ভূমিকম্প বল প্রতিরোধে কংক্রিট ভবনের যত দুর্বলতা

ভূমিকম্প বাংলাদেশের অতিপরিচিত ঘটনা। বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশে ও তার আশপাশে ভূমিকম্প অনুভ‚ত হলেও প্রায় সব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে। যার ফলে এ দেশে ভূমিকম্পের কারণে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। বাংলাদেশ ও তার সন্নিকটে যেহেতু পাঁচটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির ক্ষমতাসম্পন্ন সিস্মিক চ্যুতি রয়েছে, তাই আশঙ্কা রয়েছে আমাদেরসহ নেপাল কিংবা ভারতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের। আবার দীর্ঘদিন ধরে ওই সিস্মিক চ্যুতিতে ভূমিকম্প সৃষ্টি না হওয়ায় ধারণা করা হয় এ অঞ্চলে মাটির গভীরে বড় ধরনের শক্তি সঞ্চিত রয়েছে, যার ফলে যেকোনো সময় এই সিস্মিক চ্যুতি থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। একটি ভূমিকম্পের সময় মূলত দুর্বল বাড়িঘরসহ অন্যান্য অবকাঠামো ভেঙে পড়ায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয় বেশি। এ কারণে ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে প্রয়োজন আমাদের বাড়িঘর ও পারিপার্শ্বিক অবকাঠামোর বর্তমান অবস্থা যাচাই করে ক্ষেত্রবিশেষে মজবুত ও দৃঢ় করা।

আমাদের দেশে প্রথমবারের মতো ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রকাশ করা হয় ১৯৯৩ সালে। তবে এই কোড চালু হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবে এ কোডের নীতিমালা মেনে নির্মিত হয়নি কোনো ধরনের অবকাঠামো। আর তাই প্রথমেই প্রয়োজন নির্মিত অবকাঠামোগুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অবকাঠামোর দুর্বলতা নির্ণয়ের প্রকৌশলগত কিছু পদ্ধতি রয়েছে। তবে সাধারণত যেকোনো বিল্ডিংয়ে প্রথমে তার চারপাশ এবং তার স্ট্রাকচারাল কাঠামো পর্যবেক্ষণ করে ওই ভবন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে যদি ভবনকে দুর্বল মনে হয় তবেই বিস্তারিতভাবে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী দিয়ে যথাযথভাবে ভবনের তৈরি করা নকশা এবং কাঠামোর বর্তমান শক্তি নির্ণয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট টেস্ট করাতে হবে (যেমন, কংক্রিটের কম্প্রেসিভ বল), বিল্ডিং কোডের নীতিমালা অনুযায়ী অবকাঠামোগত আনুষঙ্গিক অনুষঙ্গ ওই ভবনে আছে কি না যাচাই করতে হবে এবং স্ট্রাকচারাল মডেল করে ভবনের বর্তমান অবস্থান সম্ভাব্য বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে কেমন হবে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দিতে হবে। ভবনের স্থাপত্য নকশা ও স্ট্রাকচারাল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ভবনের দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করতে হবে। কংক্রিটের ভবনে ভূমিকম্প বলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ Structural Vulnerability Parameters হচ্ছে-

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ স্থাপনা, নেপাল

লোড পাথ (Load Path)
ভূমিকম্পের সময় ভবনের ভালো আচরণের অন্যতম উপাদান ভবনের সব ধরনের ভূমিকম্প-প্রতিরোধী স্ট্রাকচারাল মেম্বার একসঙ্গে বদ্ধ থাকতে হবে ইউনিট হিসেবে। এতে করে ভূমিকম্প বল যাতে সহজেই নিরবচ্ছিন্নভাবে ভবন থেকে মাটিতে পরিবাহিত হতে পারে।

রিডানডানসি (Redundancy)
রিডানডানসি হচ্ছে ভবনের কোনো একটি স্ট্রাকচারাল মেম্বার কিংবা সিস্টেম যদি অকেজো বা ভবনের বল সহনশীল করার জন্য কার্যকারিতা হারায়, তবে সে ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী অন্য প্যানেল বা সিস্টেমের মাধ্যমে ওই বল বহন করে ভবনকে টিকিয়ে রাখে। অর্থাৎ পাশাপাশি যদি অনেক স্ট্রাকচারাল সিস্টেম থাকে, তবে কোনো একটি সিস্টেম অকেজো হয়ে গেলেও বাকি সিস্টেমগুলো অকেজো হয়ে যাওয়া সিস্টেমের বল বহন করে। স্বাভাবিকভাবে একটা ভবন যদি Redundant হয়, তবে ভবনের জন্য ভালো।

ভার্টিক্যাল ডিসকন্টিনিউয়েশন (Vertical Discontinuities)
যদি কোনো স্ট্রাকচারাল মেম্বার ভবনের ওপরের তলা থেকে ভিত্তি পর্যন্ত প্রবাহিত না হয়ে ভবনের ভিত্তি থেকে ওপরের কোনো তলায় গিয়ে যদি থেমে যায়, তবে সেই অবস্থাকে Vertical Discontinuities বলে। এর খুব পরিচিত একটি উদাহরণ হচ্ছে Discontinuous Shear Wall এবং Braced Frame.

