মোগল শাসনের সময় বাংলাদেশও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তৎকালে মোগলরা এই উপমহাদেশে অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেন। মোগল স্থাপত্যে পারস্য, ইসলামি এবং ভারতীয়দের নকশার সংমিশ্রণ লক্ষণীয়। এই স্থাপত্যের বিশেষ দিক চূড়ায় গম্বুজের ব্যবহার, যা স্থাপনাগুলোকে দেয় ভিন্ন মাত্রা। এসব স্থাপনা এখন বাংলাদেশের মোগল ঐতিহ্যের ধারক।
টাঙ্গাইল শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়া গ্রামে অবস্থিত এ মসজিদটি। আশির দশকে ১০ টাকার নোটের ঠিক ডান দিকে এই মসজিদের ছবি ছিল। করোটিয়ার জমিদার সৈয়দ খান পন্নি লোউহজাম নদীর পূর্ব দিকে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির নির্মাণ পরিকল্পনায় এবং নির্মাণকাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন প্রখ্যাত স্থপতি মুহম্মদ খাঁ।
মসজিদটি বর্গাকার। লাল ইটের নির্মিত এই স্থাপত্যকলাটি তেমন বড় নয়, বারান্দাসহ মাত্র ১৮.২৯ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১২.১৯ মিটার প্রস্থ। মসজিদের সামনেই রয়েছে একটি পুকুর। চারপাশে সবুজ, মনোরম ও শান্ত পরিবেশ বিরাজমান। প্রবেশদ্বারে দুই দিকে রয়েছে দুটি মিনার, যেগুলোর ওপর কলসি আকৃতির নকশা তৈরি করা হয়েছে। ভেতরে প্রবেশ করলে পূর্বদিকে খোলা একটি বারান্দা বা মাঠ দেখা যায়। অভ্যন্তরীণ প্রার্থনা কক্ষটি ৭ মিটার, যার পূর্ব দিকের দেয়ালে তিনটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই দ্বারসমূহ খিলানাকৃতির; মাঝখানের প্রবেশপথটি অন্য দুটির তুলনায় প্রশস্ত। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে কুলুঙ্গি আছে। এই কুলুঙ্গির ধারণা প্রাচীন বাংলার ব্যবহার হওয়া বাড়িঘর থেকে অনুপ্রাণিত। পাশে একটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে।
মসজিদের শীর্ষে একটি বড় গম্বুজ নির্মিত হয়েছে, যা একটি বিশাল ড্রাম আকৃতির স্ট্রাকচারের ওপর স্থাপিত; গম্বুজের ওপরে রয়েছে পদ্ম ফুল এবং কলসির নকশা। মসজিদটির চারকোণে চারটি অষ্টভুজাকৃতির মিনার রয়েছে। এর প্রতিটি আনুভ‚মিকভাবে গ্রুভ দিয়ে বিভক্ত এবং কার্নিশের ওপরে উত্থিত। মিনারের ওপরের অংশ পদ্ম এবং কলসি দ্বারা অলংকৃত। পূর্ব দেয়ালের কার্নিশ সামান্য বাঁকানো বলেই হয়তো মসজিদটিকে ভিন্ন মনে হয়। এই ধরনের বক্রতা প্রাক্-মোগল আমলে খুব করে লক্ষ করা যেত। পুরো মসজিদটির মোট চারটা গম্বুজ রয়েছে, একটি বড় এবং তিনটি ছোট। প্রতিটির শীর্ষে একইভবে পদ্ম ও কলসির নকশা রয়েছে। এই ধরনের গম্বুজের নকশা মোগল আমলের প্রায় মসজিদগুলোতেই রয়েছে।
লক্ষণীয় হলো মসজিদটি পূর্বদিকের দেয়ালের পৃষ্ঠদেশ একটি আনুভূমিক দন্ড দ্বারা প্রায় দুটি সমান অংশে বিভক্ত কিন্তু অন্যদিকের দেয়ালগুলো পোড়ামাটির প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। উত্তর দেয়ালটির ওপরের অংশে তিনটি বাঁকা আনুভ‚মিক বার লক্ষ করা যায়। মসজিদটির দেয়ালে নানা ধরনের টেরাকোটার কারুকার্য সত্যিই নান্দনিক। চক্রাকার বৃত্তে ফল, জ্যামিতিক নকশা এবং খোদাই করা লতাপাতার নকশা দেখে ওই যুগের মননশীলতা প্রকাশ পায়। মসজিদটির দেয়ালের নিম্নদেশ থেকে শুরু করে ওপরে কার্নিশ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকার মতো মনোমুগ্ধকর নকশা দেখতে ছুটে আসেন অসংখ্য দর্শনার্থী।

পূর্ব দিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের ওপরে খোদাই করা শিলালিপি থেকে জানা যায়, বায়েজিদ খান পন্নির ছেলে সায়েদ খান পন্নি, করোটিয়ার জমিদার ১৬০৯ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। অন্য আরেকটি ফলকে লিপিবদ্ধ করা আছে যে রউশন খাতুন চৌধুরী নামের একজন ১৮৩৮ সালে এই মসজিদটির সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ১৯০৯ সালে আবু আহমেদ গুজনবি খান নামের একজন ওয়াজেদ আলি খান পন্নির সহায়তায় এই মসজিদের সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেন। মসজিদটি ১৯৫৯ সালে সংরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং ১৯৮৭-৮৮ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের তত্ত্বাবধানে পুনরুদ্ধার করা হয়।
– বিজয়া চৌধুরী
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৩ তম সংখ্যা, মার্চ ২০২৪