মাটির লিকুইফেকশন এমন ধরনের ঘটনা, যাতে বালুযুক্ত মাটি আংশিক বা সম্পূর্ণ ভেজা অবস্থায় এর শক্তি ও দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে। ফলে যেকোনো ধরনের প্রযুক্ত চাপের বিপরীতে এর প্রতিরোধক্ষমতা বা চাপধারণক্ষমতা থাকে না। সাধারণ ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট মাটির কম্পন বা অন্য যেকোনো ধরনের হঠাৎ পরিবর্তনজনিত কারণে নির্দিষ্ট স্থানের মাটির চাপধারণক্ষমতা হারিয়ে পানির মতো আচরণ শুরু করে।
মৃত্তিকা বিজ্ঞানী হ্যাজেন (Hazen) প্রথম Soil Mechanics-এ লিকুইফেকশন শব্দটির ব্যবহার করেন ১৯১৮ সালে। ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালভারাস বাঁধের ভাঙনের কারণ হিসেবে তিনি লিকুইফেকশন শব্দটির ব্যবহার করেন।
লিকুইফেকশন মানুষ, সম্পদ ও বিভিন্ন প্রাণীর বিরাট ও ব্যাপক ক্ষতি করে। এর মারাত্মক ক্ষতির প্রভাব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দৃশ্যমান। উথা (Utah) শহরের ভূমিকম্পে লিকুইফেকশন হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৩৪ সালে হ্যানছেল (Hansel) উপত্যকায় এবং ১৯৬২ সালে চেহ (Cache) উপত্যকায় ভূমিকম্পের প্রভাবজনিত কারণে লিকুইফেকশন পরিলক্ষিত হয়। ওস্টাটেজ ফ্রন্ট (Wasatch Front) উপত্যকায় লিকুইফেকশন সৃষ্টির আশঙ্কা অনেক বেশি। কারণ, এখানকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের অবস্থান কাছাকাছি। এখানকার মাটি খুব সহজেই অন্য যেকোনো কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা ছাড়া এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
লিকুইফেকশনের ব্যাপক ও বিশাল প্রভাব বেশ আগ থেকে অনুধাবন বা জানা থাকলেও প্রকৌশলীদের জন্য এটা চিন্তা বা বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ১৯৬৪ সনের নিগানা (Niigata) ভূমিকম্প ও আলাস্কা (Alaska) ভূমিকম্পের পর থেকে। তা ছাড়া ১৯৮৯ সালের লোমা প্রিয়েটা (Loma Prieta) ভূমিকম্পের সময় সান ফ্রানসিসকো মেরিনা (Sun Francisco Marina) শহরের ব্যাপক ধ্বংসের একটা প্রধান ও অন্যতম কারণ লিকুইফেকশন। তা ছাড়া খুব নিকটবর্তী সময়ে Christchurch-এর আবাসিক অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ধ্বংসের সম্মুখীন হয় এরই প্রভাবে, যা ২০১০ সালের মধ্যভাগে নিউজিল্যান্ডের বড় ধরনের ভূমিকম্পের কারণেই ঘটেছে।

লিকুইফেকশন সংঘটিত হওয়ার কারণ ও স্থান
যেকোনো স্থানে লিকুইফেকশন সংঘটিত হওয়ার জন্য দুটি প্রধান কারণ রয়েছে।
১. ওই স্থানের মাটি ০ থেকে ৩০ ফুট নিচে পর্যন্ত অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে হবে। যেমন- ওই স্থানের মাটি অনেক বেশি আলগা (Loose), মাটির কণাগুলোর মধ্যবর্তী স্থান সম্পূর্ণরূপে পানি দিয়ে পূর্ণ থাকতে হবে (Saturated Soil) এবং ওই স্থানের মাটি অবশ্যই Sandy হতে হবে।
