প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ জনপদ কলাকোপা-বান্দুরা। এ যেন স্থাপত্য সৌন্দর্যমণ্ডিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিশাল এক ভান্ডার। ঢাকা থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার অদূরে ইছামতীর তীরে গড়ে উঠেছে নবাবগঞ্জের সমৃদ্ধ এ লোকালয়টি। ইছামতী নদী যার প্রাণ। উনিশ শতকেও এখানে বসত ছিল জমিদারদের। একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যে সরব ছিল জায়গাটি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে নিজের অস্তিত্বকে সগৌরবে জানান দিচ্ছে কোকিল পেয়ারী জমিদারবাড়ি বা জমিদার ব্রজেন সাহার ‘ব্রজ নিকেতন’। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাটি বর্তমানে সবার কাছে ‘জজবাড়ি’ নামে সমধিক পরিচিত।
চার একর ৫৭ শতাংশ জায়গাজুড়ে জমিদারবাড়িটির অবস্থান। বাগানঘেরা বিশালাকৃতির নান্দনিক এই দ্বিতল জমিদারবাড়িতে রয়েছে সাদা রঙের আধিক্য। আয়তকার বাড়িটির সামনের বারান্দার দুই পাশ দিয়ে ওপরে উঠে গেছে গোলাকার নয়টি কোয়ান্থিয়ান পিলার। বারান্দায়ই রয়েছে পাঁচটি পিলার, বাকি চারটি মূল ভবনসংলগ্ন। এসব পিলারজুড়ে রয়েছে চীনামাটির অপূর্ব সুন্দর সব চিনি টিকরি অলংকরণ। পিলারের উপরিভাগ অনেকটা ফুলের আদলে গড়া। বাড়িটির সম্মুখভাগ আর পিলারের নির্মাণশৈলীতে পাশ্চাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। পুরো বাড়িটাই নির্মিত রোমান-গ্রিক স্থাপত্যরীতি। ভবনের দেয়াল বর্ণিল কারুকাজে মোড়ানো। নিখুঁত এসব কারুকার্যের মধ্যে ফ্লোরাল ডিজাইনের আধিক্যই বেশি। এর সঙ্গে আরও রয়েছে সাপ, ময়ূর, পাখিসহ নানা রকম কারুশৈলী। খুব ভালোভাবে লক্ষ করলে ক্রাফটম্যানদের নিখুঁত হাতের কারুকাজ বোঝা যায়। ভবনের দরজা ও জানালা তৈরি হয়েছে মূল্যবান কাঠে। এর ওপরে রয়েছে ভেন্টিলেশন সিস্টেম। জানালাগুলো কান্টিলিভার সিস্টেমের। জানালার ওপরে কোনো কার্নিশ না থাকায় ছাদটাকেই বর্ধিত করা হয়েছে। পুরো ছাদকে ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট গম্বুজ। বারান্দার পরিসরটাও বেশ বড়। বাড়ির সামনে ফলবাগানের মাঝ বরাবর একটি রাস্তা মিলেছে মূল ভবনে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়েই উঠতে হয় ভবনটিতে।

কোকিল পেয়ারী জমিদারবাড়িটিকে ঘিরে আছে প্রচুর গাছপালা ও সাজানো-গোছানো ফুলের বাগান। পাখির কিচিরমিচির শব্দ তাই লেগেই থাকে সারাক্ষণ। রয়েছে পোষা হরিণের একটি খামার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে যখন এই চিত্রাল হরিণগুলো নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়, তা দেখতে সত্যিই চমৎকার লাগে। বাড়িটির চারপাশের লাগানো ফুলগাছে ফুটে থাকা বর্ণিল সব ফুল সবার দৃষ্টি আর্কষণ করে। এগুলোই জমিদারবাড়িটির সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণ। ভবনের পাশেই রয়েছে বেশ বড় একটি পুকুর। এর শান বাঁধানো ঘাটও স্থাপত্যটিকে দিয়েছে নান্দনিক নৈসর্গিকতা।
