড়া মাঠ পর্যায়ে তারা প্রতিনিয়ত তাদের সাইনবোর্ডগুলো পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। পানি রোধক বিধায় এলইডি নিয়ন বোর্ডগুলোর প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোনো সমস্যা হয় না। ধুলাবালিতেও তেমন ক্ষতি হয় না। প্রতিষ্ঠানটি দু’ ধরনের এলইডি নিয়ন সাইন তৈরি করছে। একটি কাছ থেকে, অন্যটি দূর থেকে দেখার জন্য। ইতোমধ্যেই ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের এই ব্যাক লিড সাইন ব্যবহারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। গ্রীন ওয়ার্ল্ডের টিম লিডার হেদায়েতুল ইসলাম হেলালের মতে, ‘কর্পোরেট হাউজগুলো যদি এভাবে এগিয়ে আসে তাহলে অন্যরাও এটি ব্যবহারে আগ্রহী হবে। ফলে প্রতিটি ছোট আকারের একটি সাইনবোর্ড থেকেও প্রতিদিন অন্তত ৫০-৬০ ওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে, যা দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে রাখবে অনন্য অবদান।’

কাচনল নিয়ন
বিজ্ঞাপনকে আরও আকর্ষণীয় ও বর্ণিল রূপদানে প্রচলন ঘটেছিল নিয়ন প্রযুক্তির। বায়ুরোধী কাচের নলে নিয়ন গ্যাস ভরে উচ্চ বিভবের তড়িৎ সৃষ্টির মাধ্যমে জ্বালানো হয় এর আলো। কিন্তু তাতে অনেক ত্রুটি দেখা যায়। গ্যাস কমে গেলে এর ঔজ্জ্বল্য আর আগের মতো থাকে না। কখনো কখনো এটির কিছু অংশ নষ্টও হয়ে যায়। এটা সংস্কার করাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া এর ভেতরে থাকে বিষাক্ত পারদ। এই বাতি কখনো ভেঙে গেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ দেশেই এর ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশ এই প্রযুক্তি থেকে বেরিয়ে বেছে নিয়েছে এলইডি নিয়ন প্রযুক্তিকে।
ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ওএলইডি
এলইডি নিয়ন প্রযুক্তির হাত ধরেই আসতে যাচ্ছে নতুন প্রযুক্তি ‘অরগানিক লাইট ইমেটিং ডায়োড’ বা ওএলইডি। তবে এখনও তা সহজলভ্য নয় তদুপরি অত্যন্ত ব্যয়বহুলও। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে আলোর অন্যতম উৎস হতে পারে, যা টিভির স্ক্রিন, কম্পিউটারের মনিটর ইত্যাদির জন্য হবে দারুন উপযোগী। তবে এই প্রযুক্তি পেতে হয়তো অনেক সময় লেগে যাবে। এর আগে এলইডি নিয়ন প্রযুক্তির অধিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও ঘাটতির ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করেছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নানা প্রযুক্তি। এর পাশাপাশি নিষিদ্ধ করেছে অধিক বিদ্যুৎব্যয়ী বাতিসহ নানা উপকরণ। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, চীন এমনকি ভারতসহ বেশ কিছু দেশ এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, অনেক দেশ বাস্তবায়নও করেছে। বাংলাদেশেও সাইন ও বিলবোর্ডগুলোতে বিদ্যুতের পরিবর্তে সোলারের সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশার বিষয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম ইপিজেডে তৈরি হচ্ছে এলইডি নিয়ন বাতি। কিন্তু এ দেশে এটি ব্যবহারের ব্যাপারে নেওয়া পদক্ষেপ এখনও যথেষ্ট নয়। যদি এ দেশের সর্বত্র এলইডি নিয়ন সাইনের ব্যবহার বাড়ানো যায় তবে একদিকে যেমন সাশ্রয় হবে বিদ্যুতের অন্যদিকে তা হবে আরো পরিবেশবান্ধব।
সারোয়ার কবির
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