২. দ্বিতীয় ভূমিকম্পের দরুন সৃষ্ট মাটির কম্পন অবশ্যই এই সংবেদনশীল মাটিকে লিকুইফাইড করতে সক্ষম এমন শক্তিসম্পন্ন হতে হবে। যেকোনো অঞ্চলের মাটি যদি এ শর্ত পূরণ করে। তবে ওই অঞ্চলের মাটির লিকুইফাইড হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। উথা (Utah) প্রদেশের কেন্দ্র উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসমূহ সব থেকে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এই অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি, সংবেদনশীল মাটি এবং স্থানীয় এবড়ষড়মু বিচার করে দেখা যায় যে এই অঞ্চলসমূহের ভূমিকম্পের দরুন লিকুইফেকশন সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা বা আশঙ্কা অনেক বেশি। কিন্তু সাধারণত সব থেকে সংবেদনশীল মাটি নদীর গতিধারা বরাবর এবং খালের পানি প্রবাহের স্থান বরাবর থাকে। তা ছাড়া বিভিন্ন পুরোনো নদী এবং খালের মাটি অনেক সময় সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ফলে ওই সব স্থানে লিকুইফেকশন সংঘটিত হয়।
লিকুইফেকশনপ্রবণ অঞ্চল নির্ধারণ
কোনো স্থানকে লিকুইফেকশন কার্যকর (Potential) অঞ্চল হিসেবে গণ্য বা নির্ধারণের জন্য ওই স্থানের ভূমিকম্পের ১০০ বছরের মানচিত্র সংগ্রহ করে দেখতে হবে যে ওই ভূমিকম্পসমূহ লিকুইফেকশন সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী কি না। উচ্চ লিকুইফেকশন কার্যকর অঞ্চল মানে ওই স্থানে ১০০ বছরের মধ্যে ৫০ ভাগ আশঙ্কা রয়েছে এমন ভূমিকম্প সংঘটিত করার, যা মাটিকে লিকুইফাইড করে ফেলতে পারে। মাঝারি ধরনের লিকুইফেকশন কার্যকর অঞ্চলে এ ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা ১০ থেকে ৫০ ভাগের মতো। নিম্ন কার্যকর অঞ্চলে এই আশঙ্কা ৫ থেকে ১০ ভাগের মতো এবং খুবই নিম্ন কার্যকর অঞ্চলে এই আশঙ্কা ৫ ভাগের কম।
লিকুইফেকশন সংঘটন
লিকুইফেকশন সাধারণত আলগা (Loose) মাটি, সম্পূর্ণ বা আংশিক ভেজা মাটি। অর্থাৎ যেসব মাটি কণার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ থাকে এবং যেসব মাটির Drainge ব্যবস্থা খুবই খারাপ, সেসব স্থানে লিকুইফেকশন সংঘটিত হয়। সাধারণভাবে ঢেউয়ের লোড ভূমির কম্পন লোডের কারণে আলগা বালুযুক্ত মাটির আয়তন অনেকখানি কমে যায়। যার ফলে মাটির কণার মধ্যে অবস্থিত পানিতে চাপ অনেকাংশে বেড়ে যায়। অনবরত এই চাপ বৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে মাটির শেয়ারক্ষমতা হ্রাস পায়।
লিকুইফেকশন সংবেদনশীল মাটি সাধারণত নতুন আলগা বালু বা সিল্ট। যাদের আকার-আকৃতি অনেকাংশে একই রকম। এসব মাটির লেয়ার কমপক্ষে ১ মিটার পর্যন্ত পুরু এবং সম্পূর্ণরূপে পানিতে সিক্ত থাকে। এ ধরনের মাটির আস্তরণ সাধারণত নদীর চ্যানেল বরাবর সমুদ্রসৈকতে দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে সাধারণত বাতাসের প্রভাবে ভেসে আসা বালু ও সিল্টের আস্তরণ সৃষ্টি হয়। সমুদ্র বা নদীর পাড়ের লিকুইফেকশনের খুব ভালো উদাহরণ হচ্ছে চোরাবালি (Quick Sand)।
