নির্মাণে কংক্রিট ও কংক্রিটিং (পর্ব-১)

পৃথিবীর উন্নত অনুন্নত সব দেশেই স্থায়ী কাঠামো নির্মাণকল্পে কংক্রিটের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। আর এই কংক্রিটের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে একটি কাঠামোর সার্বিক গুণাগুণ ও দীর্ঘ স্থায়িত্বতা। সুতরাং শক্ত, মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো নির্মাণ নিশ্চিত করতে কংক্রিট ও কংক্রিটিংয়ের কাজ গুণগত মানসম্পন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আছে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি ও বিধিনিষেধ। এসব নিয়মনীতি ও বিধিনিষেধ মেনে ডিজাইন-ড্রয়িং করা এবং তদনুযায়ী ভৌত কাজ বাস্তবায়ন করা পুরকৌশলের জরুরি বিষয়। নইলে পরবর্তীকালে কাঠামো ধসে পড়াসহ যেসব বিভ্রাট হয় তার খেসারত দিতে সমূহ ভোগান্তি পোহাতে হয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এমন অনেক তিক্ত ঘটনার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। ফলে, দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট এবং কংক্রিট ও কংক্রিটিং কাজের গুরুত্ব সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরতেই এবারের লেখা।

কংক্রিট
স্থায়ী একটি কাঠামো নির্মাণে ইট কিংবা পাথরের খোয়া, বালু, সিমেন্ট ও পানির সংমিশ্রণে তৈরি (জমাট বাঁধানো) বস্তুই কংক্রিট নামে পরিচিত। কাজের ধরন ও গুরুত্ব অনুসারে কংক্রিট দুই ভাগে বিভক্ত ১. প্লেইন কংক্রিট বা সিমেন্ট কংক্রিট (সি.সি.) এবং ২. রেইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট (আর.সি.সি.)। শক্ত কোনো বেইজকে অধিকতর শক্ত করে ভার (কমপ্রেসিভ লোড) বহন ক্ষমতা বাড়াতে সি.সি. ব্যবহার করা হয়, যা সিমেন্ট, বালু, ইট বা পাথরের খোয়া ও পানির সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়। সি.সি. তৈরির ক্ষেত্রে শুধু কমপ্রেসিভ লোড বহন ক্ষমতাই বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া কমপ্রেসিভ ও টেইনসাইল লোড উভয়ই বহন করবে এমন কোনো কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আর.সি.সি. ব্যবহার করা হয়, যা কাঠামোর ধরন ও বহন ক্ষমতা অনুযায়ী ডিজাইন করা রডের খাঁচা বসিয়ে সিমেন্ট, বালু, ইট বা পাথরের খোয়া ও পানির সংমিশ্রণে জমাট বাঁধানো হয়।

ইটের খোয়া (ব্রিক চিপস)