জনশ্রæতি আছে, নবাবী শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ দমন ও দাপ্তরিক কাজে পূর্ব বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ হয়ে যাওয়ার সময় ইছামতী নদীর তীরে সবুজ শ্যামলিমা ঘেরা এই এলাকায় নবাবসহ তাঁর সেনা ও সফরসঙ্গীরা বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতি করতেন। সবজি, মাছ, মাংস ও অন্য দ্রব্যাদি বিক্রয়ের জন্য বিক্রেতা বা ব্যবসায়ীরা গড়ে তোলেন অনেক দোকানপাট। ফলে এখানে সৃষ্টি হয় একটি ব্যবসাকেন্দ্র বা গঞ্জের। নবাবদের আগমন হেতু এলাকার নামকরণ করা হয় নবাবগঞ্জ। এলাকাটি একসময় সমৃৃদ্ধ জনপদ ছিল, যার প্রমাণ এলাকাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা স্থাপনা। কলাকোপার আকর্ষণ এই ভবনটিই জমিদার ব্রজেন সাহার (সুদর্শন রায়) সময়ে পরিচিত ছিল ‘ব্রজ নিকেতন’ নামে। ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তিতে জমিদারবাড়ির বাসিন্দারা ভারতে চলে যাওয়ায় নিয়মানুযায়ী বাড়িটি তালিকাভুক্ত হয় পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে। আশির দশকে এক জজ এই বাড়িতে বসবাস শুরু করলে ‘ব্রজ নিকেতন’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাড়িটির নাম হয় ‘জজবাড়ি’। ধীরে ধীরে বাড়িটি এই নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
জজবাড়ি এখন কলাকোপা-বান্দুরার প্রাণ। এই বাড়িকে ঘিরেই এখানে গড়ে উঠেছে স্থানীয় বাজার। এলাকার জনগণ ছাড়াও প্রচুর দর্শনার্থী প্রতিদিন এখানে পরিদর্শনে আসে। রাস্তার একপাশে জজবাড়ি অন্যপাশে দোকান, এতে বাজারটি এককথায় রূপ নিয়েছে কোলাহলমুখর জমজমাট এক এলাকায়। এলাকাটিকে ঘিরে আছে আরও বেশ কিছু পুরোনো স্থাপনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মঠবাড়ি বা তেলিবাড়ি নামে খ্যাত শ্রীযুক্ত বাবু লোকনাথ সাহার বাড়ি, ব্যবসায়ী রাধানাথ সাহার বাড়ি, মধুবাবুর পাইন্নাবাড়ি, পোদ্দারবাড়ি, কালীবাড়ি, সামসাবাদ তাঁতপল্লী, আলালপুর তাঁতপল্লী এবং শ্রী শ্রী মহামায়ার মন্দির। এ ছাড়া রয়েছে দৃষ্টিনন্দন জপমালা দেবীর গির্জাসহ পুরোনো সব স্থাপনা।

কর্মব্যস্ত যাপিত এ জীবনে সময় করে একটা দিন ঘুরে আসুন দৃষ্টিনন্দন এ জায়গা থেকে। দেখে আসুন এলাকার ঐতিহ্যবাহী নানা স্থাপনা। ঘুরে আসতে চাইলে ঢাকার বাবুবাজার তথা দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে যেতে হবে নবাবগঞ্জে। চৌরাস্তা বা মহাকবি কায়কোবাদ চত্বর থেকে সোজা গিয়ে রাস্তাটা মিশেছে কলাকোপায়। বাঁয়ের পথটি কলাকোপা হয়ে বান্দুরার। এলাকাটি ঘুরে ঘুরে দেখলে পাবেন পুরোনো স্থাপত্যের অপার স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্যময় সব অবকাঠামো। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়বে ব্রজমোহন সাহা নির্মিত এই ভবনটিই। এখানে কিছুটা সময় কাটানোর ইচ্ছের কমতি হবে না এতটুকু। অল্প-বিস্তর হলেও বাড়িটি নিয়মিত সংস্কার করায় এটা এখনো অটুট রেখেছে তার মহিমা। আর তাই এখনো ইতিহাস-ঐতিহ্য নির্ভর কোনো চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিফিল্মের শুটিংস্পট হিসেবে এটা সমান জনপ্রিয়। তবে স্থাপনাটিকে বহুল প্রচারে এনে এলাকাটিকে একটি আদর্শ পর্যটককেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব খুব সহজেই।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