ভবনের জ্যামিতিক বিন্যাস
ভবনের প্ল্যান এবং উলম্ব বিন্যাস যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে ভূমিকম্প বলের প্রভাবে ভবনের অনেক জায়গায় Ductility Demand বেড়ে যায়। তা ছাড়া অসামঞ্জস্যপূর্ণ আকারের কারণে বিল্ডিংয়ের মধ্যে ভরের তারতম্য হয়, যার ফলে ভবনে কোনো কোনো অংশ Dynamically Independent হয়ে পড়ে। বিল্ডিংয়ের প্ল্যান সব সময় সমানভাবে উভয় অক্ষের সাপেক্ষে সমভাবে থাকা উচিত। ভবনের প্ল্যান দৃঢ় এবং গোছালো হওয়া উচিত তবে ঢ, ঐ, ও ইত্যাদির মতো জটিল নয়।

সফট স্টোরি (Soft Story)
যেকোনো ভবনের ক্ষেত্রে Soft Story অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে ভূমিকম্পের সময় যদি কোনো ভবনে Soft Story থাকে, তা ভবনের জন্য দুর্বলতার কারণ হিসেবে দেখা হয়। সাধারণত যদি ভবনের কোনো একটি তলার Stiffness ওই ভবনের সংযুক্ত ওপরের কিংবা নিচের তলার তুলনায় যথেষ্ট কম বা বেশি হয়, তবে এই ধরনের তলাকে Soft Story বলা হয়।

মাস ইরেগুলারিটি (Mass Irregularity)
ভবনের কোনো একটি তলার ভর যদি অতিরিক্ত হয় অথবা কোনো একটি তলার ভর অপরটি থেকে বেশি হয়। যেমন কোনো তলায় যদি ভারী যন্ত্রপাতি বা সুইমিংপুল থাকে, তবে ওই ভবনে Mass Irregularity সৃষ্টি হয়। এ ধরনের অবস্থা উপেক্ষা করা না গেলে অন্ততপক্ষে পরপর দুইটি তলায় mass to stiffness এর অনুপাত সমান রাখা বাঞ্ছনীয়।

টেনশনাল ইরেগুলারিটি (Tensional Irregularity)
তাত্তি¡কভাবে একটি দালানের ভরকেন্দ্র ও stiffness এর কেন্দ্র এক বিন্দুতে থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে প্রায়ই এমনটি রাখা সম্ভব হয় না। তবে torsional effects কমানোর জন্য Eccentricity সর্বনিম্ন রাখা উচিত। অর্থাৎ ভবনের ভরকেন্দ্র এবং stiffness-এর কেন্দ্র এর মাঝামাঝি দূরত্ব যথেষ্ট পরিমাণে কম রাখা উচিত।

পাউন্ডিং (Pounding)
ভবন তৈরির সময় ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য প্রায়ই একটি ভবনের পাশাপাশি আরেকটি ভবনের মাঝে তেমন পর্যাপ্ত ফাঁক রাখা হয় না, যার ফলে ভূমিকম্পের সময় ওই দুই ভবনের মাঝে সংঘর্ষের কারণ হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে একটা ভবনের ফ্লোরের লেভেল আরেকটার সঙ্গে একই সমতলে থাকে না এবং ভবনের মধ্যে দোলনকালের পার্থক্য থাকে, যার ফলে ভূমিকম্পকালীন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ভবন আরেকটা ভবনের বিপরীতক্রমে দুলতে থাকে এবং একটা আরেকটাকে আঘাত করতে পারে। এ ধরনের ঘটনাকে Pounding বলে।

শর্ট কলাম (Short Column)
যদি কোনো দালানের কোনো ফ্রেম ইনফিল দিয়ে আংশিকভাবে পূর্ণ অবস্থায় থাকে, তবে ওই ফ্রেমের কলামটি শক্তিশালী ভূকম্পনের সময় শর্ট কলাম ইফেক্টের সম্মুখীন হয়। কারণ, ফ্রেমটি উচ্চ শিয়ার ফোর্সের জন্যে ডিজাইন করা হয়নি, যা উচ্চতার আংশিক পূর্ণতাজনিত কারণে সৃষ্টি হয়। এই ধরনের অংশে ভূমিকম্পের সময় ভূমিকম্প বল বেশি ক্রিয়া করে, যার ফলে ওই শর্ট কলাম অংশের দৃঢ়তা যদি পর্যাপ্ত না হয় তবে ভবনের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভূমিকম্পে ভূমিধ্বস, পাকিস্তান

এক্সিটেন্স অব হেভি ওভারহ্যাংগস (Existence of heavy Overhangs)
সুউচ্চ ভবনে বড় ব্যালকনি বা দালানের বাইরে ঝুলন্ত ফ্লোর থাকলে দালানের ভরকেন্দ্র ওপরের দিকে সরে যায়। ফলে ভূকম্পনের সময় সিস্মিক আনুভূমিক বল এবং overturning moments বেড়ে যায়। আমাদের বড় ভবনে ব্যালকনির পরিমাণ ভবনের প্ল্যানের অনুপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করতে হবে, যাতে করে ওই ভবনের ওপরে ভূমিকম্প বলের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি না হয়।

আমাদের দেশের অধিকাংশ দালানকোঠাই এখন কংক্রিটের তৈরি। আমাদের ভবনগুলোতে উল্লেখিত কাঠামোগত চরিত্র যদি থাকে, তবে সেগুলো ভবনের জন্য ভূমিকম্প দুর্যোগ বিবেচনায় ক্ষতিকর। আমাদের উচিত হবে ওপরে উল্লেখিত বিষয়াদি যথাসম্ভব পরিহার করা। আবার আমাদের ভবনে এ ধরনের বিষয়াদি আছে কি না যাচাই করে আমরা ভূমিকম্পকালীন ভবনের আচরণ কেমন হতে পারে সে ধারণা সহজেই পেতে পারি।

রামকৃষ্ণ মজুমদার

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top