কংক্রিট তৈরির কাজের জন্য সংগৃহীত মালামাল খোয়া, বালু, সিমেন্ট ও পানি সবকিছুরই আলাদা আলাদাভাবে গুণগত মান বিশ্লেষণ করা জরুরি। তাই অত্র কাজে ব্যবহৃতব্য মালামালের গুণাগুণ সম্বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবার সম্যক ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • খোয়া : অবশ্যই প্রথম শ্রেণির ইট কিংবা ভালো মানের পাথর থেকে প্রস্তুতকৃত হতে হবে। কংক্রিট তৈরির জন্য সাধারণত ৩-৪ ইঞ্চি ডাউন গ্রেডেড এবং ডাস্ট ফ্রি খোয়া ব্যবহার করা হয়। ডাস্ট ফ্রি করার জন্য খোয়া ব্যবহারের পূর্বে অবশ্য চালনি দিয়ে চেলে নিতে হবে। এ ছাড়া খোয়ার মধ্যে কোনো রকম কাদামাটি, খড়কুটো, কাগজ ইত্যাদি বস্তু মিশ্রিত থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
  • বালু : ডিজাইনারের নির্দেশনা অনুযায়ী বালুর এফ.এম (ফাইননেস মডুলাস, যা সাধারণত ২.৫-এর বেশি হয়) এবং মিক্সিং অনুপাত ঠিক থাকা প্রয়োজন। বালুর মধ্যে কাদামাটি, খড়কুটো, কাঠ-কয়লার গুঁড়া, কাগজ ইত্যাদি বস্তু মিশ্রিত থাকার কোনো অবকাশ নেই।
  • সিমেন্ট : অনেক দিনের পুরোনো এবং ব্যবহারের আগেই জমাট বেঁধে গেছে এমন কোনো সিমেন্ট নির্মাণকাজে ব্যবহারের উপযোগী নয়।
  • পানি : নোংরা কিংবা লবণযুক্ত পানি কংক্রিট মেশানোর কাজে ব্যবহার যোগ্য নয়, শুধু খাবার উপযোগী পানিই এ কাজে ব্যবহারের উপযোগী বলে বিবেচিত। অতএব, কংক্রিটের জন্য মালামাল সংগ্রহের আগে অবশ্য উল্লেখিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে। প্রয়োজনে ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে মালামালের গুণাগুণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্মাণকাজের জন্য সংগৃহীত সিমেন্ট মজুদ করার বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সিমেন্ট বেশি দিন মজুদ রাখা ঠিক নয়। উপরন্তু সিমেন্ট মজুদ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, সিমেন্টের বস্তাগুলো যেন কোনো অবস্থাতেই নিচের মাটি কিংবা দেয়ালের সংস্পর্শে না আসে এবং বাইরের খোলা বাতাস ও বৃষ্টির পানি যেন বস্তার গায়ে লেগে না থাকে। এতদার্থে সিমেন্টের স্টোর হতে হবে সুরক্ষিত। খোলা আকাশের নিচে, ভেজা কিংবা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় সিমেন্ট রাখা যাবে না। সিমেন্ট স্টোরের ফ্লোরে কাঠ, বাঁশ ও প্লেইন শিট দিয়ে মাচা করে তার ওপর সিমেন্টের বস্তাগুলো রাখতে হবে এবং দেয়ালের গা থেকে অন্তত ৬ ইঞ্চি দূরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। সিমেন্ট ছাড়াও অন্যান্য মালামালের সুষ্ঠু সংরক্ষণের ওপর নজর দিতে হবে, যাতে এর মধ্যে বাইরের অনাকাঙ্খিত কোনো বস্তু মিশতে না পারে।

স্টোন চিপস

কংক্রিটিং
স্থায়ী কোনো কাঠামো নির্মাণকল্পে কংক্রিট (সিমেন্ট, বালু, খোয়া ও পানি) মেশানো এবং জমাট বাঁধানো কাজকে এককথায় কংক্রিটিং বলা হয়ে থাকে। আর একটি কাঠামোর সার্বিক গুণাগুণ ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে কংক্রিটিংয়ের বা কাজের গুণগত মান ভালো হওয়া দরকার। ম্যানেজমেন্টের ভাষায় কোনো কাজের মান প্রধানত চারটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে-
ম্যান (লোকবল) : কর্তব্যরত মিস্ত্রি, সুপারভাইজার ও ইঞ্জিনিয়ারের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা
মেশিন : কাজে ব্যবহৃতব্য যন্ত্রপাতির মান
ম্যাটেরিয়াল (কাঁচামাল) : ব্যবহৃতব্য মালামালের গুণাগুণ, যা আগেই বর্ণনা করা হয়েছে
মেথড (কর্মপদ্ধতি) : প্রতিটি কাজ সুসম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কাজের পদ্ধতি অবশ্যই লক্ষণীয়। এ ছাড়া কাজের তদারকি নিশ্চিত করা এবং এর জবাবদিহির বিষয়টি আমলে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এ সংক্রান্ত নিয়মনীতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবার সম্যক কিছু ধারণা থাকা জরুরি। উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রথম তিনটির ব্যাপারে সবার মাঝেই কমবেশি সচেতনতা থাকলেও চতুর্থটি অর্থাৎ মেথড বা পদ্ধতিগত ব্যাপারে অনেকেই ওয়াকিফহাল নন।