মাটি কণাসমূহের প্রাথমিক Void-এর অনুপাতের ওপর নির্ভর করে মাটির কণাসমূহের এ ধরনের প্রসারণ (Strain) দেখা দিতে পারে। প্রথমত, মাটির কণাসমূহের Strain-Softening দ্বিতীয়ত, মাটির কণাসমূহের Strain-Tardening, Strain-Soften মাটি হচ্ছে আলগা বালুযুক্ত মাটি। যদি প্রযুক্তি শেয়ার চাপ মাটির শেয়ার স্ট্রেন্থের তুলনায় বেশি হয় সে ক্ষেত্রে ফ্লো (Flow) লিকুইফেকশন সংঘটিত হয়। যেখানে মাটির শেয়ার ধারণক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং মাটি একসময় ফেল করে। অপর দিকে Strain Harden মাটি হলো অধিকতর ঘন (Dense) বালুযুক্ত মাটি। এসব মাটির ক্ষেত্রে ফ্লো লিকুইফেকশন কখনো সংঘটিত হয় না। সাইক্লিক লোডিংয়ের (Loading) সময় মাটির ভেঙে পড়া সাধারণত মাটির ঘনত্বের (Density) ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া সাইক্লিক লোডিংয়ের সময়কাল এবং শেয়ার স্ট্রেস (Stress)-এর কী পরিমাণ রিভার্স (Reverse) করে, মাটির ফেল অনেকাংশে এর ওপর নির্ভর করে। যদি Stress Reversal সংঘটিত হয়, তাহলে মাটির চাপধারণক্ষমতা কোনো একসময় শূন্যতে নেমে আসতে পারে। তখন সাইক্লিক লিকুইফেকশন সংঘটিত হয়।
লিকুইফেকশনের ক্ষতিকর প্রভাব এত ব্যাপক ও বিস্তৃত, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু মাটির লিকুইফেকশনেরও একটা ভালো দিক রয়েছে। কোনো স্থানে ভূমিকম্পের ফলে লিকুইফেকশন সংঘটিত হলে ওই স্থানে অন্য কোনো ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কাকে অনেকাংশে হ্রাস করে। এর কারণ হচ্ছে, পানি বা লিক্ইুড (Liquid) কোনো ধরনের শেয়ারের চাপকে (Shear Stress) সমর্থন করে না। তাই যদি ভূমির কম্পনের ফলে মাটির একবার লিকুইফাইড হয়ে যায়, ভূমির অন্য কোনো ধরনের কম্পনের কোনো প্রভাব মাটির ওপরে অবস্থিত বিল্ডিংয়ে অনুভূত হয় না।
লিকুইফেকশনের প্রভাব
মাটির লিকুইফেকশনের যেসব বিল্ডিংয়ের ভিত্তি (Foundation) সরাসরি বালুর ওপর নির্মিত ওই সব স্থানের বালুযুক্ত মাটি যদি লিকুইফেকশনের সম্মুখীন হয়, তাহলে ওই বিল্ডিংটি হঠাৎ করেই তার লোড বহনকারী সাপোর্টটি হারায়। যার ফলে মূল ভবনটি অসামঞ্জ্যপূর্ণ (Irregular) Settlement-এর সম্মুখীন হয়। ফলে বিল্ডিংয়ের মূল কাঠামো ধ্বংসের মুখে পড়ে। যার মধ্যে ভিত্তির (Foundation) ফাটল, বিল্ডিংয়ের ওপরের কাঠামোর ভাঙনও অন্তর্গত। তা ছাড়া বিল্ডিংয়ের ভিত্তির সাপোর্ট প্রদানকারী বালু বা মাটি লিকুইফাইড হয়ে গেলে সম্পূর্ণ ভবনটি মাটির মধ্যে বসে যেতে পারে এ ক্ষেত্রে ভবনটির কাঠামোগত কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন ছাড়াই। যেসব স্থানের মাটিতে কিছুটা অংশ নন-লিকুইফাইড থাকে, সেই সব স্থানে Punching Shear-এর মতো ভিত্তির ফাটল দেখা দেয়। তা ছাড়া ভবনের অসামঞ্জ্যপূর্ণ Settlement-এর প্রভাবে ভিত্তির নিচে অবস্থিত Utility লাইনসমূহ ধ্বংস বা এর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
