ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

বিশ্বের জনবহুল শহরের অন্যতম ঢাকা। প্রতিদিন বাড়ছে এ শহরের জনসংখ্যা। শিক্ষিত-অশিক্ষিতনির্বিশেষে সবাই আজ রাজধানী তথা ঢাকামুখী। ফলে দিন দিন প্রকট হচ্ছে আবাসনসংকটসহ বহুবিধ সমস্যা। আবাসনের সমস্যা সমাধানে বরাদ্দকৃত প্লটের প্রায় পুরো এলাকা আচ্ছাদন করে গড়ে উঠছে বিশালাকৃতির সব অট্টালিকা। যাতে আবাসন সমস্যার উত্তরণ ঘটলেও বাড়ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা। শহরবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন পরিবেশের নানামাত্রিক সুফল (আলো, বাতাস, সবুজ স্নিগ্ধ দৃশ্য) থেকে। ঢাকা শহর তরতরিয়ে ভরছে ইট-পাথরের দালানকোঠায়। কিন্তু নির্বিঘ্ন বসবাসে পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি যাতায়াতব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারায় জনজীবন ক্রমেই হয়ে পড়ছে দুর্বিষহ। যে হারে আবাসস্থল বাড়ছে, সে হারে বাড়ছে না আনুষঙ্গিক সুবিধাদি। একটি এলাকার আবাসনব্যবস্থা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক সুবিধাদি, যেমন- গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সরাবরাহ, সুষ্ঠু পয়ঃপ্রণালি, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ ইত্যাদি বাড়াও প্রয়োজন। আর এই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টির যথার্থ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জনদুর্ভোগ বাড়ছে প্রতিনিয়তই।

ছোট্ট একটি উদাহরণ থেকে ব্যাপারটি সহজেই অনুমেয়, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি আমরা। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় গৃহনির্মাণের জন্য বরাদ্দকৃত এক বিঘার (১৪,৪০০ এসএফটি-বর্গফুট) একটি প্লটের ওপর একতলা দোতলা মিলে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে বাস একটি পরিবারের। অত্র ফ্ল্যাটের গ্রাউন্ড কাভারেজ ১,৫০০ থেকে ২,০০০ বর্গফুট (১১ থেকে ১৫ শতাংশ) মাত্র। বাড়ির চারদিকে সবুজঘেরা পরিবেশ (ফল ও ফুলের বাগান), আঙিনার মধ্যেই নিজস্ব খেলার মাঠ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে ছোট্ট পানির ফোয়ারা বা জলাধার। বাড়িতে গাড়ির সংখ্যা একটি, বড় জোর দুটি। সব মিলে স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব, স্বাচ্ছন্দ্য এবং মনোরম একটি আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিতি ছিল ধানমন্ডির। এখন ধানমন্ডির সেই এক বিঘা জমির ওপর সমস্ত এলাকাজুড়ে নির্মিত হচ্ছে ৩০টি পরিবারের বসবাসযোগ্য বিশাল সব অট্টালিকা। যেখানে ইট-পাথরের বৃহৎ একটি ইমারত ছাড়া সবুজের লেশমাত্র নেই। অট্টালিকাটিতে বসবাসরত বাসিন্দাদের গাড়ির সংখ্যাই ৩০টি। অথচ এসব গাড়ি চলাচলে বাড়েনি রাস্তার পরিসর, বাড়েনি পয়ঃপ্রণালি, গ্যাস ও পানির লাইনের প্রসারতা কিংবা বিদ্যুতের সরবরাহ। ফলে যানজটসহ নানা সমস্যার আবর্তে ধানমন্ডির বাসিন্দারা। আর একই অবস্থা বিরাজমান রাজধানী ঢাকার সর্বত্রই।