কংক্রিটিং-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি ও বিধিনিষেধ আছে, যা মেনে চলা অপরিহার্য। যেমন- সিমেন্ট, বালু ও খোয়ার অনুপাত, স্লাম্প, ওয়াটার-সিমেন্ট রেশিও ইত্যাদি সঠিকভাবে জেনে নেওয়া এবং তদনুযায়ী কাজ সম্পাদন করা জরুরি। একটি পূর্ণ স্ট্রাকচার বা কাঠামোর প্রতিটি মেম্বরের জন্য উল্লেখিত বিষয়সমূহের মান এক নাও হতে পারে। সাধারণত বিম ও কলামে একই অনুপাতের কংক্রিট হয়ে থাকে। এ ছাড়া ছাদ ও অন্যান্য মেম্বরে বিভিন্ন অনুপাতে হয়, যা নির্ভর করে স্ট্রাকচার বা কাঠামোর অবস্থা এবং ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারের সিদ্ধান্তের ওপর। এসব বিষয় স্ট্রাকচারাল ড্রয়িংয়ে লেখা থাকে। ফলে সুপারভাইজিং ইঞ্জিনিয়ার কর্তৃক সব ড্রয়িং ভালোমতো স্টাডি করা এবং প্রয়োজনে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে বুঝে নেওয়া জরুরি। আমাদের দেশে সাধারণত দুইভাবে কংক্রিট মেশানো হয়- ১. হাতে ও ২. মেশিনে। হাতে কংক্রিট মেশানোর ক্ষেত্রে পাকা কোনো সমতল জায়গায় প্রথমে খোয়া সমান পুরুত্বে বিছিয়ে তার ওপর বালু এবং সর্ব ওপরে সিমেন্ট বিছিয়ে কোদাল বা বেলচা দিয়ে শুকনো অবস্থায় সমভাবে মিশিয়ে নিতে হবে, যাতে সর্বত্র একই রং দেখা যায়। তারপর অল্প অল্প করে পানি দিয়ে নির্দিষ্ট স্লাম্প ঠিক রেখে কংক্রিট মেশানোর কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মেশিনে কংক্রিট মেশানোর ক্ষেত্রে অনুপাত অনুসারে খোয়া, বালু ও সিমেন্ট দেওয়ার পর অল্প অল্প পানি মেশাতে হবে। উভয় ক্ষেত্রেই ওয়াটার-সিমেন্ট রেশিও এর বিষয়টি খোয়াল রেখে কাজ সম্পন্ন করা অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া মেশিনে কংক্রিট মেশানোর ক্ষেত্রে আর একটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, তা হলো- পানি দেওয়ার পর অধিক সময় মেশিন ঘোরানো ঠিক নয়। মেশিনের অবস্থাভেদে সর্বোচ্চ এক মিনিট পর্যন্ত মেশিন ঘোরানো যাবে।

এরপর কংক্রিট ঢালা, কম্প্যাকশন করা এবং ফিনিশিং দেওয়ার সময়সীমাসংক্রান্ত বিষয়গুলোও বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। কংক্রিট ঢালাই ফর্মে ঢালার সময় বেশি উঁচু থেকে ফেলা ঠিক নয়। এতে সেগ্রিগেশন হয়ে কংক্রিটের কাঙ্খিত শক্তি সঞ্চারে বিঘœ ঘটে। এরপর কম্প্যাকশন করার জন্য যদি ভাইব্রেটর মেশিন ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে মেশিন চালানোর সময়টিও লক্ষণীয় বিষয়। অধিক সময় মেশিন চালানো হলে এ ক্ষেত্রেও সেগ্রিগেশন হয়ে কংক্রিটের কাঙ্খিত শক্তি সঞ্চারে বিঘ্ন ঘটতে পারে। সর্বশেষ ফিনিশিং দেওয়া, নিয়মানুযায়ী কংক্রিট পানি দিয়ে মেশানোর সময় থেকে ফিনিশিং দেওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ সময়সীমা ৪৫ মিনিট। এ সময়ের মধ্যে প্রতিটি ব্যচের কংক্রিটিং শেষ করা উত্তম। সর্বোপরি, কাজের আগের দিন খোয়া ভেজানো দরকার, বিষয়টি অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

ময়লাযুক্ত বালু, ময়লাবিহীন বালু ও নির্মিত হচ্ছে কংক্রিট সড়ক (উপরে বা থেকে)

কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সুচিন্তিত একটি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন, প্রয়োজন তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। তাই কংক্রিটিংয়ের পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো, যা মেনে চলা অত্যাবশ্যক। নইলে ত্রুটিপূর্ণ এবং দুর্বল একটি কাঠামো নির্মিত হবে আপনারই অজান্তে। পরিশেষে, যেকোনো কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে নিয়মিত তদারকি নিশ্চিত করা অপরিহার্য, যার জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগের বিকল্প নেই। এতদ্সঙ্গে নিশ্চিত করা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজের জবাবদিহিতা। অন্যথায় এর সব দায়ভার এসে পড়ে নিয়োগকারী কিংবা নিয়োগকারী সংস্থার ওপর। সর্বোপরি, নির্মাণকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সততা, কর্মনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে কাজের গুণাগুণ ও স্থায়িত্বতা।

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ, জীবন ফেলো, আইইবি (এফ-৭৫৯৭), জীবন সদস্য, বিএসটিকিউএম, বিএএএস, এওটিএস (জাপান), ডিজিএম (কিউএ অ্যান্ড এমআর), দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি.

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৩ তম সংখ্যা, মে ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top