তা ছাড়া লিকুইফেকশনের ফলে মাটির যে ঊর্ধ্বমুখী চাপের সৃষ্টি হয়। তার ফলে ভবনের ভিত্তি স্লাবে ফাইল বা ভাঙন দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া এই সকল ফাটল দিয়ে পানি ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে ইলেকট্রিক সংযোগ ও ভবনের স্থায়িত্ব প্রদানকারী বিভিন্ন উপাদানের ক্ষতি সাধন করতে পারে। ফলে ভবনের স্থায়িত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে।
ব্রিজ, আকাশচুম্বী বা সুউচ্চ ভবনগুলোতে সাধারণত পাইলের (Pile) ভিত্তি নির্মাণ করা হয়। লিকুইফেকশনের প্রভাবে এসব পাইলের ভিত্তি চারপাশের মাটির সাপোর্ট হারিয়ে ফেলে এবং বেঁকে যায় অথবা কিছুটা কম্পনের পর আবার স্থির অবস্থায় চলে আসে।

ঢালযুক্ত মাটি এবং খাল বা নদীর তীরবর্তী মাটিতে লিকুইফেকশন সংঘটিত হলে ওই স্থানের মাটি Slide করে ধসে যায়। ফলে বড় ধরনের ফাটল এবং Opening সৃষ্টি করে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই সব স্থানে বা মাটিতে নির্মিত রাস্তা, ব্রিজ, পানির প্রবাহ, প্রাকৃতিক গ্যাস, টেলিফোন ও তার যোগাযোগব্যবস্থা। সোয়ারেজ লাইন এবং ভবনেরও মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। মাটির নিচে নির্মিত ট্যাঙ্ক এবং ম্যানহোল লিকুইফেকশনের ফলে সৃষ্ট ঊর্ধ্বমুখী চাপের প্রভাবে মাটির ওপরে তেড়ে ওঠে। বন্যা প্রতিরোধকারী বাঁধসমূহ তাদের স্থায়িত্ব হারিয়ে ভেঙে পড়ে।
লিকুইফেকশন এমন একধরনের প্রাকৃতিক ঘটনা, যার প্রভাবে মাটি তার চাপ বা লোড বহনকারী ক্ষমতা হারিয়ে পানি বা তরলের মতো আচরণ করে। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট লিকুইফেকশনের প্রভাবে বালুযুক্ত মাটি রাস্তাঘাট ফসলের জমি প্লাবিত করে ফেলে। ফলে পুনরায় চাষাবাদ শুরু করতে সমস্যায় পড়তে হয়। তা ছাড়া বালুযুক্ত মাটি সর্বত্র ছড়িযে পড়ার ফলে যোগাযোগব্যবস্থা অনেকাংশে ভেঙে পড়ে, যা জনজীবনে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করে।
ভূমিকম্পের যেমন কোনো ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি মাটির লিকুইফেকশনের কোনো ধরনের সতর্কতামূলক বার্তা জানানো সম্ভব নয়। এর ক্ষতির প্রভাবকে শুধু যথাযথ প্রযুক্তিমূলকব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই অভিজ্ঞ ভূ-তত্ত্ববিদ দ্বারা মাটি পরীক্ষা করে মাটির লিকুইফাইড প্রবণ অঞ্চল নির্ধারণ করা উচিত, যার দ্বারা নিয়মিত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
প্রকৌশলী সনজিত সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৪