দৃষ্টিনন্দন ধানমন্ডি লেক

প্রকৃতি আর বাস্তবতাকে অস্বীকার করবার সাধ্য নেই মানুষের। একজন মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম বাসস্থান, যা অনেক সময় স্বাস্থ্যঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যেকোনো বাসস্থান নির্মাণের সময় স্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’, সে অর্থে সবারই স্বাস্থ্যসচেতন হওয়াটা জরুরি। তাই একটি আবাস নির্মাণের সময় চারপাশে উন্মুক্ত জায়গা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই নির্মাণকাজ তদারককারী সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন সাইজের প্লটে ইমারত নির্মাণকল্পে প্রণীত নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি বা বিধিমালা মেনে চলা দরকার। কিন্তু জনবহুল এই ঢাকায় কোনো নিয়মনীতি মানছেন না নির্মাতারা। এতদ্সংক্রান্ত বিধিনিষেধ সবিস্তারে জানা না থাকলেও যাঁর যতটুকু জানা আছে, তারও তোয়াক্কা করছেন না কেউই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইমারতের ফাউন্ডেশন নির্মাণের সময় কিছু নিয়মকানুন মানা হলেও ছাদ করার সময় তা উপেক্ষা করে সীমানাজুড়ে ইমারত নির্মাণের প্রবণতাই বেশি। এ ছাড়া অবৈধ কিছু অনুমোদনও আছে, যা নজরদারি করার যেন কেউই নেই।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, নেই নাগরিক সচেতনতা। অন্যদিকে, বিদ্যমান অবস্থার উন্নতিকল্পে কিছু পরিকল্পনা গৃহীত হলেও বাস্তবায়নটা সুদূরপরাহত। আজও ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসৃত হচ্ছে। ১৯৯৩ সালে প্রণীত জাতীয় বিল্ডিং কোডের অনুমোদন হয়নি এখনো। এ ছাড়া ২০০৬ সালে রাজউক কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল, ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮’, যার বাস্তবায়নও সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায়নি। আবারও সংস্কার করা হচ্ছে ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’, যা অনুমোদনের অপেক্ষায়। কবে তার অনুমোদন হবে আর অনুমোদন হলেও তার প্রয়োগ হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে এ ব্যাপারেও। প্রবাদ আছে ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়’, আমাদের অবস্থাও আজ তা-ই। আইন আছে, নেই তার যথার্থ প্রয়োগ। নেপথ্যে ‘রক্ষকই ভক্ষক’, বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। কারণ, এই কাজটি বাস্তবায়নে যাঁরা নিয়োজিত তাঁরাই ভঙ্গ করছেন প্রচলিত নিয়মনীতি। এমন হাজারও নজির খুঁজে পাওয়া যাবে। জনস্বার্থ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যে যাঁর অবস্থান থেকে শুধু নিজের স্বার্থ কিংবা আর্থিক লাভ খোঁজার কাজে ব্যস্ত। অন্যের স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে কি না কিংবা তাঁর কৃতকর্মের ভবিষ্যৎ সুফল-কুফল কী হবে, তা দেখার সময় যেন কারোরই নেই। অবৈধ সম্পদ অর্জনের নেশায় স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বরণ করেছেন একশ্রেণির মানুষ। অর্থের লোভে বাস্তব অবস্থা দেখেও না দেখার ভান করেন বিভিন্ন তদারককারী সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা

এ অবস্থার উন্নতি প্রয়োজন। কিন্তু, কীভাবে? কে এই অসাধ্য সাধন করবে জানা নেই কারোই। দায়িত্ব ও সমন্বয়হীনতা সর্বত্র, নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে মুক্ত রাখার অপপ্রয়াসে ব্যস্ত সবাই। এটা সত্য যে তদারককারী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি সোচ্চার হতো, তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান হতো। দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সব ধরনের প্রয়োগই অপপ্রয়োগে রূপান্তরিত হচ্ছে। নিয়মনীতি বিকিকিনি হচ্ছে টাকার বিনিময়ে কিংবা ক্ষমতার বলে, যা কঠোরহস্তে দমন করা আবশ্যক। বিদ্যমান অবস্থার উন্নতিতে, শুধু ইমারত নির্মাণ আইন সংস্কার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। নির্মাণ আইন সংস্কারের পাশাপাশি সংস্কার করতে হবে তদারককারী সংস্থার আইনও। তদারককারীকে জবাদিহির আওতায় আনতে হবে, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে দলমত-নির্র্বিশেষে।

সর্বোপরি, সব নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের প্রয়োজন আত্মশুদ্ধির। বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে নাগরিক সচেতনতা বাড়ানো এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার। নৈতিক অবক্ষয় আমাদের গ্রাস করছে, এই অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে সমগ্র জাতি তথা আগামী প্রজন্মকে। মানুষের মৌলিক চাহিদা বিবেচনায় এনে নির্ধারণ করতে হবে সব ধরনের নীতিমালা। পরিবেশ বাঁচাতে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সকল নিয়মনীতি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে সর্বস্তরের মানুষকে।

রাজউক ভবন, মতিঝিল

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ, জীবন ফেলো, আইইবি (এফ-৭৫৯৭), জীবন সদস্য, বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান), ডিজিএম (কিউএ অ্যান্ড এমআর), দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি.

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top